এখানে উল্লেখ্য, নাজাফে থাকাকালীন তিনি আব্বাস মোসাভি নামক একজন ধর্মপ্রচারকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ইরান-লেবাননভিত্তিক শিয়া মতবাদের ধর্মপ্রচারক মুসা আল-সাদরের একজন ছাত্র ছিলেন মোসাভি। নাজাফে থাকার সময় মোসাভি ইরানি রাজনীতিবিদ ও শিয়া মুসলিম ধর্মগুরু রুহুল্লাহ খোমেনির রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।এই আব্বাস মোসাভি হাসান নাসরাল্লাহ’র চেয়ে আট বছরের বড় ছিলেন এবং তিনি খুব দ্রুত নাসরাল্লাহ’র জীবনে একজন কঠোর শিক্ষক ও প্রভাবশালী পরামর্শক হয়ে ওঠেন।তারা দু’জনই ইরাকের নাজাফ থেকে লেবাননে ফিরে সেখানে চলমান গৃহযুদ্ধে যোগ দেন। এসময় নাসরাল্লাহ আব্বাস মোসাভির নিজ শহর বেকা উপত্যকার একটা মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেন। ইরানে বিপ্লব এবং হেজবুল্লাহ’র উত্থানহাসান নাসরুল্লাহ লেবাননে ফেরার এক বছর পর ইরানে একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়। আব্বাস মোসাভি এবং হাসান নাসরাল্লাহ’র মতো একজন ধর্মীয় নেতা রুহুল্লাহ খোমেনি ইরানের ক্ষমতা দখল করেন।এই ঘটনা লেবাননের শিয়া মুসলিম এবং ইরানের সম্পর্ককে গভীরভাবে বদলে দেয়। দেশটির শিয়াদের রাজনৈতিক জীবন এবং সশস্ত্র সংগ্রাম ইরানের এই ঘটনা ও শিয়া মতাদর্শ দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।তবে ব্যক্তিগতভাবে হাসান নাসরাল্লাহ’র তৎকালীন ইসলামি প্রজাতন্ত্রের নেতা রুহুল্লাহ খোমেনি দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণ হল, ক্ষমতায় আসার পর ১৯৮১ সালে তিনি তেহরানে রুহুল্লাহ’র সাথে দেখা করেন।তখন খোমেইনি নাসরাল্লাহকে লেবাননে তার প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করেন। নাসরাল্লাহ’র দায়িত্ব ছিল ‘হিসবাহ’ সম্পর্কিত বিষয়াদি দেখা এবং ইসলামি তহবিল জোগাড় করা।
এই দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নাসরাল্লাহ মাঝে মাঝেই ইরানে আসা-যাওয়া শুরু করলেন। এসময় তিনি ইরান সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের এবং ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরের মানুষদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুললেন।ইরানের শিয়া মুসলিমরা লেবাননের শিয়াদের সাথে ধর্মীয় বন্ধন এবং ঐতিহাসিক রেকর্ডকে গুরুত্ব দিয়েছিলো।ইরানের শিয়াদের একতার মূলমন্ত্র ছিল পশ্চিমা বিরোধী মনোভাব, যেটি প্রচার করেছিলেন রুহুল্লাহ খোমেনি।সে সময় মধ্যপ্রাচ্যে সংবাদ প্রচারের নীতি ইসরায়েলবিরোধী রূপ ধারণ করে। সেইসাথে, ইরানের বৈদেশিক নীতিতে ‘ফিলিস্তিনি আদর্শ’ অগ্রাধিকার পেতে থাকে।এইসময় গৃহযুদ্ধ ও অস্থিরতার দ্বারা অবরুদ্ধ লেবানন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের ঘাঁটি হয়ে উঠলো। লেবাননের বৈরুত ছাড়াও দক্ষিণ লেবাননে তাদের একটা শক্ত অবস্থান ছিলো।ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতার মাঝে ইসরায়েল ১৯৮২ সালের জুন মাসে লেবানন আক্রমণ করে এবং ইসরায়েল খুব দ্রুত দেশটির গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো দখল করে নেয়। যদিও ইসরায়েল দাবী করেছে, ফিলিস্তিনি আগ্রাসনের জবাবে তারা এ হামলা চালিয়েছে। লেবাননে ইসরায়েলের হামলার কিছুদিন পর ইরাকের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ইরান। ফলে ইরানের ইসলামিক রেভোলিউশান গার্ড কর্পস (আইআরজিসি)-এর সামরিক কমান্ডাররা সিদ্ধান্ত নেন যে তারা ইরানের তত্ত্বাবধায়নে লেবাননে একটা পূর্ণাঙ্গ মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করবেন। তারা তখন এই বাহিনীর নাম দেয় ‘হেজবুল্লাহ’, যার অর্থ সৃষ্টিকর্তার দল।হেজবুল্লাহ ১৯৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। হাসান নাসরাল্লাহ, আব্বাস মোসাভি এবং আমাল মুভমেন্টের আরও কয়েকজন সদস্য একসাথে এই নবগঠিত সংগঠনটিতে যোগ দেন। তখন সংগঠনটি’র নেতৃত্ব দেন সুভি-আল-তুফায়লি নামক একজন।এদিকে, আমেরিকান বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করার কারণে এই দলটি খুব দ্রুত আঞ্চলিক রাজনীতিতে তার পদচিহ্ন তৈরি করে ফেলে।হেজবুল্লাহ’র নেতৃত্ব প্রাপ্তির দিকে নাসরুল্লাহনাসরাল্লাহ যখন হেজবুল্লাহ গ্রুপে যোগ দেন, তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। শিয়া ধর্মপ্রচারকদের মানদণ্ড অনুযায়ী, তিনি ছিলেন একদম নবীন।আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইরানের সঙ্গে নাসরাল্লাহ’র সম্পর্ক আরও গভীর হয়। তখন তিনি ধর্ম বিষয়ক পড়াশুনার জন্য ইরানের কোম শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কোমের মাদ্রাসায় থাকাকালীন নাসরাল্লাহ পার্সিয়ান ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং ইরানের অনেক রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন।এরপর যখন তিনি লেবাননে ফিরে আসেন, তখন তার এবং আব্বাস মোসাভির মাঝে মতবিরোধ দেখা দেয়। কারণ মোসাভি হাফেজ আসাদের নেতৃত্বে লেবাননে সিরিয়ার কার্যক্রম বাড়ানোকে সমর্থন দিয়েছিলেন। বিপরীতে, নাসরাল্লাহ চাচ্ছিলেন, হেজবুল্লাহ যাতে আমেরিকান এবং ইসরায়েলি সৈন্যদের আক্রমণের দিকে মনোনিবেশ করে।কিন্তু নাসরাল্লাহ’র কথা কেউ শুনছিলেন না। তিনি তখন হেজবুল্লাহ’র মাঝে নিজেকে সংখ্যালঘু হিসেবে খুঁজে পেয়েছিলেন। তবে এই ঘটনাপ্রবাহের তার কিছুদিনের মাঝে তাকে ইরানে হেজবুল্লাহ’র প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এই পদবী তাকে আবার ইরানে ফিরিয়ে নেয় এবং একইসাথে দূরেও সরিয়ে দেয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct