রাম মনোহর লোহিয়া তাঁর কালজয়ী লেখা “হিন্দু বনাম হিন্দু”-তে ভারতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং হিন্দু সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বিধাদ্বন্দের উল্লেখ করেছেন। ২২ জানুয়ারির ঘটনার পরে, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বোঝেন এবং উদ্বিগ্ন প্রত্যেক নাগরিকের লোহিয়ার কথা মনে করা উচিত। মনে করার আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ, প্রধানমন্ত্রী মোদী মাঝে মধ্যেই রাম মনোহর লোহিয়াকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। লোহিয়ার মতে, “ভারতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ- হিন্দু ধর্মে উদারতা এবং মৌলবাদের মধ্যে লড়াই, যা পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে।” তাঁর উপলব্ধিতে, হিন্দুধর্মের মধ্যে এই অর্ন্তদ্বন্দ্বকে পর্যবেক্ষণ করলে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে বোঝা যায়। যখন একজন হিন্দু উদার হয় তখন দেশ স্থিতিশীলতা অর্জন করে, দেশের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক শক্তি প্রসারিত হয়। কিন্তু যখনই কোনও মৌলবাদী দল জয়ী হয়েছে, ভারতের রাষ্ট্রীয় শক্তি দুর্বল হয়েছে, দেশ ভাগ হয়েছে এবং পরাজিত হয়েছে। এখানে, উদারপন্থী এবং ধর্মান্ধ বলতে লোহিয়া শুধু উদারতা বা অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি ধর্মান্ধতার কথা বলেননি। বরং এর চারটি মাত্রা গণনা করেছেন: বর্ণ ও বর্ণের উপর ভিত্তি করে বৈষম্য, নারী ও পুরুষের মধ্যে অসমতা, জন্মের ভিত্তিতে সম্পত্তির অধিকারের স্বীকৃতি এবং ধর্মের মধ্যে সহিষ্ণুতা। লোহিয়ার মতে, হিন্দু-মুসলিম প্রশ্নে উদারতা অন্য তিনটি মাত্রার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর ভাষায়: “আজকাল উদারপন্থী ও মৌলবাদী হিন্দুদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বাহ্যিক রূপ মুসলমানদের প্রতি কী মনোভাব নেওয়া উচিত, তাতে পরিণত হয়েছে। এক মুহুর্তের জন্যও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে এটি আসলে বাহ্যিক রূপ। মৌলিক সংঘাত, যা এখনও সমাধান হয়নি সেটাই অনেক বেশি সিদ্ধান্তমূলক।” এর অর্থ, যাকে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে লড়াই হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে তার মূলে রয়েছে হিন্দু ও হিন্দুদের মধ্যেকার সংঘর্ষ।
লোহিয়া তাঁর এই নিবন্ধে সমগ্র ভারতীয় ইতিহাস ব্যাখ্যা করেননি। বুঝতে হলে আমাদের তার ধারণার ইতিহাস চক্র সম্পর্কে বুঝতে হবে তাকাতে হবে। কিন্তু আধুনিক সময়ের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লোহিয়া মনে করিয়ে দেন যে আমাদের সময়ে যদি কেউ হিন্দু হয়ে থেকে থাকেন, তিনি ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ঠিক এই কারণেই, মৌলবাদী হিন্দুদের চোখে গান্ধী এক অস্বস্তির কারণ, ভয়ের কারণ। লোহিয়ার দৃষ্টিতে গান্ধী হত্যা, উদারপন্থী ও মৌলবাদী হিন্দুদের মধ্যে চলমান ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের মোড় ঘোরানো ঘটনা। আমাদের সময়ে, “উদারপন্থী এবং মৌলবাদী হিন্দুধর্মের লড়াই অত্যন্ত জটিল পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। এবং সম্ভবত এর শেষ দেখা যাচ্ছে। মৌলবাদী হিন্দুরা সফল হলে, তাদের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, হিন্দু-মুসলিমই শুধু নয়, বর্ণ ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও তারা ভারতকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। অর্থাৎ ভারতের ঐক্য ও অখণ্ডতার যদি সবচেয়ে বড় কোনও ক্ষতিকারক দিক থেকে থাকে তা হিন্দু মৌলবাদীদের তরফ থেকেই থাকবে। তাদের চিন্তা ও উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, আন্তরিকভাবে তারা যতই নিজের চোখে দেশকে শক্তিশালী করুক, এর পরিণতি হবে দেশের ঐক্য ভেঙে ফেলা।তাঁর বক্তব্য বোঝার ক্ষেত্রে যাতে সন্দেহের অবকাশ না থাকে, তাই তিনি স্পষ্টভাবে বলেন: “কেবল উদার হিন্দুরাই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অতএব, পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময়ের সংগ্রাম এখন একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায় এবং এক রাষ্ট্র গঠনের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এখন ভারতের জনগণের অস্তিত্বই নির্ভর করছে হিন্দুধর্মের ধর্মান্ধতা না হিন্দুধর্মের উদারনীতি – কার জিত হয় তার ওপর।”অযোধ্যায় রাম মন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে দেশজুড়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানকে এই প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত। অবশ্যই, লক্ষ লক্ষ সাধারণ ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের জন্য, এই প্রাণপ্রতিষ্ঠা ছিল তাদের দেবতার বিশাল মন্দির নির্মাণের এক বিশেষ উৎসব। তাদের অধিকাংশের মনেই হয়তো কোনও ধর্মান্ধতা ছিল না। কিন্তু এর সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষকদের রাজনৈতিক প্রভাব সন্দেহের কোনও অবকাশ রাখে না। আমাদের বলা হচ্ছে যে এটি হিন্দু সমাজের একটি উদযাপন যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার হারিয়ে যাওয়া পরিচয় ফিরে পেয়েছে। বলা হচ্ছে, এক হাজার বছরের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে হিন্দুরা এখন একটি শক্তিশালী সম্প্রদায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, নতুন রাষ্ট্রীয় চেতনার উত্থান হিসেবে দেখা হচ্ছে। এসব দাবির সত্যতা যাচাই করার কোনও সুযোগ নেই। তবে এই জয় সত্যি কি না তা ইতিহাসই বলবে। প্রাথমিক ভাবে, হিন্দুধর্মকে একটি বিদেশী ধর্মের ছাঁচে ফেলার প্রচেষ্টা বলে মনে হলেও, ধর্মের বিজয়ের পরিবর্তে এটি ধর্মের উপর ক্ষমতার জয় বলেই প্রতীয়মান হয়। যাই হোক না কেন, এটা স্পষ্ট যে জয়ের এই স্লোগানের সঙ্গে সহনশীলতার কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে না। ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই বিজয় উৎসবে পুরুষতন্ত্র, ব্রাহ্মণ্যবাদী জাত আধিপত্য ও পুঁজির খেলা আর লুকিয়ে নেই। সবটাই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। লোহিয়ার ইতিহাসের আলোকে ২২ জানুয়ারির ঘটনা নিঃসন্দেহে উদার হিন্দুদের ওপর মৌলবাদের বিজয়। এমতাবস্থায় লোহিয়ার মতো একজন ঐতিহাসিকের সতর্কবার্তাকে হালকাভাবে নেওয়া যায় না। ভারতীয় জাতির ঐক্য ও অখণ্ডতা সম্পর্কে চিন্তা করেন ও বোঝেন এমন প্রত্যেক ভারতীয়র উদার হিন্দুত্ববাদ রক্ষা করাই আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
অনুবাদ: শুভম সেনগুপ্ত
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct