২০২৩ সালে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর কিয়েভ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসার খুব সহজ বিকল্প নেই। এই যখন পরিস্থিতি, তখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সেনাবাহিনীর জন্য পাঁচ লাখ সেনা নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী কয়েক মাসে এই সেনা নিয়োগ প্রক্রিয়া চলবে। জেলেনস্কির এই সিদ্ধান্তের পেছনে সংকল্প ও হতাশা—দুই-ই আছে। এই সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আরও বিভক্তির সৃষ্টি করবে। একই সঙ্গে এটি জেলেনস্কিকে তাঁর নিজের কৌশল পুনর্বিবেচনা করার জন্য সময় দেবে। লিখেছেন স্টেফান ওলফ ও জিন মিনেত।
২০২৩ সালে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর কিয়েভ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসার খুব সহজ বিকল্প নেই। এই যখন পরিস্থিতি, তখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সেনাবাহিনীর জন্য পাঁচ লাখ সেনা নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী কয়েক মাসে এই সেনা নিয়োগ প্রক্রিয়া চলবে। জেলেনস্কির এই সিদ্ধান্তের পেছনে সংকল্প ও হতাশা—দুই-ই আছে। এই সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আরও বিভক্তির সৃষ্টি করবে। একই সঙ্গে এটি জেলেনস্কিকে তাঁর নিজের কৌশল পুনর্বিবেচনা করার জন্য সময় দেবে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসন যখন শুরু হয়েছিল, সে সময় ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর লোকবল ছিল ১০ লাখ। এ দুই বছরে যুদ্ধক্ষেত্রে যে লোকবল ক্ষয় হয়েছে, তা পূরণের জন্য নিয়মিত নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর জনবল কেন একবারে ৫০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এর কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ আছে।প্রথমত, গত এক বছরে যুদ্ধক্ষেত্রে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি, এই নিয়োগ তার ইঙ্গিত। রুশ বাহিনীর বিরতিহীন হামলায় ইউক্রেনীয় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা সহায়তা কতটা স্থিতিশীল থাকবে, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছেই। কিয়েভ এখন এই হিসাব কষতে পারে যে পশ্চিমাদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ যদি কমে যায়, সেই ক্ষতি তারা পুষিয়ে নেবে যুদ্ধক্ষেত্রে লোকবল বাড়িয়ে। তৃতীয়ত, রাশিয়া সম্প্রতি ১ লাখ ৭০ হাজার নতুন সেনা নিয়োগ দিয়েছে। এখন রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীতে জনবলসংখ্যা ১৩ লাখের মতো। সে কারণে অন্তত সেনাসংখ্যার দিক থেকে মস্কোর সঙ্গে কিয়েভের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বজায় থাকুক, সেই উদ্দেশ্য থেকেই এই নিয়োগ।এই তিন কারণের সঙ্গে চতুর্থ আরেকটি কারণ থাকার সম্ভাবনা রয়ে যায়। ২০২৪ সালে রাশিয়ার দিক থেকে নতুন আক্রমণ আসার আশঙ্কা আছে। রুশ বাহিনীকে প্রতিরোধের চিন্তা থেকেই এই ঘোষণা আসতে পারে।সামাজিক ন্যায্যতা, দুর্নীতি ও সামাজিক চুক্তির ক্ষেত্র ইউক্রেনীয় সমাজের অভিজাত ও গরিবদের মধ্যে বৈষম্যটা প্রকট হচ্ছে। ইউক্রেনের অভিজাতদের মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে আস্থা এরই মধ্যে কমে এসেছে। ভবিষ্যতে আরও কমবে। ফলে যত দিন গড়াচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধ ততই দেশটির ‘গরিব মানুষের যুদ্ধ’ বলে পরিগণিত হচ্ছে।রাশিয়ার চূড়ান্ত যুদ্ধলক্ষ্য যা–ই হোক না কেন, এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, ইউক্রেনের লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া—এই চার অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই হবে তাদের দিক থেকে বাস্তবসম্মত অবস্থান।একটা বিষয় হলো, মস্কো যে সামরিক সক্ষমতা বাড়িয়েছে, তার প্রয়োগ হতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। আগামী মার্চ মাসে রাশিয়াতে সাধারণ নির্বাচন। মে মাসে আরেক দফা প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিনের অভিষেক। এ প্রেক্ষাপটেই রাশিয়ার দিক থেকে বড় আকারের আক্রমণ শুরুর আগে ইউক্রেনকে তাদের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে বড় পদক্ষেপ নিতে হবে।
নিয়োগের মতো লোক পাওয়া যাচ্ছে না
ইউক্রেনের নেতৃত্ব এখন তাঁদের কৌশলনীতি নিয়ে কম চিন্তিত। তাঁদের সব প্রচেষ্টা সেনা নিয়োগের ওপর কেন্দ্রীভূত।২০২৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর ইউক্রেনের পার্লামেন্টে দুটি সম্পূরক বিল উত্থাপন করা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত মেলে যে জেলেনস্কি ও সরকারে তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা সেনা নিয়োগের বিষয়টি কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন।সেনা নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউক্রেন যে নীতি নিয়েছে, সেটা যদি তারা প্রয়োগ করে, তাহলে এরই মধ্যে সমস্যায় জর্জরিত ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সমাজে নতুন করে চাপ তৈরি হবে।ইউক্রেনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে সশস্ত্র বাহিনীতে এত বিপুলসংখ্যক নিয়োগ স্বাভাবিকভাবেই অসম্ভব ব্যাপার। সে কারণেই সরকার নিয়োগের জন্য জবরদস্তিমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে।তালিকাভুক্ত ব্যক্তিরা যদি যোগ না দেন, তাহলে বড় অঙ্কের জরিমানা, সম্পদ জব্দ, ব্যাংক হিসাব জব্দ, বিদেশে অবস্থানরত ইউক্রেনীয় ‘শরণার্থীদের’ জন্য পাসপোর্ট জব্দ করার মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।যুক্তরাষ্ট্রের জনশক্তিভিত্তিক কোম্পানি লাটার গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় ছয় লাখের মতো ইউক্রেনীয় রয়েছেন, যাঁরা সেনাবাহিনীতে কাজ করতে সক্ষম। নববর্ষ উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে তাঁদের উদ্দেশে জেলেনস্কি বলেছেন, ‘আপনাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আপনারা শরণার্থী নাকি নাগরিক।’এর পাশাপাশি ইউক্রেনের অর্থনীতি যুদ্ধ অর্থনীতিতে রূপান্তর করারও একটা প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ড্যানিশ শিমহ্যাল সম্প্রতি নতুন অর্থনৈতিক নীতি ঘোষণা করেছেন। এই নীতিতে নাগরিকদের ওপর এবং ছোট ও মাঝারি ব্যবসার ওপর করের বাড়তি বোঝা চাপানো হয়েছে। এতে করে বড় অংশের ব্যয় করার ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমে যাবে।
সামাজিক বিভাজন তীব্র করবে
কৌশলনীতির দিক থেকে এসব পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে ইউক্রেনের জন্য প্রয়োজনীয়। বিশেষ করে ইউক্রেন যদি যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়াতে চায়, তাহলে এটা করা জরুরি।কিন্তু এসব পদক্ষেপ ইউক্রেনীয় সমাজে বড় ধরনের বিভাজনের জন্ম দিচ্ছে। সামাজিক ন্যায্যতা, দুর্নীতি ও সামাজিক চুক্তির ক্ষেত্র ইউক্রেনীয় সমাজের অভিজাত ও গরিবদের মধ্যে বৈষম্যটা প্রকট হচ্ছে। ইউক্রেনের অভিজাতদের মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে আস্থা এরই মধ্যে কমে এসেছে। ভবিষ্যতে আরও কমবে। ফলে যত দিন গড়াচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধ ততই দেশটির ‘গরিব মানুষের যুদ্ধ’ বলে পরিগণিত হচ্ছে।আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ইউক্রেনে গরিব মানুষের সংখ্যা যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। ২০২১ সালে সেখানকার মানুষের গড় আয়ু যেখানে ৬৫ বছর ছিল, সেটা এখন কমে ৫৭ বছর হয়েছে।ইউক্রেনে জন্মহার এখন পর্যন্ত খুবই নিম্ন। ২০২৩ সালে পরিবারপ্রতি শিশুর হার শূন্য দশমিক ৫৫-এ গিয়ে ঠেকেছে। যুদ্ধ শুরুর পর সবচেয়ে দক্ষ ও অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় জনগোষ্ঠীর অভিবাসী হওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। জীবনযাত্রার মান ভয়াবহভাবে কমতে দেখে ইউক্রেনের গরিব মানুষেরা প্রধানত যুদ্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
স্টেফান ওলফ,বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক,
জিন মিনেত ইউরোপীয় নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ওদেসা ল একাডেমি
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct