অযোধ্যায় রাম মন্দিরে ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’র দিন ঘোষণা হওয়ার অনেক আগে থেকেই রাজনৈতিক মহলে আলোচনা ছিল যে এমন ভাবে দিন নির্ধারণ করা হবে, যা থেকে কয়েক মাস পরের লোকসভা নির্বাচনে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে বিজেপি। অযোধ্যার অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও করা হয়েছিল এমন ভাবে যাতে নির্বাচনে বিজেপির প্রধান মুখ - নরেন্দ্র মোদীর একার ওপরেই সম্পূর্ণ ফোকাসটা থাকে। লিখেছেন অমিতাভ ভট্টশালী।
যোধ্যায় রাম মন্দিরে ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’র দিন ঘোষণা হওয়ার অনেক আগে থেকেই রাজনৈতিক মহলে আলোচনা ছিল যে এমন ভাবে দিন নির্ধারণ করা হবে, যা থেকে কয়েক মাস পরের লোকসভা নির্বাচনে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে বিজেপি।অযোধ্যার অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও করা হয়েছিল এমন ভাবে যাতে নির্বাচনে বিজেপির প্রধান মুখ - নরেন্দ্র মোদীর একার ওপরেই সম্পূর্ণ ফোকাসটা থাকে।অযোধ্যায় ওই অনুষ্ঠানের খবর জোগাড় করতে সেখানে গেছেন যেসব সাংবাদিক, তারা বলছেন শহর যেমন মুড়ে ফেলা হয়েছিল রামচন্দ্রের কাটআউট দিয়ে, সংখ্যায় গুনলে তার প্রায় সম সংখ্যক কাট আউট লাগানো হয়েছিলে নরেন্দ্র মোদীর।আবার রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি বা সরকারের বর্ষীয়ান নেতা-নেত্রী, দলের প্রেসিডেন্ট - এঁরা হাজির থাকলে যাতে মি. মোদীর ওপর থেকে ফোকাস সামান্যও সরে না যায়, তাই মি. মোদী একাই ছিলেন অনুষ্ঠানে।ব্যতিক্রম আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত ও উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।আবার মি. মোদী যে ভাষণ সেখানে দিয়েছেন, সেখানে সরাসরি ভোটের কথা না বললেও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছেন।আর এসব মিলিয়েই বিশ্লেষকরা বলছেন ভোটের আগে রাজনৈতিক লাভ যে ঘরে তুলতেই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল তাতে কোনও সন্দেহই নেই।
রাম-রথ থেকে রাম মন্দির
গত শতাব্দীর আটের দশকে বিজেপি গঠিত হওয়ার পর থেকেই তাদের এজেণ্ডায় অযোধ্যায় রামমন্দির গড়ার প্রতিশ্রুতি থেকেছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তারা সক্রিয় হয় ১৯৮৯ সালের পর থেকে। লাল কৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্বে রথযাত্রা শুরু হয় ১৯৯০ সালে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অবশ্য আরও কিছুদিন আগে থেকেই রাম মন্দির নিয়ে সরব হচ্ছিল। দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে যে রাজনৈতিক দলটি এই ইস্যুতে সরব হয়ে থেকেছে, শেষমেশ যখন তা অর্জন করা গেল, তা থেকে রাজনৈতিক দল হিসাবে লাভ যদি ঘরে আসে, তাতে সমস্যার কিছু দেখছেন না বিজেপি নেতারা।এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যেমন বিবিসি বাংলাকে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন, “রাজনৈতিক লাভ তুলে ঠিকই তো করছি আমরা।”বাংলা নিউজ পোর্টাল দ্য ওয়ালের কার্যকরী সম্পাদক অমল সরকার অযোধ্যাতেই আছেন। তিনি বলছিলেন, “রাম মন্দির ইস্যু থেকে বিজেপি তো রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবেই। তাদের যে মূল প্রতিশ্রুতিগুলো ছিল, কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ, তিন তালাক প্রথার বিলোপ, রাম মন্দির নির্মাণ আর অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে আসা - এর মধ্যে প্রায় সবগুলোই তো তারা পূরণ করে দিল। তাই তাদের রাজনীতিতে এগুলোকে তো তারা ব্যবহার করবে।”আরেক বিজেপি নেতা, অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ ব্যাখ্যা করছিলেন, “যে আন্দোলনের পুরোভাগে লাল কৃষ্ণ আদভানি থেকেছেন, বিজেপির সব স্তরের নেতারা থেকেছেন, সেটা এত দিনে অর্জন করা গেছে। আমরা সেই আন্দোলন কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে করিনি। যে মন্দির প্রতিষ্ঠার আবেগ ছিল মানুষের মধ্যে, আমরাও কোটি কোটি মানুষের সেই আবেগকে পূর্ণ মর্যাদা দিতে এবং ভারতের অস্মিতাকে মর্যাদা দিতে এটা করেছি।”
ভোট ধরে রাখতে সচেষ্ট বিজেপি?
“এ থেকে যদি আমাদের রাজনৈতিক সুবিধা হয়, হয়ে যেতেই পারে, তাহলে আমাদের তো কিছু করার নেই,” বলছিলেন মি. নন্দ।রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বলছিলেন, “রাম মন্দির নিয়ে মানুষের আবেগ যে আছে, বিশেষত হিন্দি বলয়ে সেটা ঘটনা। একাধিক সমীক্ষায় এটা উঠে এসেছে যে এমন বহু মানুষও রাম মন্দির চেয়েছেন যারা বিজেপিকে ভোটও দেন না।”“তাই রাম মন্দিরের আবেগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিজেপি যে কাজে লাগাবে, তা খুব আশ্চর্যের কিছু নয়। হিন্দি বলয়ে যে অবস্থা এখন বিজেপির ভোট শেয়ারের, তাতে সেই ভোট ধরে রাখতে হবে বিজেপিকে। কারণ দক্ষিণ ভারতে কিন্তু বিজেপির অবস্থা কিছুটা নড়বড়ে।”“হিন্দি বলয়ের নানা রাজ্যে আবার বিরোধী দলগুলোও কিন্তু কিছুটা শক্তিশালী। তাই লোকসভা নির্বাচনে জিততে হিন্দি বলয়ের ভোট বাড়াতে না পারুক, ধরে রাখা বিজেপির জন্য জরুরি। তাই ওই অঞ্চলের মানুষের আবেগকে তারা কাজে লাগাচ্ছে,” বলছিলেন মি. মৈত্র।নরম হিন্দুত্বের পথে কংগ্রেস?যেদিন প্রধানমন্ত্রী অযোধ্যায় রামচন্দ্রের মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছেন, সেখানে হাজির ছিলেন না বিরোধী দলগুলির কোনও নেতা-নেত্রী। তবে রাম মন্দির এবং তাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের যে আবেগ রয়েছে, তা বিলক্ষণ বোঝেন তারা।সেজন্য অযোধ্যায় না গেলেও মধ্য প্রদেশ কংগ্রেস সদর দপ্তরে হোর্ডিং দিয়ে মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় যে রাজীব গান্ধীর আমলেই অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেওয়া হয়েছিল।আবার হিমাচল প্রদেশের কংগ্রেস সরকার অন্য সব বিজেপি শাসিত রাজ্যের মতোই ২২শে জানুয়ারি আধা দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছিল।রাহুল গান্ধী আসামে এক মন্দিরে গিয়ে পুজো দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।কংগ্রেস নেতৃত্ব অবশ্য বলছে যে তারা কখনই তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির সঙ্গে আপোষ করেন নি।প্রাক্তন সংসদ সদস্য ও কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথায়, “কংগ্রেস কখনওই নেতা বা সদস্যদের বলেনি যে অযোধ্যায় যেও না। আমরা সবাই তো বিভিন্ন পুজোতে অংশ নিই ব্যক্তিগত ভাবে। কিন্তু আমরা সেটাকে রাজনীতির সঙ্গে মেশাই না। এটাই কংগ্রেসের নীতি, এটাই কংগ্রেসের চরিত্র। এর সঙ্গে কখনই আপোষ করি না আমরা। উল্টোদিকে বিজেপি কিন্তু ঠিক সেটাই করছে।”
বিবিসি বাংলায় অন্যান্য খবর
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সমকামিতা ও ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ক বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক, যা জানা যাচ্ছে ২৪ জানুয়ারি ২০২৪মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানি বন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্রের ১২ সেনেটরের চিঠি২৩ জানুয়ারি ২০২৪যশোর সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে বিজিবি সদস্য নিহত২৩ জানুয়ারি ২০২৪কংগ্রেস ‘খুব দেরি করে ফেলেছে’তবে কংগ্রেস নেতাদের মন্দিরে মন্দিরে যাওয়া, ঘটা করে পুজো করা, হিমাচল প্রদেশে ২২ জানুয়ারি ছুটি দেওয়া বা কমল নাথের মতো বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতার বড় করে হনুমান পুজো করা এসব নিয়ে দলের সাধারণ সদস্যদের মধ্যে বিভ্রান্তিও যে ছড়াচ্ছে, সেটাও স্বীকার করছে কংগ্রেসেরই একাংশ।দলটির অন্যতম মুখপাত্র কৌস্তভ বাগচি বলছিলেন, “ঠিকই এসব নিয়ে সাধারণ কর্মী আর জনগণ তো কিছুটা বিভ্রান্তই। একদিকে নানা মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন্য যাওয়া হবে, কংগ্রেস সরকার ২২ তারিখ ছুটি দেবে আবার বিজেপির বিরোধিতা করব - এরকমটা তো হওয়া উচিত ছিল না।”বিজেপিও কংগ্রেস নেতাদের একাংশের এই কথিত ‘নরম হিন্দুত্ব’ নীতি নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না।অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ বলছিলেন, “এখন ওরা এসব করছে - রাহুল গান্ধী পৈতে ধারণ করে মন্দিরে চলে যাচ্ছেন, পুজো দিচ্ছেন, অন্যান্য নেতারাও নানা পুজো অর্চনার আয়োজন করছেন। তবে খুব দেরি করে ফেলেছে ওরা। এখন এসব করে হিন্দু ভোট নিয়ে আর কিছুই করতে পারবে না ওরা।”আক্ষরিক অর্থে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্য কোনও রাজ্যেই রাস্তায় নেমে কোনও প্রতিবাদ করেননি বিরোধী দলীয় নেতা নেত্রীরা।পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী এক সর্বধর্ম পদযাত্রা করেছেন, যাত্রাপথে মন্দির, মসজিদ, গির্জা আর গুরদোয়ারায় গেছেন সব ধর্মের প্রতি সম্মান জানাতে।বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বলছিলেন যে এতেই দেখা যাচ্ছে যে কেউই কিন্তু ধর্মটাকে বাদ দিয়ে রাজনীতি করতে পারছেন না।“ভারতীয় রাজনীতিতে এই একটা বড় পরিবর্তন এনেছে বিজেপি। কোনও দলই ধর্ম বাদ দিয়ে রাজনীতি করতে পারছে না। অথচ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রটা তো সেকুলার।”
সৌজন্যে: বিবিসি বাংলা
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct