পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষা প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় বঞ্চনা
তৌহিদ আহমেদ খান
(লেখক শিক্ষক, পালপাড়া গোবিন্দ জীউ হাই স্কুল)
দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার প্রায়শই অভিযোগ করে। সম্প্রতি আসামের হেমন্ত বিশ্ব শর্মার সরকার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মূল উৎপাটন করেছে। আর এস এস তথা বিজেপি সরকারের মূল উদ্দেশ্য মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা। হেমন্ত সরকার তাদের মৌলিক এজেন্ডাকে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয়েছে এবং তারা দেশব্যাপী এই মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায়। এই উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন নিয়োগের পরীক্ষায় মাদ্রাসা পরীক্ষার্থীদের কোনোভাবেই সুযোগ দিতে চায় না। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন যে কোন সংস্থার নিয়োগের পরীক্ষার ফর্ম পূরণের সময় মাদ্রাসা বোর্ডের ভূমিকা কে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। ফলে লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসা পরীক্ষার্থী কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন নিয়োগের বিভিন্ন পরীক্ষা হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। অপরদিকে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বর্তমান রাজ্য সরকারের ও অনীহা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিধানসভায় প্রশ্ন উত্তর পর্বে উঠে এসেছে মাদ্রাসার নিয়োগ সংক্রান্ত প্রশ্ন, মাদ্রাসার প্রশাসনিক পরিকাঠামো সংক্রান্ত প্রশ্ন যা আজও অধরা। কি হবে এই মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার হাল ? লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থীদের ভবিষ্যত কোন দিকে? একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা নির্ভর করে শিক্ষার প্রশাসনিক পরিকাঠামোর উপরে। মাদ্রাসা শিক্ষার প্রশাসনিক পরিকাঠামো সংক্রান্ত একাধিক আর টি আই এর উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। রাজ্যে চলমান বিদ্যালয় শিক্ষা প্রশাসন ও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রশাসনের চিত্র নিম্নরূপ :
বিদ্যালয় শিক্ষা প্রশাসন বিদ্যালয় শিক্ষা প্রশাসনের পরিকাঠামো ক্রমানুসারে দেওয়া হল । বিদ্যালয় শিক্ষামন্ত্রী এম আই সি (মিনিস্ট্রি ইন চার্জ)ডি এস ই ( ডিরক্টরেট অফ স্কুল এডুকেশন)ডি আই ( ডিস্ট্রিক্ট ইন্সপেক্টর অফ স্কুলস)এস আই ( সাব ইন্সপেক্টর অফ স্কুলস)এইচ এম (হেড মাস্টার)মাদ্রাসা শিক্ষা প্রশাসন মাদ্রাসা শিক্ষা প্রশাসনের পরিকাঠামো ক্রমানুসারে দেওয়া হলো।মাদ্রাসা শিক্ষা মন্ত্রী এম আই সি ( মিনিস্ট্রি ইনচার্জ)ডি এম ই (ডিরেক্ট্ররেট অব মাদ্রাসায় এডুকেশন)শূন্যস্থান ( পশ্চিমবঙ্গে একজনও ‘ডি আই অফ মাদ্রাসা’ নেই)এস আই অফ মাদ্রাসা (সংখ্যায় অতি নগণ্য)হেডমাস্টার অফ মাদ্রাসা।
বিদ্যালয় শিক্ষা-প্রশাসনের বেশিরভাগ দায়িত্ব ডি আই গন সম্পন্ন করে থাকেন। বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনো ডি আই না থাকায় বিদ্যালয়ের নিযুক্ত ডি আই গন মাদ্রাসা শিক্ষা প্রশাসন পরিচালনা করেন। যদিও তারা মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থা এবং আরবি পঠন পাঠনের ব্যবস্থা সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, ফলত বছরের পর বছর ধরে ভুগতে হয় মাদ্রাসা গুলিকে । এখন প্রশ্ন উঠেছে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা এবং রাজ্যের বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা দুটি সম্পন্ন ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে অবস্থান করে। তাহলে কেন মাদ্রাসা শিক্ষা প্রশাসনের এই অসম্পূর্ণতা ? কেন মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের এই বঞ্চনা ? বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার চলমান কিছু সমস্যা রাজ্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি:
1) পশ্চিমবঙ্গের ‘মাদ্রাসা শিক্ষা ও সংখ্যালঘু দপ্তরের অন্তর্ভুক্ত ৬১৪ টি মাদ্রাসা, শিক্ষক ও শিক্ষিকার অভাবে অভিভাবকহীন হতে চলেছে।
2) সুপ্রিম কোর্টে একাধিকবার বর্তমান রাজ্য সরকার সংবিধানের আর্টিকেল ৩০ অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের অধিকারের ক্ষমতাকে খর্ব করার চেষ্টা করেছে। প্রসঙ্গত, আগামী ১৭ ই জানুয়ারি এ প্রসঙ্গে মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবিধানিক 30 নং অনুচ্ছেদে অধিকারের বিষয়ে সেভেন জাজেস বেঞ্চ শুনানি করবে।
3) পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা বোর্ড ১৯২৭ সাল থেকে আজও অব্যাহত। এই বোর্ডের একটি নির্দিষ্ট সাংবিধানিক পরিকাঠামো আছে। মাদ্রাসা বোর্ডের প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট থেকে সদস্য সংগ্রহের মাধ্যমে নির্বাচনের ভিত্তিতে একটি কমিটি গঠন করতে হয়, যারা এই বোর্ডটি পরিচালনা করার দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান সরকারের সময়ে একবারের জন্যও এই নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়নি।
4) মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে টেকনিক্যাল এডুকেশন এর সঙ্গে সংযুক্ত করার কথা বলেছিলেন বর্তমান সরকার, কিন্তু তাও আজ পর্যন্ত অধরা থেকে গিয়েছে।
5) সংখ্যালঘু কমিশন, বোর্ড, সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবী মহল সকলে নিশ্চুপ পশ্চিমবঙ্গের ওয়াকাফ সম্পত্তির খতিয়ান ও তার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে।
6) আজও পর্যন্ত আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির খতিয়ান ও বিবরণ বর্তমান রাজ্য সরকার দিতে পারল না কেন?
7) উচ্চশিক্ষায় ওবিসি এ ‘র রিজার্ভেশন এর উদাসীনতা সর্বদা বিরাজমান কেন ? কেন বি সি ডাবলু ডিপার্টমেন্ট নিয়ম ভঙ্গকারী প্রতিষ্ঠান গুলির বিরুদ্ধে অথবা সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে না ?
8) মাদ্রাসা শিক্ষা এবং সংখ্যালঘু দপ্তর প্রতিবছর মিলনমেলা উৎসবের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে। এবং এই মেলা উপলক্ষে সংখ্যালঘু দপ্তরের বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ পাঁচ কোটি টাকার অধিক বলে শোনা যাচ্ছে। বছরের পর বছর কেন একটি নির্দিষ্ট সংস্থা এই মেলার বরাত বা টেন্ডার পাবেন ? কতজন ব্যক্তির কর্মসংস্থানের সুযোগ এই মেলার মাধ্যমে হয়েছে ? এইভাবে সংখ্যালঘুদের জন্য বরাদ্দ কোটি কোটি টাকা ধ্বংস করা হচ্ছে কেন ?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct