আধুনিকতার গ্যাঁড়াকল ও শিক্ষা-ব্যবস্থা
সাহানাজ ইয়াসমিন মুনমুন
বিশ্ব জুড়ে চলছে এখন আধুনিকতার,আমরা সেই জোয়ারেই ভেসে চলেছি দুনির্বার!যুগ বদলেছে রুচি,বদলেছে শিক্ষার ধরন ও পরিকাঠামোর বদল হয়েছে।বর্তমান শিক্ষা আজ বড়ই প্রতিযোগিতামুখী।এই প্রতিযোগিতার দৌড়ে শিক্ষা গ্রহণের মূল উদ্দ্যেশ্যটাই কোথাও গিয়ে চাপা পড়ে যাচ্ছে।যে কারণে মূল্যবোধের অভাব দেখা দিচ্ছে,এবং তার স্পষ্ট ফলাফল প্রত্যক্ষমান।পুঁথিগত শিক্ষা অর্জন হচ্ছে বৈকি কিন্তু সেক্ষেত্রে নীতি শিক্ষার চরম অভাব রয়েছে। যা আদর্শশিক্ষার ইঙ্গিত বহন করেনা এবং যা কখনই শিক্ষার সুফল নয়। বর্তমানে শিক্ষা ও অশিক্ষার পৃথকীকরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।এই যাবৎ শিক্ষা অর্জন করে আমরা আদৌ কতটুকু সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছি বা পারছি জানিনা তবে,আমরা দিনের পর দিন আদর্শ,নীতি, নৈতিক শিক্ষার মূল স্রোত থেকে সরে যাচ্ছি সেটা স্পষ্ট ।হয়তো একটিবারের জন্য হলেও আমাদের কারোর মনে কখনো এই প্রশ্নটা জাগছে না,যে আদৌ কি আমরা মানুষের মত মানুষ হতে পারছি বা মানুষ গড়ে তুলতে পারছি?আমরা,এ কোন শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি আর কোন শিক্ষায় আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে গড়ে তুলছি?যেখানে শিক্ষার নামে,প্রতিযোগিতার দৌড়ে,আমরা দিনের পর দিন কেবল একেকটা যন্ত্র তৈরি হচ্ছি এবং একেকটা যন্ত্র তৈরি করে চলেছি! প্রকৃতপক্ষে,মানুষ নামের একেকটা আধুনিক রোবট গড়ছি! আর বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই!সামাজিকতা,আদর্শ,ন্যায় নীতি বোধ,এসব আজ আর কোথায়?কত জনের মধ্যেই বা দেখতে পাই?জীবনের উদ্দ্যেশ্য ও তার সঠিক মূল্যায়ন এবং মূল্যবোধের অভাবে,আজকের আধুনিক যুগের ছেলে মেয়েদের মধ্যে,সহবৎ শিক্ষার পাশাপাশি,সুশীল, শালীন, সভ্য আচরণ প্রদর্শন এবং পারস্পারিক সম্পর্ক তথা ভাতৃত্ববোধের অভাব দেখা দিচ্ছে । তাদের উপর বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি তথা পরিবেশগত বহু পারিপার্শ্বিক কুপ্রভাব পড়ার কারণে,তারা মানবিকতার আদর্শ জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সভ্যতার উন্নতির নামে,আধুনিকতার নামে,তাদেরকে শিক্ষার মূল স্রোত থেকে,জীবনের প্রকৃত মূলস্রোত থেকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।এসবের মূলে,সব চাইতে বড় কারন হচ্ছে বর্তমান সময়ের এই দুরন্ত গতিবিধি এবং এই বিষাক্ত ভয়ানক সামাজিক পরিবেশ।বর্তমান সময়টা একটু বেশিই কৃত্রিমতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।পাশাপাশি,বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনো রকম জ্ঞানমূলক নীতি শিক্ষার পরিকাঠামো না থাকাটাও একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ অবশ্যই।পুঁথিগত শিক্ষার বাইরে আলাদা করে আদর্শ শিক্ষার কোনো পাঠ ব্যবস্থা নেই।পাঠ্য পুস্তক বইগুলো পড়ার পাশাপাশি অন্যান্য আরো জ্ঞানমূলক শিক্ষাগুলোকে একেবারেই গুরুত্ব না দেওয়া।এক কথায় বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় নীতি শিক্ষার বিষয়টি পুরোপুরিভাবে উপেক্ষিত হয়ে যাওয়ার ফলে, আধুনিকতার নামে বেড়ে ওঠা আজকালকার ছেলে মেয়েদের মধ্যে ঐদ্ধত্য,বিশৃঙ্খলতা,নীচতা,হীনমন্যতা আত্ম অহংকার,অতি উচ্চ’আকাঙ্খা, পারস্পরিক বিদ্বেষ,প্রতিদ্বন্দ্বীতা ইত্যাদি নানান ধ্বংসাত্মক খারাপ দিক তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং তারা দিনের পর দিন দিক ভ্রান্ত হয়ে পড়ছে।এমতাবস্থায়,তারা নিজেরাও নিজেদের পরিস্থিতি বুঝে উঠতে ব্যার্থ।শিক্ষার আলোর পরিবর্তে আসলে তারা অন্ধকারের দিকেই ধাবিত হচ্ছে এবং জীবনের মূল স্রোত থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছে সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই।সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে,জীবন যাপনের মান অতি উন্নত করার দৌড়ে মানুষ হয়ে ওঠাটা প্রায় কঠিন হয়ে পড়েছে আজকাল,আর সেইসঙ্গে আগামীর প্রজন্মকেও প্রতিনিয়ত বিপথগামীও বিপদমুখী করে তোলার পরিস্থিতি তৈরী করে দেওয়া হচ্ছে।বর্তমানের এই উশৃঙ্খল পরিবেশের কারণে সামাজিক বহু অঘটন সৃষ্ঠ হচ্ছে যা রীতিমত চিন্তার বিষয় বৈকি। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের উচ্চাকাঙ্খার ফলে ব্যর্থতা থেকে,আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা এবং হতাশায় ভুগতে ভুগতে শেষ পর্যন্ত অকালে প্রাণঘাতী হওয়ার বহু ঘটনাও ওহরহ প্রায় সামনে আসতেই আছে। এই সকল ঘটনা গুলোর পশ্চাতে অন্যান্য আরো কারণ ছাড়াও মিডিয়াও কিন্তু অনেক খানিই দায়ী। মিডিয়ার ভুল প্রয়োগ তারা বেশিই করে ফেলছে।
বহুক্ষেত্রে মিডিয়া তাদেরকে ভ্রান্ত পথে নিয়ে যাচ্ছে।বাবা মায়েরাও নিজেদের অজান্তেই তাদের ছেলে মেয়েদের উপর চাপ সৃষ্টি করে থাকে।তাদের স্বপ্ন আশা বর্তমানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদের সন্তানদের সেরার সেরা হতেই হবে।সবার চাইতে বেশি নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হতে হবে। কোনরকম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই তাদের সন্তানদের মধ্যে প্রতিযোগীতার বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে ।তাদেরকে জীবনের মূল্যবোধ শেখানোর জায়গায়,মানুষের মত মানুষ করে,বেড়ে উঠতে দেওয়ায় জায়গায়,তাদেরকে প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দিয়ে তারা যে তাদের সন্তানদের উপর রীতিমত মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে সেই বিষয়ে তারা অবগত হতে পারছেন না। এক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত ভালো হওয়ার জায়গায় আরো খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে সেটা তারা বিচার করে দেখতে ব্যার্থ।অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে অতিরিক্ত চাপের মুখোমুখি হয়ে বহু ছাত্র ছাত্রী আত্মহত্যার মত পথ বেছে নিতে পর্যন্ত বাধ্য হয়েছে।অনেকেই ছাত্র জীবনেই স্থায়ী ডিপ্রেশনে চলে যায়, এমন দৃষ্টান্তও সামনে আসে বহু সময়।সন্তানদের প্রতি বাবা মায়েরদের অতিরিক্ত উচ্চ আকাঙ্খা থেকে তাদের উপর বেশি চাপ সৃষ্টি করায় এসব ঘটনা গুলো বেশিরভাগ ঘটে থাকে। হ্যাঁ নিশ্চয় বাবা মায়েদের নজর থাকবে তাদের সন্তানদের প্রতিটি পদক্ষেপে,তবে তাদেরকেও তাদের মত করে বুঝতে হবে,তাদের মত করে বাঁচতে দিতে হবে।নিজেদের কোন সিদ্ধান্ত তাদের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দিয়ে,মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে গেলেই হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের ইচ্ছেগুলোকে চাপিয়ে দিয়ে কখনোই কোন সফলতা কাম্য নয়।তাদের চাওয়া,তাদের মানসিকতা কি,সেগুলো ভালো দিক নাকি মন্দ দিক সেগুলোকে বুঝতে হবে আগে এবং তাদের ভাবনা অনুযায়ী খুব যত্ন সহকারে ভালো মন্দ বিচার করে বাবা মায়েরা যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়,সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে তবে তারাও তাদের বাবা মায়ের উপর আস্থা রাখতে পারবে। তাদের মনের কথা,তাদের ইচ্ছের কথা বন্ধুর মত করে বাবা মায়েদের বলতে পারবে,আলোচনা করতে সক্ষম হবে তারা। এককথায় চাপ দিয়ে নয় তাদেরকে বুঝিয়ে বলতে হবে। তাতে করে বাবা মায়েদের প্রতি সন্তানদের ক্ষোভ,আক্ষেপ, বিরূপ চিন্তা ভাবনা এগুলো তৈরি হবে না বরং তাদের উপর আশ্বস্থ হয়ে তাদের কথা মেনেও চলবে।তাই সামাজিক পরিবর্তনটা বাবা মায়ের থেকেই শুরু হোক। ঘরের পরিবেশ থেকে সুশিক্ষার শুরু হোক এবং সমাজের প্রত্যেকটি কোনায় কোনায় সেই আলো ছড়িয়ে পড়ুক।সুতরাং সময় থাকতেই সচেতনতা বাড়াতে হবে, চিন্তাধারার বদল করতে হবে।সঠিক পন্থা অবলম্বন করে এর রাশ টানা সম্ভব না হলে বর্তমান প্রজন্ম এবং আগামীর প্রজন্ম রক্ষা পাবেনা।যুব সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে যথা সময়ে সঠিক চিন্তাধারা ও সুপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে আমাদের সকলকেই।আশা করি সুশীল,সভ্য সমাজ গড়ে ওঠার লক্ষে, আলোর সন্ধান পেতে আমরা সকলেই একসাথে এগিয়ে চলবো।অবশেষে আমরা সেই লক্ষ্যে অবশ্যই পৌঁছতে পারবো।
(মতামত লেখিকার নিজস্ব)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct