গত ৬৩ বছরের ভারতের যাত্রা ন্যায়ের পথ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। আমরা প্রতিটা ক্ষেত্রে আপন পরের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করি। ভুক্তভোগীরা যদি নিজের ধর্ম বা বর্ণের না হয়, তাহলে আমরা সব ধরনের অন্যায়কে শুধু মাত্র প্রশ্রয়ই দিই না বরং তাকে মহিমান্বিত করতে তৈরি থাকি। সুদূর অতীতে ঘটে যাওয়া বা কাল্পনিক অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়াকে আমরা ন্যায়বিচার ধরে নিই। মনুষ্যত্বের মাথায় মুকুট রাখার পরিবর্তে আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় গণহত্যাকে বৈধতা দিতে ব্যস্ত। ঘরে ঘরে ঘটতে থাকা অন্যায়কে মিথ্যে দিয়ে ঢেকে ‘বিশ্বগুরু’ বলে আখ্যায়িত করার আনাড়ি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। লিখেছেন যোগেন্দ্র যাদব।
কংগ্রেস ঘোষিত ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা ছোটবেলায় শোনা এই গানটার কথা আমাকে মনে করিয়ে দিল: “ইনসাফ কি ডাগর পে, বাচ্চো দেখাও চল কেইয়ে দেশ তুমহারা, নেতা তুমহি হো কাল কে।’ সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের’ প্রতিশ্রুতির এক দশক পর ‘গঙ্গা যমুনা’ ছবির জন্য শাকিল বদায়ুনির লেখা এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-এর সুরেলা কণ্ঠে এই গান মনে করিয়ে দেয় দেশপ্রেম এবং ন্যায়বিচারের মধ্যে নিবিড় সম্পর্কের কথা। মনে করিয়ে দেয় আমরা কতটা গভীরভাবে ইনসাফ বা ন্যায়ের চিন্তাধারার উত্তরসূরি।“আপনে হো ইয়া পরায়ে, সবকে লিয়ে হো ন্যায়দেখো কদম তুমহারা হরগিস না টকরায়ে।”:এই লাইনগুলি ন্যায়বিচারের এক এমন বোধের দিকে নির্দেশ করে যা কোনও কাঠগড়ায়, এমনকি দেশের সীমানার মধ্যেও আবদ্ধ নয়। এখানে ন্যায়বিচার আপন বা পর কোনও ভেদাভেদ মানতে প্রস্তুত নয়। ভারতের গরিমা অন্য দেশের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হওয়ার মধ্যে নয় বরং সমগ্র মানবতাকে উন্নত করার মধ্যে রয়েছে।“ইনসানিয়ত কে সর পর ইজ্জত কা তাজ রাখনা তন মন ভি ভেট দে কর ভারত কি লাজ রাখনা”: এই গান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ভারতের সম্মান শুধুমাত্র “সততার শক্তি মাধ্যমে” বজায় রাখা যেতে পারে।গত ৬৩ বছরের ভারতের যাত্রা ন্যায়ের পথ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। আমরা প্রতিটা ক্ষেত্রে আপন পরের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করি। ভুক্তভোগীরা যদি নিজের ধর্ম বা বর্ণের না হয়, তাহলে আমরা সব ধরনের অন্যায়কে শুধু মাত্র প্রশ্রয়ই দিই না বরং তাকে মহিমান্বিত করতে তৈরি থাকি। সুদূর অতীতে ঘটে যাওয়া বা কাল্পনিক অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়াকে আমরা ন্যায়বিচার ধরে নিই। মনুষ্যত্বের মাথায় মুকুট রাখার পরিবর্তে আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় গণহত্যাকে বৈধতা দিতে ব্যস্ত। ঘরে ঘরে ঘটতে থাকা অন্যায়কে মিথ্যে দিয়ে ঢেকে ‘বিশ্বগুরু’ বলে আখ্যায়িত করার আনাড়ি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এমন পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের তরফে ন্যায় যাত্রার ঘোষণা যদি আশা জাগায়, পাশাপাশি জন্ম দেয় অনেক প্রশ্নেরও। রাজনৈতিক মহলে এই ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রাকে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে যা আসলে ঠিকই। কংগ্রেস যদি নির্বাচনে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে এই যাত্রা করে তাহলে তাতে দোষের কিছু নেই। দোষ তখনই হবে যদি জয় অর্জনের জন্য বিদ্বেষ ও মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। কোনও দল নির্বাচনে জয়ের জন্য ন্যায়, সত্য, অহিংসা, সাম্য ও স্বাধীনতার মতো মূল্যবোধের ওপর নির্ভর করতে চাইলে তাকে স্বাগত জানাতে হবে। অতএব, এই যাত্রায় কংগ্রেসের ন্যায়বিচারের আওয়াজ তোলা আশা জাগায় এবং এই প্রয়াসকে আমাদের সভ্যতার গভীর ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করে।এখানে প্রশ্ন জাগে এই যাত্রায় ‘ন্যায়ের’ অর্থ কী? কংগ্রেসের জারি করা আনুষ্ঠানিক ঘোষণায়, ন্যায়বিচারের অর্থকে সাংবিধানিক ভাষায় অর্থাৎ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ন্যায়বিচার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যা সঠিক দিশা দেখায় ঠিকই তবুও মানেটা বিমূর্ত থেকে যায়।প্রথমত, এই যাত্রাকে বিচারের সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকে সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায়বিচারকে বিভিন্ন ধরনের কথায় ব্যক্ত করা হয়েছে। ৭০ এবং ৮০ দশকে, ন্যায় বলতে বোঝাত “অন্ন, বস্ত্র এবং বাসস্থান” অর্থাৎ মানুষের জন্য জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা। ৯০ এর দশকে যা পরিবর্তিত হয়ে “বিদ্যুৎ, রাস্তা, জল”, অর্থাৎ নিছক বেঁচে থাকার বাইরে ন্যূনতম কিছু সুবিধার দাবি প্রকাশ পায়।কিন্তু আজ জনগণের আশা-আকাঙ্খা আরও এগিয়ে গেছে। যুব হাল্লা বোল নেতা অনুপম এই নতুন আকাঙ্খাকে “উপার্জন, পড়াশোনা এবং ওষুধ” বলে চিহ্নিত করেছেন। আজ দেশের নাগরিকদের রেশন, বিদ্যুৎ ও জলেরও প্রয়োজনীয়তা আছে। তারা এমন একজন নেতা ও সরকার খুঁজছে যে প্রত্যেক যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে, প্রত্যেক শিশুর জন্য শিক্ষার সমান ও ভালো সুযোগ দিতে পারে এবং সকল নাগরিককে বিনামূল্যে ভালো স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করতে পারে। ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রাকে এই আকাঙ্খাগুলির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।এই আশা-আকাঙ্খার প্রতি সুবিচার করার জন্য, তাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং ঘোষণার রূপ দিতে হবে যাতে জনগণ বিভ্রান্ত না হয়। বেকারত্বের সঙ্কট মোকাবেলায় কর্মসংস্থানের অধিকারের ধারণাকে সুনির্দিষ্ট নীতিতে রূপান্তর করতে হবে। এর জন্য, গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি রাজস্থানে বাস্তবায়িত শহুরে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা এবং শিক্ষিত বেকারদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষানবিশের মতো প্রকল্পগুলির নীলনকশা উপস্থাপন করতে হবে। স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা দিতে শুধুমাত্র বীমার ওপর নির্ভর না করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে শুরু করে সরকারি জেলা হাসপাতাল পর্যন্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা জোরদার করতে হবে, বিনামূল্যে চিকিৎসকের পাশাপাশি বিনামূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। রাজস্থানের চিরঞ্জীবী যোজনা এর ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে। শিক্ষার সুযোগে সমতা আনতে কিন্ডারগার্টেন থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত উচ্চমানের শিক্ষায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।এর সঙ্গে সম্পর্কিত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল ন্যায়বিচারের এই ধারণার জন্য একটি রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি করা, যার অনুপস্থিতিতে এই ধারণাটি কেবল কাগজেই থাকবে। আজকের ভারতের জনগন যে অন্যায়ের শিকার, তা চিহ্নিত করা কঠিন নয়। নারী, বেকারত্ব, যুবক, দরিদ্র, শ্রমিক ও কৃষকের পাশাপাশি সেইসব সামাজিক সম্প্রদায়কেও চিহ্নিত করতে হবে যারা এখনও সামাজিক অবিচারের শিকার। দলিত, উপজাতি, অনগ্রসর ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বর তুললেও যাযাবর সম্প্রদায়, পসমন্দা সম্প্রদায়, অতি-অনগ্রসর ও মহাদলিতদের আওয়াজকে তুলে ধরা এই যাত্রার নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব।এই বড় এবং দীর্ঘমেয়াদী দায়িত্ব গ্রহণকারী ন্যায় যাত্রা এগিয়ে যাবে, এই আওয়াজ তুলে…“দুনিয়া কে রজ সহতা অর কুছ না মুহ সে কেহনাসচ্চাইয়ো কে বল পে আগে কো বড়তে রেহনারাখ দোগে একদিন তুম সংসার কো বদল কেইনসাফ কি ডগর পে...”
অনুবাদ: শুভম সেনগুপ্ত
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct