১৯২০ সালে সমগ্র বাংলা জুড়েই শুরু হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক শ্রমিক আন্দোলন। বাংলার হতদরিদ্র শ্রমিক এবং মজদুর শ্রেণীর উপর তখন চলছিল অকথ্য নির্যাতন। ব্রিটিশ বাহিনী তো বটেই, সেইসময় দেশীয় জোতদার ‘ জমিদার এবং পুঁজিবাদদের অন্যায় অবিচার আর অত্যাচারের ঠেলায় ভীষণভাবে অতিষ্টও হয়ে উঠেছিলেন সকলে। তা নিয়ে আলোকপাত করেছেন ডা. শামসুল হক।
১৯২০ সালে সমগ্ৰ বাংলা জুড়েই শুরু হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক শ্রমিক আন্দোলন। বাংলার হতদরিদ্র শ্রমিক এবং মজদুর শ্রেণীর উপর তখন চলছিল অকথ্য নির্যাতন। ব্রিটিশ বাহিনী তো বটেই, সেইসময় দেশীয় জোতদার ‘ জমিদার এবং পুঁজিবাদদের অন্যায় অবিচার আর অত্যাচারের ঠেলায় ভীষণভাবে অতিষ্টও হয়ে উঠেছিলেন সকলে। অতি নীরবে’ প্রশাসনের সামনেই চলছিল সেইসব কাজকর্ম। প্রশয় পেতে পেতে একটা সময় তো সেটা আবার পৌঁছে গিয়েছিল একেবারে চরম পর্যায়েই। বলা যেতে পারে সেটা সহ্যের সীমাও অতিক্রম করে গিয়েছিল। ফলে আর পেরেও উঠছিলেন না তাঁরা। আর তারই ফলস্বরূপ সংগঠিত হতে শুরু করেন সকলে। পুরুষদের দেখাদেখি নারীরাও যোগ দিতে থাকেন সেই দলে। আবার তাঁদের দেখাদেখি স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রীও নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ হতে শুরু করেন। সকলে মিলেই তখন মিলিত হতেও শুরু করেন একই ছাতার তলায়। পরে কাছাকাছি চটকলের শ্রমিক এবং অন্যান্য কর্মীরাও এসে দাঁড়াতে শুরু করেন তাঁদেরই পাশে। সেইসময় গ্ৰামবাংলার চাষীরা তাঁদের ক্ষেতখামারে ব্যাপকহারে করতেন পাটের চাষ। ফলনও হত খুব ভালো। তাই চারিদিকে গজিয়ে উঠেছিল ছোটবড় অনেক পাটকলও। আর উৎপাদিত পাট চাষীদের ঘর থেকে সোজা চলে যেত সেখানে। তৈরি হত নিত্য প্রয়োজনীয় নানান দ্রব্য সামগ্রীও। ফলে দিনের পর দিন বাড়তে থাকে পাটের চাহিদাও। নতুন উৎসাহে উৎসাহিত হতে থাকেন কৃষক বন্ধুরাও। ঠিক সময় বুঝেই চাষীরাও দাঁড়াতে শুরু করেন সেই একই লাইনে। আর সেইসময়ই তাঁদের দিকে চোখ চলে যায় ইংরেজ সরকারের কর্তাব্যক্তিদেরও। সংগ্ৰামীরা বুঝতেও পেরেছিলেন সবকিছুই। কিন্তু সেইসবের তোয়াক্কা না করেই তাঁরা নিজ সিদ্ধান্তেই অটল থাকেন। সংগঠনকে আরও জোরদার করার জন্য সচেষ্টও হয়ে ওঠেন। তারপর শুরু হয় ধর্মঘট। চলে অনেকদিন পর্যন্তও। ১৯২৪ সালে তার শুরু। চলে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত। কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকার শ্রমিকরা যোগ দিয়েছিলেন সেই ধর্মযুদ্ধে। কলকাতা কর্পোরেশনের শ্রমিক এবং সাধারণ কর্মচারীদের মনেও তখন জন্ম নিয়েছিল নানান ক্ষোভ এবং অসন্তোষও। তাঁদের বেতন ছিল খুবই কম। সেইসময় আবার কোন ছুটিছাটাও পেতেন না তাঁরা। শুধু তাই নয় প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্ৰাচুইটি ইত্যাদি থেকেও বঞ্চিত ছিলেন তাঁরা। ছিল না চাকরীর কোন স্থায়িত্বও। ফলে সেখানকার দিনমজুর থেকে শুরু করে ঝাড়ুদার’ মেথর অথবা গাড়োয়ান সকলেই সেই ধর্মঘটে সামিল হয়ে এক অনন্য নজির সৃষ্টিও করেছিলেন। সেদিনের সেই ধর্মঘটে মোট আঠারো হাজার মানুষ যোগ দিয়ে নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টিও করেছিলেন।কলকাতা কর্পোরেশনের সব শ্রেণীর কর্মীরা একসঙ্গে সেই ধর্মঘট শুরু করেছিলেন ১৯৪০ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখ থেকে। পার্কসার্কাস’ এন্টালি’ মৌলালী, বেগবাগান ইত্যাদি স্থানের হাজার হাজার সংগ্ৰামী মানুষজন তখন একজোট হয়ে কলকাতা কর্পোরেশনের সামনে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁদের সেদিনের সেই জেহাদ ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল বেতন বৃদ্ধি সহ নিজেদের চাকরির স্থায়িত্ব এবং অন্যান্য সব সুযোগ সুবিধাও পাওয়া। বিক্ষোভ চলতে থাকে। ওদিকে প্রশাসনের কর্তারাও হাত গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকেননি। শুরু হয় দমন পীড়নের নীতি। ব্রিটিশ সরকারের চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী বিশাল পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ধর্মঘটী লোকজনের উপর। তার সঙ্গে আবার যোগ দেয় স্থানীয় জোতদার জমিদারের পোষা গুণ্ডাবাহিনীও। চলে লাঠি এবং পরে এলোপাতাড়ি গুলিও।
সেইসময় সাকিনা মুয়াজুদা ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলর। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতেই তিনি তখন সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করছিলেন। আর সেই অত্যাচারের মাত্রা যখন একেবারে চরম পর্যায়েই পৌঁছে গিয়েছিল তখন আর চুপচাপ বসে থাকাও সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। সোজা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সংগ্ৰামেরই সেই মহাস্রোতে। নেতৃত্ব দিতেও শুরু করেছিলেন একবারে সামনে দাঁড়িয়েই। আর সেটা দেখে কর্পোরেশনের মেয়র এবং অন্য আরও অনেক কাউন্সিলররাও একেবারে নতুন উদ্যমেই কাজে নেমে পড়েন। এতদিন তাঁরা কেবলমাত্র চাকরির ভয়েই সব অন্যায় মুখবুজেই সহ্য করছিলেন। সাকিনাকে কাছে পেয়ে কেটে গিয়েছিল তাঁদের সব শঙ্কা। তাঁরাও তখন জোটবদ্ধ হয়েই দাঁড়িয়েছিলেন সেই সংগ্ৰামী মহিলার পাশে। সকলকে নিয়েই তখন একটা অস্থায়ী কমিটিও গঠন করেন সাকিনা মুয়াজুদা। সকলে মিলে বাড়াতে থাকেন সদস্য সংখ্যাও। তারপর অধীর আগ্রহে তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন যদি সরকারের চোখ খোলে তারই আশায়। কিন্তু দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরও কোন সুসংবাদই তাঁরা পাননি। ব্রিটিশ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তাঁদের নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকারই ব্রত নেন। সাকিনা বুঝে যান সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না। তাই অন্য উপায়ের সন্ধানেই তিনি সকলকে নিয়ে বিশেষ বৈঠকেরও ডাক দেন। আর সেজন্য যে পৃথক একটা দপ্তর খোলারও প্রয়োজন ‘ বুঝলেন সেটাও। অসহায় শ্রমিকদের নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষার তাগিদেই অবশ্য তাঁর সেই বিশেষ সিদ্ধান্ত নেওয়া। কিন্তু কোথায় মিলবে সেই স্থান ? দরিদ্রদের নিয়েই তো তাঁর সেদিনের সেই মহাজোট। হতে টাকাপয়সাও কম। অনেক চিন্তাভাবনার পর সাকিনা পার্কসার্কাসে তাঁর নিজের বাড়ির দরজাই উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন অসহায় শ্রমিকদের দুর্দশার কথা ভেবেই। সেখানেই চলে শলাপরামর্শ এবং সকলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪০ সালের ২৬ শেষ আগষ্ট সাময়িকভাবে বিঘ্নিত হওয়া প্রতিবাদের ঝড় আবারও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। পুলিশও সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেই মুহূর্তে তাদের মূল শত্রু অবশ্য হয়ে উঠেছিলেন সাকিনাই। অনেক টাল বাহানার পর একসময় তাঁকে গ্ৰেপ্তারও করা হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই অবশ্য ছাড়াও পেয়ে যান তিনি। প্রশাসন তখন বুঝেও গিয়েছিল যে বিদ্রোহিনী সেই মহিলাকে এইভাবে আটকে রাখা যাবে না। তাই অন্য কৌশল অবলম্বন করতে হবে। হলও তাই নানান ছল চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে শেষে কলকাতা ছাড়াই করা হল তাঁকে। যড়যন্ত্রের শিকার হয়েই কলকাতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সাকিনা মুয়াজুদা। পিছনে পড়ে রয়েছিল সেই শহরের তাঁর অতীত দিনের সমস্ত স্মৃতি এবং অতি অবশ্যই উজ্জ্বল ইতিহাসও। তিনি হলেন সেই মহিলা’ যিনি হলেন সমগ্ৰ বাংলারই প্রথম মহিলা অ্যাডভোকেট। প্রথম আইনজীবী হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসাও শুরু করেন। জানতেন অনেক ভাষাও। বাংলা’ ইংরাজী ছাড়াও উর্দ্দু’ আরবি, হিন্দী’ ফারসির উপরও দখল ছিল তাঁর। কলকাতা থেকে বাংলা এবং ইংরাজীতে প্রকাশিত দুটি পত্রিকা সম্পাদনাও করেছেন তিনি। সাহিত্যের প্রতিও ছিল প্রবল আস্থা। ১৮৯২ সালে জন্ম তাঁর কলকাতায়। উচ্চ শিক্ষিতাও। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। এই শহরেরই খ্যাতনামা আই . সি . এস অফিসার মোরসাজিদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধও হন। কিন্তু সেই বিয়ে খুব বেশি দিন টেকেনি। শেষ পর্যন্ত পার্কসার্কাসের পিতৃগৃহই হয়ে ওঠে তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। আর সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর যাবতীয় সংগ্ৰামও। ১৯৪৭ সালে তাঁর মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত কৃষক’ মুটে’ মজুদুর সহ সমাজের দলিত এবং অবহেলিত মানুষদের জন্যই চলেছিল তাঁর সেই আপোসহীন সংগ্ৰামও।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct