আর মাস দুয়েকের মধ্যে দেশে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা হয়ে যেতে পারে। ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন সম্ভবত আর কখনও হয়নি। সাধারণ মানুষ কি এই গুরুত্ব অনুভব করতে পারছেন? প্রায় আশি বছরের গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা রয়েছে দেশের। মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনা এখনও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য যথেষ্ট বলা যাবে না। ভারতীয় গণতন্ত্রের এই দুর্বলতা সত্ত্বেও অবশ্য জয়যাত্রা অব্যাহত আছে। ভারতবর্ষীয় গণতন্ত্র কি আজ চ্যালেঞ্জের মুখে, চ্যালেঞ্জের মুখে সাংবিধানিক কাঠামো? লিখেছেন কাজী খায়রুল আনাম।
আজ রাজনীতির দাপটে গণতন্ত্রের অবস্থা সঙ্গীন। গণতন্ত্রের প্রকাশ হল রাজনীতি। কিন্তু রাজনীতির প্রকাশ যে সব সময় গণতান্ত্রিক হবে তার কোনো মানে নাই। গণ্ডগোল টা বাধে এখানেই। মানুষ রাজনীতির সমস্ত আচার-অনাচারকেই গণতন্ত্রের মান্যতা প্রাপ্ত বলে মনে করেন। রাজনীতির পরিসর নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার থেকে শুরু, আর রাষ্ট্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে শেষ। রাজনীতি, রাজনেতা অথবা রাজনৈতিক দলের দর্শনের ওপর নির্ভর করে। নির্ভর করে সমাজ সামাজিক ব্যবস্থার ওপর। ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, ভৌগলিক অবস্থানের ওপরেও। সর্বোপরি দেশের নাগরিক, মানসিকতায় কতটা শিক্ষিত তার ওপর। বস্তুত, গণতন্ত্রের ব্যবহারিক প্রয়োগ হল রাজনীতি। চলমান বিশ্বে রাজনীতির তুলনায় জনপ্রিয় ইভেন্ট আর কোনো কিছুই নাই। আসলে, গণতন্ত্রের পরিবর্তে রাজনীতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠলে গণতন্ত্র শুধুমাত্র দূর্বল হয় না, স্বৈর প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। সংখ্যার গরিমা স্বীকার করার নাম গণতন্ত্র। গণতন্ত্র আনুগত্য দাবি করে। দাবি করে পারষ্পারিক বিশ্বাস। দলের মধ্যেই হোক বা পার্টি ও সাধারণের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে। অনেক সময় বিশ্বাস ও আনুগত্য রাজনৈতিক উত্তরণের যোগ্যতা হয়ে ওঠে। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক কাঠামোর আসল শক্তি হল এই বিশ্বাস ও আনুগত্য। পাঁচ দশক আগে আনুগত্যবাদী রাজনীতির আত্মপ্রকাশ। ফলে যোগ্যতা হয়ে ওঠে গৌণ। যোগ্যতার প্রাধান্য কমতে থাকার জন্য স্তাবক শ্রেণি পরিবেষ্ঠিত দরবারী রাজনীতির উদ্ভব হয়। রাজনীতি যোগ্য ব্যক্তিদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার কারণে রাজনীতিতে দূর্বৃত্তায়ন শুরু হয়। অর্থাৎ গণতন্ত্রের ‘রাজভূমি’ দখল করে ফেলে বাহুবলী শক্তি। তাদের বদান্যতায় এবং সক্রিয়তায় রাজনীতি হয়ে ওঠে কারবারের মাধ্যম। সামাজিক অন্যায়ের আশ্রয় স্থল। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় মানুষের জন্য কাজ করার একটা দিক আছে। সেটা ফেলনা নয়। মানুষের হাজারো চাহিদা পূরণের মাধ্যম এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এবং তাকে ঘিরে থাকা রাজনীতি। রাজনীতি তা সবটাই পেরে ওঠে না। কেননা গণতন্ত্রের কৌশল হল রাজনীতি। এই কৌশলের কাছে অনেক সময় মানুষ পরাজিত হন। মানুষ পরাজিত হলে গণতন্ত্র তার আপন গৌরব হারিয়ে বসে।
ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সর্বজনীন ভোটাধিকারের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সংবিধান গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ। সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী জনগণ। জনগণই প্রধান। কিন্তু রাজনীতির দাপটে জনগণ শুধুমাত্র নিয়মতান্ত্রিক প্রধান। মানুষের হাতে শক্তি আছে কিন্তু ক্ষমতা চলে গেছে রাজনীতির দখলে। রাজনীতির এই দখলদারি অনেক খানি নিয়ন্ত্রণ আসে বিচার ব্যবস্থার জন্য। গণতন্ত্র প্রিয় মানুষের ভরসাস্থল হল ভারতবর্ষের বিচার ব্যবস্থা। এছাড়াও আছে মানবতাবাদী মানুষের প্রতিবাদ। এবং ভারতবর্ষে মানবতাবাদী মানুষের সংখ্যাটাও কম নয়। এই সংখ্যা টা দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনও রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। ফলে ভারতের মতো দেশে মানবতার উলঙ্ঘনকে রাজনৈতিক ইভেন্ট বানানো সহজসাধ্য নয়। কিছু মানবতাবাদী মানুষের রাজনৈতিক পক্ষ অবলম্বন বা দুই একজন বিচারকের নৈতিক স্খলন সামগ্রিক চিত্র নয়। স্পষ্টত, ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের বুনিয়াদ শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে রাজনীতিতে ভেলকি দেখিয়ে সাময়িক সাফল্য পাওয়া যায়। তা ধরে রাখতে গেলে উন্নয়নের শরণ নিতেই হয়। উন্নয়নই একমাত্র রাজনীতিকে উতরে দিতে পারে। কৌশলগত রাজনৈতিক অনুশীলন গণতন্ত্রের অঙ্গ হলেও তা শুধুমাত্র সাংগঠনিক স্তরে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। অর্থাৎ ভারত রাষ্ট্রের জাতীয় স্তরে বা রাজ্য স্তরে শাসক দল রাজনীতি পাঠশালা চালিয়ে গেলেও সরকারের কর্তব্য রাজনীতি মুক্ত থাকা। ভারতীয় গণতন্ত্রে এই সৌন্দর্য আদৌ দেখা যায় কি? সরকারের রাজনীতি মুক্ত থাকা সম্ভব না। কারণ দল সরকার চালনায় থাকে। দলকে সরকারে আসতে গেলে রাজনীতি করতে হয়। রাজনীতি করতে গেলে এসে পড়ে দলতন্ত্র। দলতন্ত্রের সঙ্গে গণতন্ত্রের পার্থক্য খুব সুক্ষ। পার্থক্য গড়ে দেয় নিরপেক্ষ মনোভাব। ক্ষমতার মোহ নিরপেক্ষ মনোভাবকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তখন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে দলতন্ত্রের প্রাধান্য দেখা যায়। স্বাভাবিক এই প্রবণতার ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। সব দল ও সরকারের ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য নয়। সেই সরকার প্রকৃতপক্ষে জনকল্যাণকামী। এবং এমন সরকারের বহু উদাহরণ রয়েছে ভারতবর্ষের গণতন্ত্রে। সেই সরকারের কার্যকলাপে গণতন্ত্র যেমন শক্তিশালী হয়। সরকারের জনপ্রিয়তা জনমুখী থাকে। মানুষের চাহিদা পূরণে যত্নবান হওয়ার কারণে শাসকদলের রাজনৈতিক উচ্চতা বিরোধী দল গুলির থেকে উচ্চতায় অবস্থান করে। এমন সরকারের সুশাসন জনচাহিদাকে বিক্ষোভে পরিণত করতে পারে না। সরকার জন সাধারণকে সরকার পক্ষ-বিরোধী বা জাতপাত অথবা সাম্প্রদায়িক যে কোনোভাবেই ভাগ করুক না কেন তাতে গণতন্ত্রের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। গণতন্ত্রের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে দরকার জনগণের হাতে ক্ষমতা। সেই ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করলেই গণতন্ত্রের শাসন হয়ে পড়বে সোনার পাথর বাটি। প্রশ্ন হচ্ছে, শাসক দলের রাজনৈতিক অনুশীলনে সরকার সাহায্য না করলে তো মাঠে শুধুমাত্র বিরোধী দলগুলি দাপিয়ে বেড়াবে। তখন কি শুধু শুধু সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? না। সরকারের মূল এজেন্ডা হবে জনউন্নয়ন। যা শাসক দলের রাজনীতি সহায়ক হবে। সরকারের কাজ হবে উন্নয়ন। শাসক দলের কাজ হবে তা সাধারণকে পৌঁছে দেওয়া। এবং মানুষকে বোঝানো। মানুষ সেই উন্নয়ন চাক্ষুষ করলে সরকারের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের কোনো প্রয়োজন পড়বে না। শাসক দল রাজনীতির মাঠে থাকলেই যথেষ্ট। শাসক দলের কর্মী সমর্থকরা মূলত স্বেচ্ছাসেবক হয়ে উঠবেন। তারাও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করবেন। রাজদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁরা সাধারণের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠবেন। এমনকি বিরোধীদের কাছে তাঁদের পরিশীলিত ব্যবহার স্মরণ করিয়ে দেবে তারা শাসকদলের লোক। অর্থাৎ শাসকদলের লোক মানেই ত্রুটি মার্জনীয় মার্কা বিনয়ী মনোভাব। গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য জনগণের ক্ষমতায়ন। এবং রাষ্ট্রের উন্নয়নে জনগণের যোগদান। ফলে রাজনীতির অংশীদার জনগণও। শুধুমাত্র ‘স্লোগান বিপ্লব’ এ অংশগ্রহণ নয়। প্রতিটি স্তরে উন্নয়ন কর্মে সাধারণের যোগ থাকা প্রয়োজন। সরকার তার বিকাশ পরিকল্পনায় সাধারণের যোগ নিশ্চিত করলে রাজনীতির ঠেলাও কম হবে। সরকার হয়ে উঠবে ‘মানুষের সরকার’। তাতে অবশ্য রাজনৈতিক মাতুনি কম হবে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যাতুনিও থাকবে না। ভুলে গেলে চলবে না, গণতন্ত্রের বিকাশ নির্ভর করে জনগণের স্বাধীনতার ওপর। রাষ্ট্র নির্মাণের স্বাধীনতা। শুধুমাত্র গণতন্ত্রের ফাঁকি নিয়ে ফাঁকিবাজি করলে সময় দীর্ঘায়িত হয়। ইতিহাসের জন্য পড়ে থাকে হাহাকার। এরপরও গণতন্ত্রে হাহাকারবাদী থাকবে কিন্তু তাঁরা সবাই বিরোধী নয়, এটা স্মরণে রাখতে হবে। এদের নিয়েই যাত্রাপথ আরও মসৃণ করে নিতে হবে। রাজনৈতিক উদারতা কাজটিকে সহজ করে তুলতে পারে। মানুষ অবশ্যই বিনোদন ভালবাসেন। তথাপি রাজনীতি বিনোদনের জায়গা নয়। কাজের জায়গা। রাজনীতির উদ্দেশ্য হল গণতন্ত্রকে সচল রাখা। কারণ গণতন্ত্রের চালিকা শক্তি হল রাজনীতি। রাজনীতি থাকবেই। কিন্তু সেটা রাজ কর্মকে প্রভাবিত করবে না। প্রাণিত করবে কর্মের উৎসমুখ সন্ধানে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নান্দনিক সৌন্দর্য বিশ্বে বিষ্ময়কর। পৌর-পঞ্চায়েত, পরিষদীয় ও সংসদীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিস্তৃত রয়েছে। এবং ভারতের প্রতিটি নাগরিক এই সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিস্তারক। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, মানুষ সত্যি সত্যি এই ভূমিকায় আছেন ? না। নেই তবে সাধারণের ভূমিকা পুরোটা খাতা কলমে এমন না। মানুষের হাতে ক্ষমতা আছে কিন্তু রাজনীতির শিকার হয়ে যাচ্ছে মানুষ। ফলে আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ঘোর সংকট দেখা দিচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে বের করতে হবে মানুষকেই। ‘মানসিকতায় শিক্ষিত’ মানুষকে। জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণা সফল করতে মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষই পারে তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকারের জ্ঞানদীপ্ত প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র নির্মাণে জনযোগ। নাহলে গণতন্ত্রের ফাঁকির দ্বারা বিজয়ী হতে থাকবে রাজনীতি। গণতন্ত্র হয়ে উঠবে নেহাতই সংখ্যাতন্ত্র। আগামী দিনে এই সংখ্যাতন্ত্র হয়ে উঠবে সার্বজনীন গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নয়, সমাজে মাৎস্যন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। পুনশ্চ, দেশের রাজনীতি আজ আজ গুরু - লঘুর, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণর ভোট সংখ্যার ওপরে সওয়াল করতে ব্যস্ত। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানও আজ লঘুর স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে বলে চ্যালেঞ্জের মুখে। চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে দেশের মানুষকে। হ্যাঁ- সংখ্যাটাও জরুরি। আগামী লোকসভা নির্বাচন তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষের ভবিষ্যতের জন্য।
সমাপ্ত..
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct