মোঃ সাহিদুল ইসলাম: জীবন ধারণের অন্যতম উৎস হলো খাদ্য ও পুষ্টি। খাদ্য-গ্রহণ-সুবিধার নিরিখে নির্ধারিত হয়েছে দারিদ্র পরিমাপক সূচক। যদিও এই সূচক রাজ্য এবং গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চল বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন। বর্তমান পরিস্থিতে যদি দেখা যায়, ভারতবর্ষে এখনো শতকরা ২০ জন মানুষ গরিব। এটা খুব আশ্চর্যের বিষয় যে, একবিংশ শতাব্দীতে, যেখানে ভারত চাঁদের মাটিতে পা রেখে গোটা বিশ্বকে তাক লাগাচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষুধার্ত তালিকাতে বিশ্বের সামনে হাস্যকর হয়ে উঠছে আমাদের ভারতবর্ষ। ২০২৩ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স অনুযায়ী ভারতবর্ষ ১১১তম স্থানাধিকারী বিশ্বের ১২৫ টা দেশের মধ্যে। ২০২২ সালে এই স্থান ছিল ১০৭।
পশ্চিমবঙ্গ চতুর্থ জনবহুল রাজ্য। বিশ্ব ব্যাঙ্ক গ্রুপ অনুসারে, রাজ্যের শতকরা ২০ জনেরও বেশি মানুষ দারিদ্রতার শিকার এবং দারিদ্রতার চরমসীমা বেশ কয়েকটি জেলায় খুব বেশি। গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা শহরাঞ্চলের তুলনায় তিনগুন বেশি। সামাজিক প্রগ্রতির নিরিখে যদি দেখি, আমাদের সোনার বাংলার ছবি খুব একটা সন্তোষজনক নয়। পশ্চিমবঙ্গ, দেশের সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত রাজ্যের মধ্যে, “নিম্ন-মধ্য শ্রেণী”তে ২৫তম স্থানে আছে।
একটা গবেষণাপত্র “খাদ্য অসুরক্ষা”র (আবুল বাসার ও দাস, ২০১৮) নিরিখে, ২০১২ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলার ২০ শতাংশ মানুষ খাদ্যের ব্যাপারে অনিশ্চিত ও অসুরিক্ষিত। গ্রামাঞ্চলে এর প্রভাব আরো বেশি, প্রায় ২২ শতাংশেরও বেশি মানুষ শিকার। অন্য আরেকটি রিপোর্টে (হাঙ্গার ওয়াচ রিপোর্ট, ২০২১ )প্রকাশিত যে ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ অন্তত দিনে একবার “খাবার”/”মিল” ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
খাদ্য ও পুষ্টির অনিশ্চয়তার প্রকট এবং কুপ্রভাব সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে গ্রাস করে চলেছে। একটু চোখ খুলে তাকালেই আমরা সমাজের বিভিন্ন স্থানে যেমন, হাসপাতালের লম্বা বহিঃ বিভাগ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা রুগীদের ভিড় বা নবজাতক শিশু বিভাগে ভর্তি শিশুর ভিড় , রেল স্টেশনে বেসাহারা অপুষ্টিক শিশুদের ভিড়, কোনো লোকাল বা অন্ত:রাজ্য ট্রেনের জেনারেল কোচ ভর্তি মানুষের ভিড়, গ্রামাঞ্চলের কোনো রাস্তার মোড়ে বসা থাকা বৃদ্ধ মানুষের ভিড় বা সরকারি স্কুলে যাওয়া শিশুদের দিকে তাকালেই খুব সহজেই দেখতে পায় স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অবস্থা। আমাদের সোনার বাংলা যাচ্ছে কোন দিশাতে, কোন পথে, কিসের এত উন্নতির জনজোয়ার?
সোনার বাংলার দিশেহারা উন্নতি কি আমাদের অতীত ইতিহাসকে মনে করিয়ে দিচ্ছে? সেই সময়টা, ঠিক দ্বিতীয় বিশ্বের যুদ্ধের পরের বাংলা-দুর্ভিক্ষ, মহামারীর কথা (1943)? যে মহামারী প্রায় ৩০ লক্ষ্যের ও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে? আরেকটু অতীতে যদি দেখি তাহলে কি ভয়াবহ ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের (The Great Bengal famine,1770) কথা মনে করে দেয়?
ঠিক একই লাইনে যখন ১৯৬০ এর দশকে, বিভিন্ন অন্ত:রাষ্ট্রিয় যুদ্ধ ও খরার কবলে, ভারতবর্ষকে খাদ্য সংকটের হাত থেকে রক্ষা পেতে সবুজ বিপ্লব ঘটিয়ে ছিল অধ্যাপক MS স্বামীনাথন। যার মাধ্যমে বিপুল পরিমান গম ও ধানের উৎপাদন বাড়িয়ে দেশকে একটা নতুন দিশা দেখিয়েছেন। দেশকে খাদ্য-নির্ভর করে ফুড কার্পরার্শন অফ ইন্ডিয়া (FCI) বানিয়ে দেশের প্রতি প্রান্তের মানুষের কাছে খাদ্য-শস্য নিয়ে পোঁছেছে। এর ফলস্বরূপ পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছে “পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম” অর্থাৎ রেশন-দোকান। সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প ও খাদ্য শস্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন বর্গের মানুষের কাছে এসেছে। কিন্তু আজ সোনার বাংলাই “রেশন-দোকান” বা পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (PDS) কে নিয়ে যে নোংরামি ও দুর্নীতি চলছে তা অবর্ণনীয়। মানুষের খাবার কেড়ে নেওয়ার খেলা?
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে ২০ হাজারেরও বেশি “রেশন-দোকান” আছে যার মাধ্যমে শহর ও গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন খাদ্য-দ্রব যেমন চাল, গম, বিসকুট, সাবান, লবন ও কেরোসিন তেল ইত্যাদি স্বল্প মূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে এবং কম বেশি সব শ্রেণীর মানুষ এইসব সুবিধা গুলো নিয়ে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কিসের নিরিখে কে কত পরিমান খাদ্য-দ্রব-সামগ্রী পাবে, তার হিসাব কে জানে? পিছিয়ে পড়া গরিব পরিবার টি কি তার “অধিকার” মতো খাদ্য-সামগ্রী পায়? সর্বোপরি, যার যেমন অর্থ-সামাজিক অবস্থা অনুযায়ী কি রেশন কার্ড পেয়েছে? এর খুব সহজ-অকপট উত্তর হিসেবে বলতে পারি “না”।
অতএব, শুধুমাত্র ‘রেশন-দোকান’ এর সংখ্যা বাড়িয়ে বা ডিজিটাল কার্ড করে দিলেই যে দুর্নীতি বন্ধ হবে সেটা নয়, সেই সাথে সাথে অর্থ-সামাজিক অবস্থা অনুযায়ী “রেশন-কার্ড” পুনঃবিতরণের ব্যবস্থা করা খুব প্রয়োজন। মানুষের অধিকারের জন্যে সজাগতা বাড়াতে হবে। বলাবাহুল্য, প্রত্যেক রেশন-ডিলারদের বাৎসরিক আর্থিক মূল্যাঙ্ক বা অডিট অপরিহার্য করা। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান গুলোকে যুক্ত করে সামাজিক মূল্যাঙ্ক বা সোশ্যাল অডিটের ব্যবস্থা করা। সর্বোপরি, সাপ্তাহিক বা মাসিক “রেশন-দ্রব্যের” নির্ধারিত পরিমান রেশন-দোকান অনুযায়ী পাবলিক ডোমেইনে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে , যেকোনো সময় যেকোনো নাগরিক সেগুলোকে দেখতে পারে।
লেখক গবেষক, ইনস্টিটিউট অফ রুরাল ম্যানেজমেন্ট আনন্দ, গুজরাট
(মতামত লেখকের নিজস্ব।)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct