নাজো পাগলী
গোলাম মোস্তাফা মুনু
সাদরুল মোমিন এক স্ত্রী এবং দুই মেয়ে রেখে মারা যায়। বড় মেয়ের বয়স সাত বছর এবং ছোট মেয়ের তিন। সাদরুলের স্ত্রী চম্পা স্বামীর মৃত্যুতে শোকে ভেঙে পড়ে। তার জীবনে বুড়িমা ছাড়া আর কেউ নেই। বুড়িমা তার কাছেই থাকে। চম্পা হাতের কোন কাজই জানে না। বিড়ি বাঁধার কাজ একটু একটু শিখেছিল। দীর্ঘদিন ধরে না বাঁধার কারণে সেটাও ভুলে গেছে। এখন সে কেমন করে সংসার চালাবে এমন কথা ভাবতে গেলেই যেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে। স্বামীর মৃত্যুর সপ্তাহখানেকের মধ্যে তার শরীর শুকিয়ে যেন অর্ধেক হয়ে যায়। বুড়িমা এবং দুটি মেয়ের মুখে কীভাবে আহার তুলে দেবে- এমন চিন্তাভাবনা করে সে সবসময় কাঁদতে থাকে। একদিন সকালে চম্পার কান্না শুনে নাজো পাগলী তাদের বাড়ি প্রবেশ করে। চম্পার সামনে এসে বসে। সে কোন কথা না বলে চম্পার কান্নার বয়ান শুনতে থাকে। কিছুক্ষণ শোনার পর সেও উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠে। তার চোখ দিয়ে শ্রাবণের বারিধারা বইতে থাকে। চম্পা খানিক পরেই নিজের কান্না থামিয়ে দেয়। নাজোর চলতেই থাকে। দীর্ঘক্ষণ কাঁদার পর নাজো যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সে কান্না থামিয়ে দেয়। চোখের জল মুছে নিয়ে মৃদুস্বরে চম্পাকে সান্ত্বনা দেয়, ‘চম্পা, আমি থাকতে তুই আর চিন্তা করিস না বোন। তোর মেয়েদের আমি না খাইয়ে রাখবো না। এ পাগলীকে বিশ্বাস কর বোন।’ বলেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। চম্পার পাঁচবাড়ি পরেই নাজো পাগলীর বাড়ি। একটিই ঘর। টালির ছাউনি। বর্ষাকালে কখনো কখনো বিছানার কিছু অংশ ভিজে যায়। ঘরের মেঝেও যেন কাদা কাদা হয়ে যায়। বয়স চল্লিশের কম হবে না। তার জীবনে এখন আর কেউ নেই। স্বামী ছিল। বিশ বছর পূর্বেই তার স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দিয়েছে। তখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। তালাকের পর মানসিক আঘাতেই তার এমন দশা। নাজো সম্পূর্ণ পাগল নয়। তাকে পাগল সম্বোধন করে যে তার সাথে কথা বলে তাকে সে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দেয়। আর যে তাকে খালা, ফুফু, দিদি সম্বোধন করে কথা বলে তার সাথে সে খুব ভালো আচরন করে। তার জন্য মঙ্গল কামনা করে আল্লাহর কাছে দোয়াও করে সে। নাজো প্রতিদিন সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ফিরে সন্ধ্যার সময়। পনেরো-বিশ গ্রামের মধ্যে যেখানেই ভোজ হোক না কেন সেই ভোজের খবর যেন তার কাছে থাকে। ভোজবাড়ি গিয়ে সে খাবারও খায় এবং দিনের শেষে খাবার চেয়ে নিয়ে আসে। সবখাবার চম্পার পরিবারে দিয়ে দেয়। সেই খাবারেই তাদের দু’বেলা চলে যায়। কোনদিন যদি কোথাও ভোজ না হয় তাহলে সেদিন লোকের বাড়ি ঢুকে খাবার চেয়ে নিয়ে আসে। শরীর অসুস্থ থাকলেও কোনদিন বাড়িতে বসে থাকে না সে। একদিন তো কোনো এক ভোজবাড়িতে গরম তরকারি প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরতে গিয়ে হাতে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে হাতে ফসকা পড়ে। খুব যন্ত্রণা হয়। তিন-চার দিন ধরে তার যন্ত্রণা থাকে। তবুও সে পোড়া হাত নিয়েই চম্পার পরিবারের উদ্দেশ্যে খাবার চাইতে বেরিয়েছে। এভাবে প্রায় তেরো বছর পার হয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যে চম্পার দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। নাজো তার জমানো সব টাকাই চম্পার দুই মেয়ের বিয়েতে খরচ করে দিয়েছে। মেয়েরা স্বামীর বাড়িতে মন দিয়ে ঘর-সংসার করছে। মেয়ের বিয়ে দিতে পেরে চম্পা খুবই খুশি। খুশি নাজোও।মাসখানেক পার হয়ে যায়। দুই মেয়েই স্বামীর ঘর থেকে মায়ের বাড়ি আসেনি। নাজোর খুব ইচ্ছা করে তাদেরকে দেখার। একদিন দুপুরবেলা নাজো গিয়ে ওঠে বড় মেয়ে সাবেরার বাড়ি। সাবেরা নাজোকে দেখে খুশি হয়। নাজো সাবেরাকে বলে, ‘তোদেরকে না দেখে আমি থাকতে পারি না, তাই দেখার উদ্দেশ্যেই তোর বাড়ি চলে এলাম।’ সাবেরা হাসিমুখে বলে, ‘ভালো করেছো খালা। তুমি বসো। তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি।’ এ বলে সাবেরা রান্না ঘরে চলে যায়। সাবেরা রান্নাঘর থেকে খাবার এনে নাজোর সামনে রেখে দেয়। নাজো খুশি মনে খেতে শুরু করে। সাবেরা সামনের দিকে বসে নাজোকে দেখতে থাকে। এমন সময় সাবেরার স্বামী বাড়ির ভেতর ঢুকে নাজো পাগলীকে খেতে দেখে সে অবাক হয়ে যায়। সাবেরার ওপর যেন রাগও হয় তার। সাবেরাকে অদূরে ডেকে নিয়ে সে বলে, ‘একজন পাগলীকে তোমার খাওয়ানোর ইচ্ছা হয়েছে, খাওয়াও। তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বাড়ির মধ্যে ডেকে এনেছো কেন? ওকে তো বাইরেই খেতে দিতে পারতে। যদি সে কোনো অঘটন ঘটিয়ে দেয়!’ সাবেরার স্বামীর কথাগুলো নাজো শুনতে পায়। মুখে খাবার আর না দিয়ে সে সাবেরার দিকে তাকায়। তার চাহনি সাবেরাকে বারবার বলতে থাকে যে, নাজো তাদের জন্য কত কী করেছে, সবকিছু যেন সে তার স্বামীকে জানিয়ে দেয়। যদি সে জানতে পারে তাহলে নাজোকে সে আর তাচ্ছিল্য করবে না; বরং সম্মান করবে। নাজো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর হতাশ হয়ে যায়। সাবেরা নীরব থাকে। নাজো অবশিষ্ট খাবারগুলো নিয়ে বাড়ির বাইরে গিয়ে বসে খেতে শুরু করে। সাবেরা নাজোর কাছে জগে করে পানি নিয়ে আসে। সে মৃদুস্বরে বলে, ‘খালা, খাওয়া হয়ে গেলে হাত ধুয়ে পানি খেয়ে নাও।’ এ বলে সে নাজোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। নাজো সাবেরার কথায় যেন কর্ণপাত না করে খেতেই থাকে। খাওয়া শেষ করে হাত না ধুয়ে সে নিজের পড়ে থাকা শাড়িতেই হাত মুছতে মুছতে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct