জেলখানার কবি নাজিম হিকমত
ডা. শামসুল হক
অজস্র কবিতা লিখেছেন তিনি। আর তার মধ্যে বেশীরভাগ কবিতাই আবার লেখা কারাগারের অন্ধকার কুপের মধ্যেই বসে। লিখেছেন মনের মধ্যে একরাশ যন্ত্রণা এবং ক্ষোভের বোঝা বুকে নিয়েই। সেইসব লেখনীর মাধ্যমেই আবার প্রকাশিত হয়েছে মানুষের কথা, প্রকৃতির কথা এবং নিজের বন্দী জীবনের কথাও। তাঁর কথার মধ্যেই আবার ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর অন্য এক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও। আবার মানুষের কাছে তিনি বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছেন একজন রোমান্টিক বিপ্লবী হিসেবেও। তাইতো নিজের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও তাঁর অবদান কম নয়। তিনি কবি নাজিম হিকমত। তুর্কী ভাষার প্রখ্যাত কবি ও নাট্যকার হিসেবে বিশেষ পরিচিতি আছে তাঁর। নিরপেক্ষ সাংবাদিক হিসেবেও বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন তিনি। ১৯০২ সালের ১৫ ই জানুয়ারি জন্ম তাঁর সোভিয়েত ইউনিয়নের তুরস্কে। ইস্তাম্বুলের গোজেটেপ জেলার তাসমেরটেজ প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শুরু তাঁর শিক্ষা জীবন। মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করেন বেয়োগুলু জেলার পালাতাসার হাই স্কুলে। সেখানেই তিনি শিখে নেন ফরাসি ভাষাটাও। তারপর স্নাতক হন প্রিন্সেস দ্বীপপুঞ্জের তুর্কিস নেভাল একাডেমি থেকে।ছাত্রজীবন শেষ করে অন্য সকলের মতোই তিনিও ঝাঁপিয়ে পড়ুন কর্মক্ষেত্রে, একাই ছিল তাঁর অভিভাবকদের ঐকান্তিক ইচ্ছা। বাস্তবে তা কিন্তু ঘটেনি। কারণ সংগ্ৰামী মন ছিল তাঁর। পরাধীন দেশকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাবার ইচ্ছেতেই তখন বিভোর ছিলেন তিনি। তাই মনের সেই ইচ্ছেটাকে পরিপূর্ণ করার তাগিদেই একদিন অতি গোপনে গৃহত্যাগও করেন তিনি।সেটা ১৯২১ সালের কথা। সেই বয়সেই বাড়ীর লোকজনের চোখ এড়িয়েই তিনি পৌঁছে যান আনাতেলিয়ার সেনা ছাউনিতে। নাম লেখান স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সৈনিক হিসেবেই। সেদিনের সেই রণাঙ্গনে দেশের জন্য তিনি প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন সেকথা ঠিকই, কিন্তু তিনি সব সময়ই চাইতেন একটা মুক্ত পৃথিবীরই বাসিন্দা হবেন তিনি নিজে এবং সকলেই।সংগ্ৰামী এই মানুষটার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে মস্কোতে। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল প্রখ্যাত রুশ কবি মায়াকোভস্কির। দুজনে ছিলেন একই আদর্শে বিশ্বাসী। তাই জীবনে কখনই কোন বিষয়েই তাঁদের মতের অমিল হয়নি। দুজনের লেখার ধরনের মধ্যেও ছিল প্রচুর মিল। আর সবচেয়ে বড় কথা, তাঁদের কাব্য জীবনে কেউ কখনই অপরকে দেখেননি ঈর্ষার চোখেও।মাত্র চোদ্দ বছর বয়স থেকেই লেখালিখির কাজ শুরু করেন নাজিম হিকমত। সতের বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতা। বেশ নামী পত্রিকাতেই ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছিল সেই কবিতাটি। আর তারপর থেকেই বাড়তে থাকে তাঁর কলমের গতিও। মূলতঃ মাতৃভাষাতেই কবিতা লিখতেন তিনি।পরে অবশ্য তা অনুদিত হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়াতে চলে যান কবি নাজিম হিকমত। তখন অবশ্য পরাধীন ছিল তাঁর দেশ।পরে ১৯২৪ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি আবার ফিরে আসেন স্বদেশে। তারপর মন দিয়েই শুরু করেন লেখালেখির কাজ। সেইসময় কবিতা লেখার পাশাপাশি তাঁর ঝোঁক বাড়ে সাংবাদিকতার প্রতিও। তাই কয়েক দিনের মধ্যেই যোগ দেন একটা সংবাদপত্রের দপ্তরেও।
তখন যেন নতুনভাবেই জীবন শুরু হয় কবির। নিজের পেশার উপর গুরুত্বও বাড়িয়ে দেন ভীষণভাবেই। চারিদিকে সুনামও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু তাঁর সেই সুখ আর সমৃদ্ধির সাম্রাজ্য খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তাঁর সাংবাদিকতার মধ্যে ছিল প্রতিবাদেরই ভাষা। আর সেই অভিযোগে একসময় গ্ৰেপ্তারও করা হয় তাঁকে। আদালতের বিচারে আবার জেলও হয় তাঁর। কিন্তু সেখানেও থামেনি তাঁর কলম।লেখেন অজস্র কবিতা এবং নাটকও। তখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাই ছিল তাঁর যাবতীয় লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য। বিদ্রোহী এই মানুষটি মুক্তির স্বাদ পান ১৯২৮ সালে। সেইসময় তিনি আবারও ফিরে আসেন তুরস্কে। সেখানেও সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি। কিন্তু তখনও মানসিকতার বদল ঘটেনি তাঁর। ফলে আবারও তাঁর কলম থেকে বিচ্ছুরিত হতে থাকে বিদ্রোহেরই আগুন। আর তারই ফলস্বরূপ আবার কারাগারের অন্ধকারেই পা মেলাতে হয় তাঁকে। সেখানে বসে বসেই কবিতার প্রতি মনপ্রাণ ঢেলে দেন তিনি।লিখে ফেলেন এক এক করে মোট নয়টি কাব্যগ্ৰন্থ। সেইসময় বারবারই গ্ৰেপ্তার হন তিনি আবার আদালতের নির্দেশে ছাড়াও পেয়ে যান। কিন্তু একসময় তাঁকে পেতে হয় চরম শাস্তিই। তখন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তাঁর কবিতার মধ্যে প্রতিফলন ঘটেছে এমনই সব কথা যেটা সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের মনের মধ্যে বিশাল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে এবং তারই ফলস্বরূপ তাদের মধ্যে অনেকেই উদ্ধুদ্ধ হয়েছে সমাজতান্ত্রিক চেতনারই পথে।এখানেই কিন্তু সব শেষ নয়। সরকারি মহলের আবার বক্তব্য, নাজিমের কবিতা সমানভাবে অনুপ্রাণিত করছিল স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরও। তাঁর কবিতার মধ্যে তারাও পেয়েছিল বিপ্লবের প্রেরণা। ফলে টনক নড়েছিল সরকারের এবং আবারও গ্ৰেপ্তার করা হয়েছিল তাঁকে। আর সেইসময় বেশ বড় ধরণের শাস্তিরই মুখোমুখি হন তিনি। হয়েছিল আঠাশ বছরের জেল। সেটা ১৯৩৮ সালের কথা। এইভাবেই কেটে গিয়েছিল আরও দশটা বছর। অবশেষে তাঁকে দেখে ভীষণভাবেই ব্যথিত হন কবি পাবলো নেরুদা, সঙ্গীত শিল্পী পলরব সন এবং দার্শনিক পল সাত্রার মত বিশিষ্ট জনেরা। তাঁরা তখন মিলিতভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়েন নাজিমের মুক্তিরই জন্য। সকলে মিলে অনশনেও বসেন। পরে ১৯৫০ সালে তুরস্কে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলে মুক্তি পান কবি নাজিম হিকমত।সেই বছরই অর্থাৎ ১৯৫০ সালেই তিনি আবার পান নোবেল শান্তি পুরস্কারও। আর তাতেই তাঁর মনের জোরও বেড়ে যায় অনেকটাই। লিখতে শুরু করেন অজস্র কবিতা। সেইসময় অনেক কবিতা তিনি আবার লিখেছিলেন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে। একটা কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, বলো হিকমত কোন শহরে তুমি মরতে চাও?উত্তরটাও দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। লিখেছিলেন, আমি মারা যেতে চাই ইস্তাম্বুলে,মস্কোয় এবং প্যারিসেও। তারপর তিনি আবার লিখেছেন, আমার মৃত্যুগুলো আমি পৃথিবীর উপরে বীজের মতো ছড়িয়ে দিয়েছি। তবে সবচেয়ে আমি যে দেশকে বেশি ভালোবাসি সেটি হচ্ছে পৃথিবী।যখন সময় আসবে, আমাকে পৃথিবী দিয়েই মুড়ে দিও।মহান এই কবির মৃত্যু কিন্তু হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোতেই। ১৯৬৩ সালের ৩ রা জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে বিদায় নেন তিনি। এই বৎসর তাঁর একশত তেইশতম জন্মবার্ষিকী। তাই ১৫ ই জানুয়ারি তাঁর জন্মদিনটার কথা মনে রেখেই আমারা যেন তাঁকে স্মরণ করতে পারি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গেই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct