নগর
আহমদ রাজু
‘হেয়ালী করছি না। আমি সিরিয়াস।’‘দেখো; কিছু কিছু মজা অনেক সময় ভাল লাগে না।’ বলল নেহা। তার চোখ-মুখ দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, সে সত্যিই সিরিয়াস।‘আমার মেয়ে মজা করবে কেন? সে সত্যি কথা বলছে। তুমি কি এমন এনেছো যে তার কাছে থাকবে? তাছাড়া যৎসামান্য রেখেছিলে তা এতদিনে শেষ হয়ে গেছে।’ বলল তরিমন বিবি।‘মা, আমিতো প্রায় তিন লাখ টাকা নিয়ে এসেছিলাম। যা সবই আপনার মেয়ের কাছে। এখন অস্বীকার করছে কেন?’‘তুই বের হ। বিয়ে করেছিস, পারলে বাড়ি ফিরে গহনা দিয়ে সাজিয়ে আমার মেয়েকে স্ব-সম্মানে বাড়ি নিয়ে যা। আর উচিৎ হবে তোর এ মুখো না হওয়া। তোর মরদ আমাদের জানা হয়ে গেছে।’হঠাৎ যেন আকাশ থেকে পড়ে সুমন। তরিমন বিবির মুখ থেকে তুই শব্দ, সাথে কঠোর এবং কঠিন শব্দ তাকে অন্য কিছু ভাবতে সহায়তা করে। সে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।‘যদি ভাল চাস তো এখনি ঘর থেকে বের হ। আর হ্যাঁ, যদি এমন তেমন করিস তো যৌতুকের মামলা ঠুকে দেবো। তখন বিদেশ যাবার সব রাস্তা বন্ধ তো হবেই সাথে চৌদ্দ শিকে গুনতে হবে আজীবন।’সুমনের আর বুঝতে বাকি থাকে না সে কোন ফাঁদে পড়েছে। একদিকে দরিদ্র বাবা- মাকে না জানিয়ে, তাদের কথা অমান্য করে দেশে ফিরে বিয়ে করেছে! অন্যদিকে এতদিনের সকল সঞ্চয় খুইয়েছে! সে লোক লজ্জার ভয়ে ঘটে যাওয়া অবিবেচক কাহিনীকে গোপন করে নিজের বাড়িতে ফিরে স্বাভাবিক হতে বৃথা চেষ্টা করে। নেহাকেও ভুলে যেতে চায়, কিছু একটা হয়েছিল একদিন।নেহা আবারো স্বাধীন। সে জীবনকে উপভোগ করে একান্ত নিজস্ব মানসিকতায়। যেখানে জড়তা নেই- ভিরুতা নেই। সমান্তরাল রেল লাইনের মতো তার সে গতি। বেশ কিছুদিন থেকে এলাকার দলীয় নেতা ডেগার পলাশের সাথে দহরম মহরম নেহার। যা অল্প ক’দিনের মধ্যে বিয়েতে গড়ায়। সুমনের সাথে বিয়ের কথা এলাকার লোক জানলেও তাতে কোন কিছু আটকায় নি। লোকে জানে সুমন কাউকে কিছু না জানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। তার সাথে তালাক হয়েছে কি হয়নি এমন প্রশ্ন মানুষের মনের মধ্যে ঘুরপাক খেলেও মুখে প্রকাশ করে না। ডেগার পলাশ অবশ্য এ ব্যাপারে মোটেও মাথা ঘামায় না। তার চাওয়া নেহাকে; যা সে পেয়েছে। এখন আগের স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হয়েছে কী হয়নি তাতে কী আসে যায়!এক মাস না পেরোতে ঘটে বিপত্তি। এক সন্ধ্যায় ছোটা কাদেরের সাথে আপত্তিকর অবস্থায় নেহাতে দেখতে পায় ডেগার পলাশ। যে কিনা তার বিশ্বস্ত সাগরেদ! সাথে সাথে ছোটা কাদেরের বুকে মাথায় দু’টি গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। কী যেন কী ভেবে নেহাকে সে মারে না। তবে তখনই বাড়ি থেকে বের করে দেয়। বলে, ‘যেহেতু তোকে আমি ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম তাই তোকে আমি মারবো না। তবে কাল সকাল হলে যেন এই নগরে আর না দেখি। না হলে নতুন এক ইতিহাস রচিত হবে।’গুলির শব্দ তখনই চারিদিকে চাউর হয়ে যায়। পুলিশ ক্ষণেক পরেই ডেগার পলাশকে গ্রেফতার করে। নেহাকে পুলিশ হেফাজতে নিলেও রাত বারোটার দিকে নগর ছেড়ে যাবেনা মর্মে সতর্ক করে ছেড়ে দেয়। সে বাড়ি ফিরে এলেও অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরে। তরিমন বিবি বলে, ‘যা করবি বুঝে সুঝে করবি তো নাকি।’ তরিমন বিবির কথায় মনে হয় খুন, গুলি করা, মৃত্যু ইত্যাদি খুব সহজ ব্যাপার। যেন কিছু ঘটেইনি। নেহার বেঁচে থাকা একদম স্বাভাবিক। মনের কোণে তার কোনরূপ দাগ কাটে না।
‘আমি কি জানতাম লোকটা ওই সময় বাড়িতে ফিরে আসবে।’ বলল নেহা।
‘কোন লোকটার কথা বলছিস?’ প্রশ্ন তরিমন বিবির।
‘যাকে নিয়ে ঘটনা।’
‘ওহো তাই বল।’
‘কি হয়েছিল বলতো?’
‘কি আর হবে, ছোটা কাদেরের সাথে তোমার জামাই দেখে ফেলেছিল। তাই সে রাগের মাথায় ছোটা কাদেরকে গুলি করে মেরেছে।’
‘আর জামাইও না; মাথা ঠিক রাখতে পারে না একদম। এখন জেলের ঘানি টানো।’ বলল তরিমন বিবি।
‘মা তুমি যাওতো, আমাকে একটু একা থাকতে দাও।’
‘সে তুই থাক, তা ওই বাড়ি ছেড়ে এখানে আসলি কেন?’
‘তোমার জামাই আমাকে শাসিয়েছে। ও বাড়ি মুখো যেন আমি না যাই। শুধু কি তাই, সে বলেছে এই মহল্লায় যেন আমাকে আর দেখা না যায়।’
‘তা তুই কি চিন্তা করলি?’
‘মা তুমি একটু যাওতো; আমাকে ভাবতে দাও।’নেহা চেয়ারে বসেছিল আর তরিমন বিবি ছিল খাটের ওপর মুখোমুখি। খাটের ওপর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কি ভাববি তা জানিনে। তুই কাল সকালেই ওই বাড়িতে যাবি। যা নেবার মতো তা নিয়ে আয়। এখানে-এই এলাকায় আর থাকার পরিবেশ নেই।’নেহা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। বলল, ‘হুম, দেখি।’
‘তাই দেখ।’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় তরিমন বিবি। নেহা ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে যায়। বয়রা থেকে টুটপাড়া বেশি দূর নয়। তবুও এই নগরে কে কার খবর রাখে। তবে এখানে খবরেরও খবর হয়। অনেক ভেবেচিন্তে তরিমন বিবি আর নেহা যখন বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করে তখন পথঘাট একেবারে অচেনা তাদের কাছে। আর আজ সবকিছু মনে হয় বড় আপন- মোড়ের রাস্তা, সোডিয়াম লাইট, পাড়ার মুদির দোকান, গলির মাথায় ছেলেদের আড্ডা, আরো কত কী। শুধু নতুন বলতে নেহার কাছে এই বিয়েটা-ই। কিন্তু কেন? কেন এমন মনে হচ্ছে তার? যদিও এলাকার সবাই জানে নেহার এটিই প্রথম বিয়ে। আগে-পাছে তার কিছু ছিল না নেই। তাদের জানাটাকে নেহা সম্মান জানায় সময়ের বাজারে। অবশ্য নেহা কিম্বা তরিমন বিবি কাউকে কিছু বুঝতেই দেয়নি। নেহার যে প্রবাসী এক যুবকের সাথে মন দেয়া-নেয়া চলছে তাই-ই বা কে জানতো! যারা নেহাকে হৃদয়ের গভীরে ভাসিয়ে রেখেছিল তাদের হৃদয় আজ খাঁ খাঁ মরুভূমি। কারো কিছু বলার নেই। তারা শুধু সময়ের স্রোতে ভেসে হা-হুতাশ করতে পারবে নয়তো নিরবে ভালোবাসাকে জলাঞ্জলি দিতে হবে জলাতঙ্ক রোগের মতো। তবে মুখ থেকে রা’ শব্দটাও উচ্চারণ করা যাবে না। পাতি নেতা, গলির মাস্তান- থেকে শুরু করে বড় নেতা কার সাথে নেই দহরম মহরম নেহার!বিয়ের অনুষ্ঠানে যারা এসেছিল তারা সবাই খুশি। আয়োজন খুব সুন্দর হয়েছে। অনুষ্ঠান কমিউনিটি সেন্টারে। আর কমিউনিটি সেন্টারের অনুষ্ঠান হয় পরিপাটি। বাড়তি যোগ হয়েছে নেহার বিয়ে বলে। এলাকার প্রথম শ্রেণীর যারা তারা সবাই এসেছে বিয়েতে। পুলিশের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী। এমনকি নগর পিতাও বাদ যায়নি তার থেকে। সংবাদপত্রের পাতায় জায়গা করে নেয় বিয়ের কথা-ছবি। আসলে এতটা করতে চায়নি নেহা। কিন্তু কিভাবে কী হয়ে গেল তা সে নিজেও জানে না। মনে মনে যেমনটা চেয়েছিল হয়েছে তার উল্টো। কেন এমন হলো? তার প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল করতে বেশ বেগ পেতে হবে। বিশেষ করে যখন সবাই জেনে গেছে তখন সবকিছু ভেবেচিন্তে করতে হবে। তবে এই বিয়েটা নেহার মনটাকে পুলকিত করেছে প্রথম থেকে। তার কাছে মনে হয়েছে এবারই প্রথম সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে! কেন? কেন হচ্ছে এমন? নিজের কাছে অনেকবার প্রশ্ন করেছে যার উত্তর সে একবারও পায় না। রায়হান কবিরকে তার প্রকৃত স্বামী বলে মনে হচ্ছে। মনটাকে কিছুতেই বশে আনতে পারছে না নেহা। ইতিমধ্যে দুই দিন পেরিয়ে গেছে। রায়হান কবির কিছুক্ষণ আগে বাইরে গিয়েছে। তরিমন বিবি নেহাকে ডেকে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘তোর কী কোন আক্কেল জ্ঞান হবে না।’ বিস্মিত নেহা। বলল, ‘কী মা, আমি আবার কী করলাম?’
‘মনে হচ্ছে সংসার পেতেছিস একদম যে...!’
‘আমিতো বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে।’
‘তোরে মনে হয় ছেলেটা জাদু করেছে।’
‘তা হবে হয়তো। আমি মনে হয় রায়হানের কাছে ফেসে গেলাম।’
‘বলিস কি! কী কুক্ষণে কথা...’
‘আমি কী করবো মা?’
‘কী আর করবি? বাসায় ফিরলে বলবি, সে যেন তোকে বাড়ি নিয়ে যায়।’
‘সে গতকালই বলেছিল, আমিই বলেছিলাম কিছুদিন পর যাবো।’
‘টাকা-পয়সা সব তোর আয়ত্বে নিয়েছিস তো?’‘তা নিইনি। পারছিনা মা। আমার মনে হয় ওর সাথে আমি অন্যায় কিছু করতে পারবো না।’ বলল নেহা। নেহা প্রশ্ন করে করে নিজেকে জর্জরিত করে ফেলেছে তবুও কোন উত্তর সে পাইনা। যা পেয়েছে তা হলো, ‘অনেক কিছু হয়েছে এতদিনে, এখন সংসার।’সকালে নেহার যখন ঘুম ভাঙে তখন সকাল ন’টা। রায়হান কবির বিছানায় নেই। কোথায় গেল লোকটা। ‘রায়হান, রায়হান..’ কোন উত্তর নেই। সে উঠে বাথরুমে খোঁজে, বাইরে দেখে। নাহ কোথাও নেই। ‘মা, তোমার জামাইকে কি দেখেছো? তাকে তো দেখছি না।’ মা কে উদ্দেশ্য করে বলল নেহা।‘না তো। আছে হয়তো কোথাও।’ সরল উত্তর তরিমন বিবির।বড় অস্থির লাগে নেহার। সে ঘরে ঢুকতেই বালিশের ওপর ভাঁজ করা ছোট্ট একটা কাগজের দিকে নজর যায়। সে তড়িৎ হাতে তুলে নেয় সেটা। ভাঁজ খুলে দেখে তাকে উদ্দেশ্য করে রায়হার কবিরের লেখা চিঠি।
‘নেহা,
আমি দুবাই ফিরে গেলাম। আমার যতটুকু ভুল ক্ষমা করে দিও। আমি যে নতুন নাগর তা তোমার আগের দু’জন স্বামীর কাছ থেকে জেনেছি। শুধু জেনেছি বললেই ভুল হবে, নিজের বিশ্বাসকে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস দিতে একজনের বাড়িতে পর্যন্ত আমি গিয়েছিলাম। তোমার অনেকগুলো ছবি দেখে সে বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে। আইন অনুযায়ী কাবিন নামার টাকা তোমার বালিশের তলায় রাখা আছে। আশাকরি যা চেয়েছো তা সহজেই পেয়েছো।
-রায়হান কবির’
ইতিমধ্যে চোখ ছলছল করে ওঠে নেহার। সে নিজেকে আটকিয়ে রাখতে পারে না। শব্দ করে কেঁদে ওঠে। যে কান্নায় প্রথম প্রকাশিত হয় ভালোবাসা, বিরহ আর আপন থেকে আপনতর হয় নগরে নতুন নাগর।
সমাপ্ত....
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct