ড. রমজান আলি: আজ কৃষিবর্ষের শেষদিন। শেষ পৌষ। শেষ পৌষে ধান চাল বিক্রি করতে নেই। দক্ষিণ রাঢ়ে ধান,চাল,ভাত, মুড়ি সবই জাত-ধর্মভেদে ‘মা লক্ষ্মী’ নামে পরিচিত। খেতে খেতে দু-একটা মুড়ি পড়ে গেলে বাবা বলতেন, কুড়িয়ে খাও, মা লক্ষ্মী ফ্যালাছ্যালা করতে নেই।” দুপুরে ভাত খাওয়ার পর টেবিলে দু-একটা ভাত পড়ে থাকলে বউ কোরিনাকে বলে, “ তাড়াতাড়ি ভাত কুড়ো, মা লক্ষ্মী যতক্ষণ পড়ে থাকবে, ততক্ষণ বরদোয়া দেবে।” আমার মা বলতেন, “শেষ পৌষে কাউকে বকা-ঝকা করতে নেই , কারো সঙ্গে কোন্দল করতে নেই।” সুযোগ পেয়ে এই সময় কোথাও কিছু বদমাইশি করলে, মা বলতেন “শেষ পৌষ আজ কিছু বলবো না, মাঘ মাসটা পরুক , তারপর দেখছি।”
ঢেঁকিতে চাল কুটে আটা বানিয়ে দিতো মাসুরা , আন্জু, আসিয়া দাদিরা। অকাল বৈধব্য নিয়ে বাকি জীবনটা কাটাচ্ছে, কারো না কারো আশ্রয়ে। সারাবছর এদের কোনো কাজ থাকে না। আজ বিনিময়ে পাবে হয়তো এক সের চাল, আর দুপুর বেলায় আমাদের বাড়িতে খাবে, আর বেড়ে গেলে রাতে ঠান্ডা ভাত। দুপুর থেকেই নাদায় আলোচাল ভিজিয়ে রেখে সন্ধ্যায় তা জল থেকে তুলে নতুন কেনা ডালায় রাখা আছে। ভিজে আলো চাল চিবিয়ে খেতে, স্বাদই আলাদা। ফাঁক পেলেই, মাঝে মধ্যে দু’এক খাবলা মুখে চলে যাচ্ছে । মাসেম ভাইদের ঘরে আছে পরিস্কার মেটেল মাটি দিয়ে নিকানো ঢেঁকিশাল। এইসময় লাইন দিয়ে আটা কোটা চলে। মা বলতো, রাত থাকতে থাকতেই চাল কুটে শেষ করতে হবে, সূর্য উঠার আগেই।
খুব ইচ্ছা করতো ঢেঁকিতে পাড় দিতে। আশ্চর্য এক তাল! তারই সঙ্গে হালকা নাচ, দুই দাদির পা একসঙ্গে পড়ছে ঢেঁকিতে। তালে তালে গর্তে হাত দিয়ে আঠা তুলে নেওয়া। হাঁসমুরগির ডিম বিক্রি করে কিনে রাখা চালুনিতে আটার গুঁড়ি চেলে নেওয়া হচ্ছে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে তার সুবাস। আশ্চর্য এক ছন্দ ! অদ্ভুত এক আওয়াজ ! শীতের শেষ রাত থেকে ভোর এমনকি সারাদিন সেই আওয়াজ অল্পবিস্তর মাটির কম্পনের সঙ্গে মিশে , ছড়িয়ে পড়তো তরঙ্গাকারে।
শুধু দেখার কৌতূহল মেটাতে ভোর ভোর উঠে যে মাসেম ভাইদের বাড়ি যাবো তারও উপায় নেই। ওদের কুকুরটা ছিল খুব হারামি। এই জন্যই তো আমি আর আমার বন্ধু শফি, দুজনে মিলে যুক্তি করে, একদিন ওর লেজের গোড়ায় দিলাম পেট্রোল ঢেলে। কেঁউ কেঁউ করে সে কি চিৎকার ! তার কি হচ্ছে , এই দেখার কৌতূহলটাও যেমন ছিল । তেমনি ভয়ও ছিল, কামড়ে না দ্যায়। আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেখানে গিয়ে হাজির। শেষে দুজনের লুকিয়ে পড়েছি হোবো ভাইদের ছানিশালে। কুকুরটা যখন সেখানে গিয়েও হাজির, আমরা দুজনে তখন পাঁচিরের ওপরে উঠে পোড়োল দিয়ে বেরিয়ে, দে ছুট, দে ছুট। ওহ্ কী বাচনটাই না, বেঁচে গেছি সেদিন।
এক সপ্তাহ আগেই আটা তৈরি করে রোদে শুকানো হয়ে গেছে। ধান শুকানো খামারে খেজুর পাতার তালাইয়ের উপর সাদা ধুতি বিছিয়ে , তার উপর সাদা আটা শুকোতে দেওয়া । মুরগিতে যাতে পা না দিয়ে দেয়, তার জন্য সর্তকতা। আর কাকেরা এসে লম্বা ঠোঁট ভর্তি করে আটা যাতে নিয়ে না পালায় তার জন্য হাতের লগা নিয়ে সদা সতর্ক থাকতে হতো। পুকুর ধার থেকে কাদা এনে একটা ভাঙ্গা বাতা বা কঞ্চির উপর কালো ছাতার কাপড় কিংবা ময়লা লাতা ঝুলিয়ে দেওয়া হতো, যাতে করে ভয় পেয়ে কাকেরা না আসে। তবু চতুর কাকেদের আটকানো যায় নি। তাদের কোনোকালেই আটকানো যায় না।
দুমুখো উনুনে কুটির জাল ধরানো হয়েছে, দুদিকে দুটো উনুনে মাটির তাওয়া চাপিয়েছে আমাদের গোয়াল বাড়িতে থাকা গ্যাঁড়ার বউ কামিনি। ভোর থেকে উঠে মা জলিস করে রেখেছে। আজ আর গোঁজা, ঝুঁকি, চিতুই কিম্বা ছেঁড়া পিটে নয়, চালের আটার পাতলা রুটি হবে। তারই জরিপ করা হয়েছে। জলিস হলো চালের আটার উপর গরম জল দিয়ে খামিরের টুকরো । দুই হাতের আঙ্গুলে চাপ দিয়ে একটু বেশি গোল করে রাখা। প্রাক্-পিটে আরকি। একটু খামির হাতে নিয়ে খাওয়ার তখন কত সাধ। খামির থেকে টুকরো টুকরো অংশ কেটে জলিস করে চালের আটার পিঠে বানানো হয়। মেলায় কেনা কাঠের পিঁড়ে-বেণ্ণি। পিঁড়ের উপর চালের গুড়ি ছড়িয়ে, তার উপর হাতের আঙ্গুলে টেপা জলিস রেখে তার উপর আবার চালের গুড়ি ছড়িয়ে বাঁ হাতটা বেণ্ণির উপর হালকা রেখে ডান হাতে চাপ দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পিঠে করা। ব্যালেন্স করতে না পারলে পিঠে গোল হবে না। দু-একটা নয়, কাজের লোক নিয়ে আজ বাড়িতে পণপণ পিঠে পেটুস্যাৎ হয়ে যাবে। দেশি মুরগির বা হাঁসের কষা মাংস। এই সময়ে ধান চাল খাওয়া হাঁস মুরগির গায়ে সুস্বাধু হলুদ চর্বি জমে। ডিমওয়ালা মুরগী শীতকালে খেতে খারাপ না। সিদ্ধ করে ভাজা একটা করে দেশি মুরগির বা হাঁসের ডিম, নতুন খাস চালের ক্ষীর খেজুর গুড় দিয়ে। যে যতো পারে খাবে। গোয়ালবাড়িতে যে সাঁওতাল পরিবারটা আছে তাদেরকেও দিতে হবে। গ্যাঁড়া একাই এক পণ পিটে খেতে পারে । তারপর তো আমার খ্যালার দুই সঙ্গী ; গ্যাঁড়া সরদারের দুব্যাটা জিতু ও গিতু আছেই। বাবা বলতেন, “পিটে খেলে পেটে সয়।/ যারা না খায় তারা মহাশয়।”
এই গ্রামের কাছেপিঠে কোনো নদনদী নেই। বাগ্দি পাড়ার মেয়েরা টুসু গাইতে গাইতে মাঠের পুকুর কঞ্চিগোড়ের পাড়ে হাজির হবে। সেখান থেকে থেকে স্নান করে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে উত্তর মুখে লাইন দিয়ে গাঁয়ে ফিরবে। তখন জানতাম না, তাদের মুখের এই গানই টুসু গান । অবাক হয়ে মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে সে সব দেখতাম।
ভোরের বেলায় নামাজ পড়ে আগুন পোয়নোর শখ ছিল বাবার। বলতেন, ‘মাঘের জারে /মোষের শিং লড়ে’। খামারের প্রচুর খড়কুটি দিয়েই চলত পুকুর ধারে সেই আগুনের ওম আর বাবার রসোপল। সকালবেলায় নিম ডালে দাঁত মাজতে মাজতে আমরা গিয়ে হাজির হলে শুনতে হতো সোয়েটার পরে আগুন থেকে দূরে থাকার সতর্কবার্তা। মাঘ মাসের মাঝামাঝি আসতেই বাবা বলতেন, ‘অর্ধেক মাঘে / কম্বল কাঁধে’।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct