এম মেহেদী সানি, কলকাতা, আপনজন: রাম মন্দিরের উদ্বোধনের দিন শহরে সংহতি মিছিল করার ঘোষণা আগেই করেছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মতো সোমবার অযোধ্যায় মন্দির উদ্বোধনের দিন সংহতি মিছিলে পা মেলালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিয়ে হাজরা থেকে সংহতি মিছিল হয় মমতার নেতৃত্বে। সেই মিছিলে ছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাস, বাবুল সুপ্রিয়, সুজিত বোস, জাভেদ আহমেদ খান সহ তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা। ছিলেন নাখোদা মসজিদের ইমাম মাওলানা শফিক কাসেমি সহ বিভিন্ন ধর্মবেত্তারা। মিছিলে লোক সমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো। হাজরা থেকে মিছিল শুরু হয়ে বালিগঞ্জ ফাঁিড় হয়ে পার্কাসার্কাসে যায়। মিছিলের যাত্রাপথে যে কটি মন্দির, মসজিদ, গির্জা ছিল, সেগুলিতে যান মমতা।
মিছিলের পর পার্কসার্কাসে এক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।সমাবেশে বক্তব্য রাখার সময় তৃণমূল নেত্রী মমতার কথায় উঠে এল বাবরি মসজিদ ভাঙার সময়ের কথা । তিনি বলেন, ‘তখন রাস্তায় কেউ ছিল না । আমি একা বেরিয়েছিলাম । জ্যোতি বসুর কাছে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, কোনও প্রয়োজন থাকলে বলুন ।’ তৃণমূল নেত্রী বলেন, সেদিন পাম এভিনিউ, পার্ক সার্কাস-সহ শহরের বিভিন্ন জায়গা ‘জ্বলছিল’। কিন্তু সেই পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছেন বলে জানান মমতা । এদিন সংহতি যাত্রা শেষে সেই সময়ের কথা মনে করিয়ে মমতা বলেন, “তখনও আমি সাহস হারাইনি। আমি রাতভর পাহারা দিয়েছি। একদিন শুধু দেখেছি, মাদার টেরেসা লোরেটো ডে হাউজে ছিলেন । সেদিন তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ।” ওই সমাবেশ তৃণমূলের জাতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারকে টার্গেট করে বলেন, ‘২০১৯ সালের পর থেকে বাংলা লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত, শোষিত হয়ে রয়েছে তার কারণ একটি রাজনৈতিক দল গাজোয়ারি করেও বাংলায় জিততে পারেনি । সে জন্য বাংলায় একশো দিনের কাজ প্রকল্পে টাকা বন্ধ, রাস্তার টাকা বন্ধ, আবাসের টাকা বন্ধ করে রেখেছে । কিন্তু গত ৫ বছরে বাংলা থেকে ৪ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকার তুলে নিয়ে গেছে ।’ ।মমতা লোকসভা নির্বাচনের আগে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টার জন্য বিজেপির সমালোচনা করেন। ভগবান রাম সম্পর্কে দেবী সীতাকে তাদের বক্তৃতা থেকে “বাদ দেওয়ার” জন্য গেরুয়া শিবিরকে “নারীবিরোধী” বলে অভিহিত করেন। অযোধ্যায় রাম মন্দির অভিষেকের সঙ্গে মিলে যাওয়া তৃণমূলের ‘সংহতি সমাবেশ’-এর নেতৃত্ব দেওয়ার সময় দলের প্রধান দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অন্তর্ভুক্তির নীতি রক্ষায় বাংলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমি নির্বাচনের আগে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করায় বিশ্বাস করি না। আমি এ ধরনের প্রথার বিরুদ্ধে। ভগবান রামের যাঁরা পুজো করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আমার কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু মানুষের খাদ্যাভ্যাসে হস্তক্ষেপে আমার আপত্তি রয়েছে।
তিনি বলেন, যত দিন তৃণমূল সরকার থাকবে, তত দিন আমি এই রাজ্যে ধর্ম নিয়ে বিভাজন হতে দেব না। আমরা সবাই একসঙ্গে থাকব। থাকব সব ধর্মের মানুষদের নিয়ে। মমতা বলেন, ওরা (বিজেপি) ভগবান রামের কথা বলে, কিন্তু দেবী সীতার কী হবে? সীতা না হলে রাম হত না। ভগবান রামের বনবাসের সময় সীতা তাঁর সাথে ছিলেন। তারা নারীবিদ্বেষী বলে তার সম্পর্কে কথা বলেন না। আমরা দেবী দুর্গার উপাসক, তাই ওঁরা যেন আমাদের ধর্ম নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার চেষ্টা না করেন।মমতা বলেন, ভোটের নামে দেশটাকে বিক্রি করছে এক শ্রেণির লোক। ভোটের আগে ধর্মে উসকানি দেওয়া হচ্ছে। বিজেপি-কে নিশানা করে মমতা বলেন আগুন জ্বালানো সহজ, কিন্তু তা নেভানো সহজ নয়। বিজেপির সরাসরি নাম না করে বলেন ভোট কাছাকাছি এলে একটা দল দেশকে বিক্রি করে দিয়ে চলে যায়। আমার লজ্জা লাগে। তিনি বলেন, আমার পরিবারকে জড়িয়ে নানা কথা বলা হচ্ছে। আমরা নাকি চোর। বিজেপি তো বড় চোর। আমরা কাউকে ভয় পাই না। আমরা কাপুরুষ নই, একাই লড়াই করব। কে কী খাবে, কে কী পোশাক পরবে, সব একটা দল ঠিক করে দেবে। এটা মানা যায় না। তাই সংহতি মঞ্চ থেকে সোমবার তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফের বিজেপিকে হঠানোর ডাক দেন। তিনি বলেন, বিজেপিকে লড়াইয়ের এক ইঞ্চি জমি ছাড়ব না। করব, লড়ব, জিতব। মমতার অঙ্গীকার বিজেপিকে বাংলা থেকে একটি আসনেও জিততে দেব না। আর বাংলাই সারা দেশকে আগামী দিনেরপথ দেখাবে। বাংলা আজ যা বলবে, সারা দেশ কাল তা বলবে। এই মঞ্চ থেকে তিনি বিজেপি বিরোধী ইন্ডিয়া জোটকেও আক্রমণ করেন। অভিযোগ তোলেন ইন্ডয়অ জোটকে নিয়ন্ত্রণ করছে সিপিএম।। এ প্রসঙ্গে মমতা বলেন, ইন্ডিয়া জোটের নামকরণ করেছি আমি। অথচ এখন দেখছি, ইন্ডিয়া জোট যত মিটিং করছে তার প্রায় সিংহভাগ মিটিংয়ের বৈঠক নিয়ন্ত্রণ করছে সিপিএম। এটা কোনমতেই মেনে নেওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেন তৃণমূল সুপ্রিমো। আমি তা মানব না। মমতার আরও অভিযোগ, ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে আমাদের তেমনভাবে সম্মান দেওয়া হয় না। মমতার দাবি, তৃণমূলের ক্ষমতা আছে বলেই আমি বিজেপির সাথে লড়াই করছি। তবে, ইন্ডিয়া জোট নিয়ে এদিনও অধীরের নাম কারে তাকে নিশানা করে মমতা বলেন, ইন্ডিয়া জোটেকিছু কিছু মানুষ আছেন যারা আসন সমঝোতা নিয়ে আমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করে চলেছে।অভিষেক বলেন, ‘আমরা ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করি না । আমরা বিশ্বাস করি বৈচিত্রের মধ্যে একতার মন্ত্রে । আমরা বিশ্বাস করি ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখো মিলন ও মহান’-এটাই আমাদের মহান ভারতবর্ষ ।’ তিনি বলেন, একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যখন অস্ত্রের ঝনঝনানি, চোখ রাঙানি চলছে, তখন আমার শহর আমার রাজ্যে ধর্ম, বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে লক্ষাধিক মানুষ পায়ে পা মিলিয়ে বাংলায় একতা, বাংলায় সম্প্রীতি, সংহতি রক্ষা করেছে। সমাবেশে নাখোদা মসজিদের ইমাম মাওলানা শফিক কাশেমি বলেন, বর্তমানে ভারতে বিদ্বেষ ঝড় উঠেছে, ঘৃণাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, এমন বিদ্বেষ ঝড়ে ভালোবাসার দ্বীপ জ্বালানো যে বাঘিনী তার নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সভা সঞ্চালনা করেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct