তিতুমীরের মহাসংগ্ৰাম ও আগাম যুদ্ধের ভাবনা
ডা. শামসুল হক
উত্তর চব্বিশ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সেইসময় চলছিল কৃষক আন্দোলনের মহাস্রোত। আর সেই সংগ্ৰামের কেন্দ্রভূমি ছিল নারকেলবেড়িয়া নামক ছোট্ট একটা গ্ৰামই। সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল অমর শহীদ তিতুমীরের আসল সংগ্ৰামও। দেশের নিপীড়িত , নিগৃহীত এবং অসহায় কৃষক পরিবারের একেবারে পাশে দাঁড়িয়েই তিনি আবার পরিচালনা করেছিলেন তাঁর নিজস্ব কর্মকাণ্ডও । ১৮৩১ সালে শুরু হয়েছিল যে কৃষক বিদ্রোহের তার স্মৃতিটুকু আঁকড়ে ধরে অন্য আরও অনেক সংগ্ৰামের রথী মহারথীরাও অতি সহজেই খুঁজে পেয়েছিলেন সাফল্যের সঠিক ঠিকানাও । আবার সেদিনের সেই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছিল অজস্র নাটক , উপন্যাস , প্রবন্ধ সহ অনেক কাব্যকথাও । নাট্য সাম্রাজ্যের কিংবদন্তি স্রষ্টা উৎপল দত্ত সেই অমর শহীদের জীবন কাহিনীর উপর ভিত্তি করেই লিখেছিলেন সময়োপযোগী তেমনই একটা নাটক যা মঞ্চে এমনই সাড়া ফেলে দিয়েছিল যে বিস্মিত হয়েছিলেন স্বয়ং নাট্যকারও। আবার বাংলা কাব্য ও সাহিত্যের খ্যাতনামা লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী , যিনি সাহিত্য একাডেমী , জ্ঞানপীঠ পুরস্কার,পদ্মশ্রী সহ আরও অনেক সন্মানেই সন্মানিত হয়েছিলেন তিনিও এই মানুষটাকে নিয়েই লিখেছিলেন অসাধাণ একটা উপন্যাসও ।
কৃষকদের নানান দাবি দাওয়া নিয়েই সেইসময় শুরু হয়েছিল তিতুমীরের সেই মহাসংগ্ৰাম । তারপর ধীরে ধীরে সমাজের অনেক দলিত এবং নিগৃহীত মানুষের পাশে এসেও দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। দরিদ্র, অশিক্ষিত, অতি সাধারণ মানুষজনদের পাশে পাশে থেকে তিনি তাঁর সংগ্ৰামকে এগিয়ে নিয়ে গেলেও তিনি নিজে কিন্তু ছিলেন অতি অভিজাত একটা পরিবারেরই সন্তান। কৃতী সন্তানও নিশ্চয়ই। একেবারে ছেলেবেলা থেকেই তিনি দাঁড়িয়েও ছিলেন অত্যন্ত মজবুত একটা আর্থিক বুনিয়াদের উপর ভর করেই । ছিলেন উচ্চ শিক্ষিতও । জানতেন বিশ্বের আরও অনেক ভাষাও ধর্মপ্রাণ একজন মানুষ হিসেবেও বিশেষ পরিচয় ছিল তাঁর । মক্কা শরীফেও গিয়েছিলেন হজ করার উদ্দেশ্যেই । নিজেকে শারীরিকভাবে মজবুত রাখার তাগিদেই তিনি আবার নিয়মিতভাবে শরীরচর্চাও চালাতেন । ভর্তি হয়েছিলেন কুস্তীর আখড়াতেও । শিক্ষানবীশ অবস্থাতেই তিনি আবার যোগ দিতেন কুস্তীর নানান প্রতিযোগীতাতেও। আর তাতে দেশের নামীদামী অনেক পালোয়ানদের পরাজিত করে প্রচুর সুনাম অর্জনও করেছিলেন তিনি । নিজ ধর্মের প্রতি তো বটেই , অন্য ধর্মের প্রতিও ছিল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। ধর্মের সব ধরণের গোঁড়ামিকে পরিত্যাগ করেই মানুষকে কাছে ডাকতেন তিনি। তাঁর সেই আহ্বান ছিল একেবারেই অকৃত্রিম এবং পবিত্রতার আবেশেই আবিষ্ট । তাই তো সমাজের সব শ্রেণীর মানুষজনই প্রয়োজন বোধ করলেই ছুটে যেতেন তাঁর কাছে এবং সকলেই এসে দাঁড়াতেন একই ছাতার তলাতেও। আর তাঁদেরই নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়েও পড়েছিলেন সেই মহারণে। ঠিক সেইসময়ই অন্যায়ের বিরুদ্ধেই জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। তখন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসক বাহিনীর শোষণের মাত্রাও আবার পৌঁছে গিয়েছিল সহ্যেরও একেবারে শেষ প্রান্তেই। শুধু কি তাই ? সেইসঙ্গে আবার সংযোজিত হয়েছিল স্বদেশী জমিদার , জোতদার নীল কুঠিয়ালদের অমানুষিক অত্যাচারও । বলাই বাহুল্য, তিতুমীর যখন তাঁর প্রিয় সঙ্গী সাথীদের নিয়ে একটা নির্ভীক ও নিরপেক্ষ ক্ষেত্রের উপর দাঁড়িয়ে ব্রিটিশ সরকারের পোষা দালালদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন , ঠিক তখনই তারাও আবার নিজেদের পিঠ বাঁচাবার তাগিদেই সুদূর বিলেতে ইংরেজ রাজ দরবারে সংগ্ৰামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতেও শুরু করেছিল । শুধু একবার নয় , বারবারে বারেবারেই তারা জামিয়েও তুলেছিল মিথ্যে অভিযোগের রাশি রাশি স্তুপও ।
চর্তুদিকে চোখ,কান খোলাই রাখতেন তিতু। মনটাও স্থির থাকত নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্যেরই প্রতি। কখনও কোন গুজব অথবা গাঁজাখুরি গল্পের প্রতি আকৃষ্টও হননি । ফলে সব ধরণের কাজ অথবা সমস্যার সমাধানও চটপট সেরে নিতে পারতেন তিনি। সকলে সমানভাবে বিশ্বাসও করতেন তাঁকে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটা গ্ৰাম তারাগুনিয়া , টাকী, গোবরা,নুরনগর , ধান্যকুড়িয়া , পোড়া , যদুবাটি , গোবিন্দপুর , হাড়া , নুরনগর ইত্যাদি স্থানের মানুষজনই জাতিধর্ম নির্বিশেষে এসে দাঁড়াতে শুরু করেন তাঁর পাশে। স্থানীয় জোতদার এবং জমিদারের দলও তখন পড়ল মহা সমস্যারই মুখে । এবার না বন্ধ হয়ে যায় তাদের রোজগারের সমস্ত পথও । অতএব এর একটা বিহিত করতেই হবে। কিন্তু কিভাবে ? সোজা পথে যে সেটা সম্ভব নয় সেটাও বুঝতে পেরেছিল তারা । তাই বক্র পথেরই সন্ধানে শলাপরামর্শ শুরু করে দিল সকলে মিলে। শরণাপন্ন হল উপর মহলেরও ।মিলল পথের সন্ধানও। মিলিতভাবেই তারা কুৎসা রটাতে শুরু করল তিতুমীরের বিরুদ্ধে। অভিযোগ দায়ের করল প্রশাসনের কাছেও । একটা সময় শুরু হয়ে গেল সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগও। মোক্ষম সেই ওষুধেও কাজ হচ্ছে না দেখে দেশীয় দালালদের তখন কি করুণ অবস্থা! মাথা ঠাণ্ডা রেখেই ঈপ্সিত লক্ষ্যের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিতুমীর । অবশেষে একেবারে দিনক্ষণ দেখে সকলে মিলে জমায়েত হলেন নারকেলবেড়িয়া গ্ৰামের উন্মুক্ত এক প্রান্তরে । সেটা ১৮৩১ সালের আগস্ট মাসের ১৭ তারিখের ঘটনা । সেখানে তাঁরা নিয়ে নেন অভিনব এক সিদ্ধান্তও । আগাম যুদ্ধেরই প্রস্তুতি হিসেবে তখন তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন উৎকৃষ্ট একটা পথের ঠিকানাও । সকলে মিলে ঠিক করেন সেই জায়গাতেই নির্মিত হবে বাঁশের তৈরি একটা কেল্লা । আর সেটাই হবে তিতুমীরের নিজের এবং তাঁর নির্ভীক বাহিনীর অস্থায়ী একটা ঠিকানাও । স্থাপিত হয়েছিল সেই নির্মাণকার্যও। সব সংবাদ সঠিক সময়ে পৌঁছেও গিয়েছিল ইংরেজ দরবারে । ফলে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয় তাদের পক্ষ থেকেও । এবার নড়েচড়েই বসতে হয় নিকটবর্তী বারাসত মহকুমার জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারকেও। কালবিলম্ব না করেই তিনি সংবাদও পাঠিয়েছিলেন কাছাকাছি থানাতে। প্রয়োজনে বাহিনী সহযোগে তাঁর যেন পাশে এসে দাঁড়ান তেমন নির্দেশও দেন। নভেম্বর মাসের ছয় তারিখে আলেকজান্ডারেরই নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী হাজির হয় নারকেলবেড়িয়া গ্ৰামে । সদলবলে পৌঁছায় বাঁশেরকেল্লার কাছেও । তারপর পরদিন প্রভাতেই শুরু হয় তুমুল লড়াই । সম্পূর্ণ অন্য এক ধরণের যুদ্ধ । বাইরে রণসাজে সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর গুলি বারুদের বিরুদ্ধে ভিতরে থাকা গ্ৰাম্য মানুষের অতি সাধারণ অবলম্বন তীর ধনুক এবং বাঁটুল গুলতির লড়াই। সোজা কথায় বলা যেতে পারে একটা অসম যুদ্ধই । বেলা বাড়তে থাকে । বৃদ্ধি পেতে থাকে রণাঙ্গনের উত্তাপও । অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্য নিলেও তিতুমীরের দুরন্ত লেঠেল বাহিনীর দোর্দণ্ড প্রতাপের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় ইংরেজ বাহিনী। শুরু করে পিছু হটতেও । অবশেষে পরাজিত সেই সেনাবাহিনী অসহায়ের মতো আশ্রয় নেয় গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায়ের বাড়িতে । ব্রিটিশদের পোষা দালাল দেবনাথকে আবার পাশ থেকে মদত দেয় আরও অনেক খয়ের খাঁয়ের দলও ।খবর পৌঁছে যায় বিলেতেও । চাওয়া হয় আরও অনেক সেনা। সঙ্গে বস্তা বোঝাই গোলাবারুদ এবং অত্যাধুনিক কামানও , যার সাহায্যে অস্থায়ী সেই কেল্লা এবং সেইসঙ্গে তার ভেতরে থাকা লেঠেলদের যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়াও সম্ভব হয় অত্যন্ত সহজেই । ঠিক সময়েই নারকেলবেড়িয়া গ্ৰামে হাজির হয় নতুন বাহিনী। সঙ্গে বাংলার তৎকালীন বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিং এবং মেজর জেনারেল স্কট হার্ডিও । ১৯ শে নভেম্বর শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। প্রস্তুত ছিলেন তিতুমীর এবং বাঁশেরকেল্লার বীর বাহিনীও । তাঁর জানতেন এই ধরণের ঘটনা ঘটবেই। তাই অবাক না হয়েই সঙ্গী সাথীদের নিয়ে তিতু নেমে পড়লেন একেবারে সন্মুখ সমরেই। যুদ্ধ চলতেই থাকে । প্রথমেই প্রাণ বিসর্জন দিলেন তিতু পুত্র মির জহর আলি । তারপর একে একে শহীদ হলেন শতাধিক বীরও। কেল্লার ভিতরে তখন করুণ অবস্থা। একের পর এক শোনা যায় শুধুই দুঃসংবাদ। শুরু হয় কান্নার রোল। কিন্তু তবুও যুদ্ধ থামেনি। শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও তাঁরা চালিয়ে যান সেই মরণপন লড়াই। যুদ্ধ শেষ হতে খুব বেশি সময় অবশ্য লাগেনি। একে একে শেষ হয়ে যায় কেল্লার ভিতরে সঞ্চিত সমস্ত উপকরণও । আহত অথবা নিহত হন অধিকাংশ মানুষজনই। ইংরেজদের হাতে বন্দীও হন অনেকেই।কামানের গোলায় নিহত হন তিতুমীরও । তারপর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় পুরো কেল্লাটাই। শেষ হয়ে যায় তিতুমীরের লড়াই।সেজন্য অতি অবশ্যই দায়ী কিছু বিবেকহীন মানুষেরই কালো হাত । সেই সময়ের অধিকাংশ জোতদার , জমিদার অথবা নীলকুঠির মালিকরা কেবলমাত্র ব্যবসার তাগিদেই ভীষণভাবে ভরসা করতেন ইংরেজদের উপর। তাই প্রয়োজনে স্বদেশীয়দের প্রতি সাহায্যের হাতও যে বাড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে সেই বোধটাই কখনও মনে জাগ্ৰত হয়নি কখনও । আর তারই ফলস্বরূপ যে বিলম্বিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধও , সেই বিষয়েও একমত হয়েছেন সর্বকালের সব ধরণের সমালোচকরাও ।কিন্তু ঘটনা যাই ঘটুক না কেন, এই প্রসঙ্গে অন্য আরও একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, সেইসমস্ত জোতদার বা জমিদাররা যা কিছু করতেন তা নিজস্ব স্বার্থরক্ষার তাগিদেই যে করতেন সেটাও সঠিক। কিন্তু আড়ালে আবডালে যে সমস্ত মানুষ অতি গোপনে ইংরেজ দরবারে পৌঁছে দিতেন অতি গুরুত্বপূর্ণ খবর সেটাও কম ক্ষতিকারক নয় । সেটা সত্যি সত্যিই ক্ষমাহীন এক অপরাধও বটে। করণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে বাঁশেরকেল্লার যুদ্ধের প্রথম পর্বে পরাজিত আলেকজান্ডার সাহেব যখন অসহায় অবস্থায় কাদাজলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তখন তাঁকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন নিকটবর্তী কলিঙ্গ গ্ৰামের কয়েকজন মানুষ । মূলতঃ তাঁদের তৎপরতাতেই তখন ডাঙায় ওঠেন আলেকজান্ডার সাহেব। আর সেইসব গ্ৰামবাসীদের সেবাতেই সুস্থও হয়ে ওঠেন তিনি। সেইসময় সেই ধরণের ঘটনা খুব কম ঘটলেও সেটা কিন্তু সংগ্ৰামী মানুষজনদের মনের মধ্যে নানান দ্বিধা এবং দ্বন্দ্বেরও জন্ম দিয়েছিল। তিতুমীর এবং তাঁর মতো নেতাদের চিনতেও অনেক ভুল হয়েছিল। তবে ঘটনা যাই ঘটুক না কেন, শহীদ তিতুমীর আমাদের কাছে অমর হয়েই থাকবেন। তাঁর সেই আপোষহীন সংগ্ৰামই আবার ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল আগামী দিনের সমস্ত সৈনিকদেরও ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct