সামগ্ৰিকভাবে উভয় বঙ্গের বাংলা সাহিত্যাঙ্গনের অন্যতম দিকপাল, পন্ডিত, শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ, সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, অনুবাদক ও রম্যরচয়িতা ছিলেন ড. সৈয়দ মুজতবা আলী। তবে তিনি ভ্রমণ কাহিনীর জন্য পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকে বিশেষ জনপ্রিয় লেখক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর রম্যরচনা বিষয়ক ছোট ছোট রচনা গুলো পাঠকদের নিকটে চিত্তবিনোদন তথা অনাবিল আনন্দের উৎস ছিল। লিখেছেন এম ওয়াহেদুর রহমান।
সামগ্ৰিকভাবে উভয় বঙ্গের বাংলা সাহিত্যাঙ্গনের অন্যতম দিকপাল, পন্ডিত, শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ, সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, অনুবাদক ও রম্যরচয়িতা ছিলেন ড. সৈয়দ মুজতবা আলী। তবে তিনি ভ্রমণ কাহিনীর জন্য পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকে বিশেষ জনপ্রিয় লেখক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর রম্যরচনা বিষয়ক ছোট ছোট রচনা গুলো পাঠকদের নিকটে চিত্তবিনোদন তথা অনাবিল আনন্দের উৎস ছিল। পান্ডিত্য আর হ্নদয়বেত্তার সঠিক আনুপাতিক মিশেলে তিনি হাস্যরসকে বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সাহিত্যজগতে কখনো ‘ সত্যপীর ‘, ‘ ওমর খৈয়াম ‘, কখনো বা ‘ টেকচাঁদ ‘, অথবা ‘ প্রিয়দর্শি ‘ ছদ্মনামে নীরবে নিভৃতে লিখেছেন দেশ, আনন্দবাজার, বসুমতী,সত্যযুগ, মোহাম্মদী, শনিবারের চিঠি, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড,চতুরঙ্গ, মাতৃভূমি, কালান্তর প্রভৃতি পত্রিকায়। তিনি ভ্রমণ প্রিয়তার কারণেই বসবাস করছেন ভারত, জার্মান, আফগানিস্তান ও মিশরে। তাঁর জাতীয়তা ছিল যথাক্রমে ব্রিটিশ ভারতীয় ( ১৯০৪-১৯৪৭ ), পাকিস্তানি ( ১৯৪৭-১৯৪৯ ), ভারতীয় (১৯৪৯-১৯৭২ ), বাংলাদেশ ( ১৯৭২- ১৯৭৪ )। সৈয়দ মুজতবা আলী ‘দেশে- বিদেশে ‘ গ্ৰন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। গ্ৰন্থ খানি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি পাঠকচিত্ত জয়লাভ করতে সক্ষম হন।
সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের আসামের অন্তর্ভুক্ত শ্রীহট্ট বা সিলেটের করিমগঞ্জে একটি বাঙালি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলী।মাতা ছিলেন আমতুল মান্নান খাতুন। রাবেয়া খাতুন ছিলেন তাঁর জীবনসঙ্গী। প্রসঙ্গত তাঁর পিতা ছিলেন সাব রেজিস্ট্রার। তাঁর পৈতৃক ভিটা হলো মৌলভীবাজার এবং পৈতৃক নিবাস ছিল হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার উত্তর সূর গ্ৰাম। চাকরিসূত্রে পিতার কর্মস্থল পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের পর সিলেট সরকারি উচ্চ পাইলট বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর তিনি ১৯২১খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষানিকেতনে ভর্তি হন। এখান থেকে তিনি বি এ ডিগ্ৰি অর্জন করেন। এরপর আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্জন করেন। অতঃপর দর্শন শাস্ত্র পড়ার জন্য উইলহেম হামরোল্ট স্কলারশীপ নিয়ে জার্মানির বর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং সেখান থেকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে পি এইচ ডি ডিগ্ৰি অর্জন করেন। ১৯৩৪খ্রি: থেকে ১৯৩৫ খ্রি: মিশরের কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। শিক্ষা শেষে কাবুলের শিক্ষা দপ্তরে অধ্যাপনা করেন। বরোদা কলেজে অধ্যাপনা করার পর দিল্লি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন ১৯৪৯ সালে। অতঃপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের খন্ডকালীন প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পঞ্চাশের দশকের কিছুদিন আকাশবাণীর স্টেশনে ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন - পাটনা,কটক, কলকাতা এবং দিল্লিতে। ১৯৬১ খ্রি: বিশ্বভারতীতে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের রিডার হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৫ খ্রি: অবসর গ্রহণ করেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর মাতৃভাষা ছিল বাংলা এবং সিলেট। তবে তিনি ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান,আরবি,ফার্সি, হিন্দি, সংস্কৃত, মারাঠি, গুজরাটি সহ বিভিন্ন ভাষা আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জ্ঞানার্জনের তাগিদ তিনি একাধিক ভাষা আয়ত্ত করেন। প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন জ্ঞানপিপাসু। অনেকগুলো ভাষা জানায় ভাষাবোধ সম্পর্কে প্রগাঢ় জ্ঞান ছিল তাঁর। ছিল সূক্ষ রসবোধ ও। অন্যদিকে শ্লোক ও রুপকের যথার্থ ব্যাবহারের কারনে তাঁর রচনা হয়ে উঠেছিল অতুলনীয়। বাংলা সাহিত্যের সরস রচনায় তিনি এক নবদিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস গুলো হলো অবিশ্বাস্য,শবনম,শহর ইয়ার, তুলনাহীন। তাঁর ভ্রমণকাহিনী হলো দেশে বিদেশে, জলে ডাঙ্গায়, ভবঘুরে, মুসাফির, বিদেশে। চাচা কাহিনী,পঞ্চতন্ত্র, ময়ূর কন্ঠি, চতুরঙ্গ, বড়বাবু, সত্যপীরের কলমে প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য রম্যরচনা। এছাড়াও তিনি ধূপছায়া,রাজা উজির,কত না অশ্রুজল প্রভৃতি প্রবন্ধ সর্বোপরি দিন লিপি, শান্তি নিকেতন প্রভৃতি আত্মজীবনী লিখছেন। তিনি অনুবাদ করেছেন প্রেম ও হিটলার। তিনি সাহিত্যে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন ‘ নরসিংহ দান ‘ ‘আনন্দ’ পুরস্কার ও ‘ একশে পদক (মরণোত্তর )। তিনি ১৯৭৪ খ্রি: ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরলোকগমন করেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর সাহিত্য কর্ম থেকে নেওয়া অংশগুলো বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা রাজ্যের স্কুলস্তর, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক স্তরের বাংলা সাহিত্যের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। তিনি ছিলেন আজীবন সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। তিনি নিজেকে বলতেন বিশ্ব নাগরিক, যার প্রমাণ তাঁর লেখাতেই উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক চেতনায় সমৃদ্ধ এই লেখকের বিশ্ব মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, এবং অনুকরণীয় রচনাশৈলী তাঁকে সম্মানের অধিকারী করেছে। তদুপরি তিনি যে নৈপুণ্যের সাথে বিদেশি চরিত্র তথা আবহ বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে আনয়ন করেছেন তাও অতুলনীয়। তাঁর ভ্রমণকালীন রচনা গুলোর মাঝে যেন পাঠক গণ খুঁজে পান অত্যান্ত সূক্ষ রসবোধ ও দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব চিত্র। তাই তাঁর বিখ্যাত উক্তি ‘ বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না ‘ আজও পাঠক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct