কেন্দ্রের মসনদে দ্বিতীয়বারের মতো ‘সম্রাটের’ ভূমিকায় নরেন্দ্র মোদি। তার শাসনামলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি তলানিতে, বৃদ্ধি পেয়েছে বিদ্বেষের মাত্রা। যদিও নির্বাচনে ডাক দিয়েছিলেন ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। বাস্তবে তার যথার্থ প্রতিফলন না ঘটলেও প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে নিজের ইমেজ তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। তা নিয়ে আলোকপাত করেছেন ড. দিলীপ মজুমদার।
জুমলার পর জুমলার পর জুমলা
পার্বতী কুণ্ডে একাগ্র চিত্তে তাঁর পূজা দেওয়ার দৃশ্য ধরা হয় ড্রোন ক্যামেরায়। পুজো করার পর তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিটি ভারতবাসীর সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রার্থনা করছি। উন্নত ভারতের প্রতিজ্ঞাকে আরো শক্তিশালী করার জন্যও প্রার্থনা করেছি। উত্তরাখণ্ডের মানুষের আশা-আকাঙ্খা যাতে পূরণ হয় সে জন্য আশীর্বাদ চেয়েছি।‘ পিথোরাগড়ের পার্বতী কুণ্ডের পাশে শিব-পার্বতী মন্দিরেও আরতি করেন প্রধানমন্ত্রী। শঙ্খ, ঘন্টা এবং ডুগডুগি বাজিয়ে পূজার্চনা করতে দেখা যায় তাঁকে। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর এক্স হ্যান্ডেলে পিথোরাগড়ের টলটলে নীল জলের পার্বতী কুণ্ডের সামনে অভিনব পোশাকে তুষারপর্বতঘেরা প্রকৃতির মাঝে প্রণামের মুদ্রায় মোদির ছবি পোস্ট করা হয়েছে। অন্য একটি ছবিতে ধ্যানমুদ্রায় দেখা গিয়েছে তাঁকে। সোশাল মিডিয়ার পোস্টে আরও একটি ছবিতে গর্ভগৃহে দেবতার আরতি করতে দেখা গিয়েছে মোদিকে। মন্দির প্রদক্ষিণ করতেও দেখা গিয়েছে।হিন্দুত্বের যে রেশ আজ উত্তরাখণ্ড থেকে ছড়িয়ে দিতে শুরু করলেন মোদি, তা নভেম্বরের বিধানসভা ভোটগুলিতে আরও প্রখর হবে বলে মনে করা হচ্ছে। অক্টোবরের শেষে দশেরার দিনে চিরাচরিত রাবণ, কুম্ভকর্ণ এবং মেঘনাদের পাশাপাশি আরও একটি পুত্তলিকা তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, রাম তাকে বাণে বাণে বিদ্ধ করবেন। সেটি সনাতন ধর্মবিরোধিদের পুতুল। দিল্লিতে রামলীলা সংগঠনের সর্বোচ্চ সংগঠন শ্রীরামলীলা মহাসঙ্ঘের সভাপতি অর্জুন কুমারের কথায়, ‘ রামায়ণের চরিত্রদের উচ্চতা রাখা হবে ৮০ থেকে ১০০ ফুট। সনাতন ধর্মবিরোধীদের পুত্তলিকা আকারে ছোট হবে, ১৫ ফুটের মধ্যে। কিন্তু দেড়শোর বেশি সংখ্যায় তা রাখা হবে। ‘তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের ছেলে উদয়নিধির সনাতন ধর্ম প্রসঙ্গে বিতর্কিত মন্তব্যের পরেই বিষয়টিকে প্রচারের হাতিয়ার করে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নেয় বিজেপি। এতে মেরুকরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক লাভ হতে পারে অনুমান করে এই প্রচারকে ধীরে ধীরে তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
......................................
জুমলা মানে মিথ্যে আশা , ঢপের কীর্তন।
জুমলা শুনে মানুষের মন উচাটন।
ফকিরের জুমলাবাজি অমৃত সমান।
নরেন্দ্র মোদির কথা শুনে পুণ্যবান।
কি সুন্দর বলো তুমি মিথ্যেকথাগুলি।
সমালোচকেরা মরে করে চুলোচুলি।
সুগঠিত দেহ তব মেঘমন্দ্র স্বর।
বুড়বক জনতা সেই ম্যাজিক নির্ভর।
‘মিত্রোঁ’ বলে ডাক দাও মানুষ উদ্বেল।
অকাতরে মিথ্যে গেলে বিচিত্র সে খেল।
নোটবন্দি করে দিলে এক লহমায়।
কালোটাকা নর্দমায় গড়াগড়ি যায়।
তুমি নাকি চৌকিদার অতন্দ্র পাহারা।
চৌকিদার চোর হ্যায় বলে যে কাহারা।
মায়াময় অচ্ছে দিন দেখিতে না পাই।
তাথৈ তাথৈ নাচে জগাই মাধাই।
না যদি দেখিতে পাও সে তোমার দোষ।
অচ্ছে দিন আছে আছে ভক্ত দিলখোস।
সব কা সাথ আছো তুমি ওহে বিশ্বগুরু।
সব কা বিকাশ চাও হবে তার শুরু।
হতে হতে দিন যায় তখন আবার।
ঝুলি থেকে টান মারো নব জুমলার।
সব কা মানে আম্বানির , সব কা আদানির।
যা চায় পাবে যে তারা ওহে তপোধীর।
ব্র্যাণ্ড ফকিরের কথা শুনে পুণ্যবান।
তাহার জুমলাবাজি অমৃত সমান।
জয় জয় জুমলাবাজি জয় জুমলাবাজ।
নতুন জুমলার তরে নব বেশে সাজ।
।। প্রথম তরঙ্গ।
নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার আগে পটভূমি প্রস্তুত ছিল। তার আগের কংগ্রেসি শাসন সেই পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল অচেতনভাবে। প্রধানমন্ত্রী মনোমোহন সিং। পণ্ডিত মানুষ , সৎ। কিন্তু তিনি বড় নিষ্ক্রিয়। নিন্দুকেরা বলত তিনি ‘হার মিস্ট্রেস ভয়েস’। এই ‘হার’ হলেন শ্রীমতী সনিয়া গান্ধী। চরিত্রগতভাবে মনোমোহন শান্তশিষ্ট , জাহাঁবাজ নন। সাধারণ মানুষ জাহাঁবাজ প্রধানমন্ত্রী চান। কলার উচিঁয়ে কথা বলবেন যিনি। তাছাড়া , কংগ্রেস সরকার অনকগুলো ঘোটালার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। সংবাদ মাধ্যমে তার চর্চা হচ্ছিল খুব।এই এই রকম পটভূমিতে এসে দাঁড়ালেন সুগঠিত , ঋজু এক মানুষ। তাঁর নাম নরেন্দ্র মোদি। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা আছে। ২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যা ? ততদিনে মানুষের স্মৃতিতে মরচে পড়েছে অনেকটা। তাছাড়া , উচ্চ আদালত তো তাঁকে ক্লিন চিট দিয়ে দিয়েছে।নরেন্দ্র মোদি হাঁক দিলেন , ‘আমি তোমাদের চৌকিদার’। চৌকিদারের কাজ পাহারা দেওয়া , গৃহস্থের ধন-সম্পদ রক্ষা করা। এত দিন স্বাধীন হয়েছে ভারত , কোন প্রধানমন্ত্রী তো নিজেকে চৌকিদার বলেন নি। অতীতের এক চা-ওয়ালা এখন দেশের চৌকিদারি করবেন। বেশ খাপ খেয়ে গেল। চা-ওয়ালা সামান্য মানুষ। সামান্য মানুষই তো সামান্য মানুষের বুকের ব্যথা বুঝবেন , তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবেন। যে কাজ নীল রক্তের মানুষ বা এলিট সম্প্রদায়ের মানুষ করেন না।নরেন্দ্র মোদি নিজেকে চৌকিদার বলার সঙ্গে সঙ্গে গর্জন করে উঠলেন , না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা। মোরাদাবাদের সভায় চৌকিদার মোদি বললেন , ‘ দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে লড়াই করে সে কি অপরাধী হয় ? গরিব-কৃষকের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াই কি আমার দোষ ? জনতার পয়সার হিসেব দেবে সরকার। একদল মানুষের বিছানার তলায় টাকা থাকে। এই টাকা কার ? দেশবাসীর টাকা। এই টাকা আপনাদের কাছে ফিরিয়ে দেব।‘এই ভাষণ শুনলে রোমাঞ্চিত হতে হয়। সাধারণ মানুষ রোমাঞ্চিত হয়েছিল। মনে আছে আমার পাড়ার এক রিক্সাচালক বলেছিল , ‘দেখেছেন , এই হল প্রধানমন্ত্রী। নোটবন্দি করলেন , আমাদের কষ্ট হল , কিন্তু এবার সব লুকানো টাকা বেরোতে থাকবে।‘কালো টাকা ধরার জন্য ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্য তাঁর ভাষণে জানালেন যে দুর্নীতি আর কালো টাকার কবল থেকে উদ্ধার পেতে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ৮ নভেম্বর মাঝরাত থেকে চালু ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট অবৈধ হয়ে যাবে। কিন্তু এই নোটবন্দি প্রকৃতপক্ষে অশ্বডিম্ব প্রসব করেছিল। কালো টাকা উদ্ধার হয় নি। কালো টাকা যাদের আছে , তারা কিভাবে আগেই সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। আচমকা এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জীবনে ডেকে আনল বিরাট কষ্ট , ব্যাঙ্কে লাইন দিতে গিয়ে প্রাণও হারালেন অনেকে। শুধু তাই নয় , রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় নতুন নোট ছাপাতে আর সেগুলি বণ্টন করতে সরকারের ৪৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। একই বলে গোদের উপর বিষফোঁড়া। সাধারণ মানুষ ব্যাঙ্কে গিয়ে যে পুরানো নোট জমা দিয়েছেন , তাতে আমানত ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তার ফলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে অন্যান্য ব্যাঙ্কগুলিকে ১৮ হাজার কোটি টাকা সুদ দিতে হয়েছে।
রাজদীপ সরদেশাই ‘নরেন্দ্র মোদি সরকারের সাত বছরে দুর্নীতি কি কমেছে; নিবন্ধে লিখেছেন :
এই বছরের (২০২১) জানুয়ারি মাসে ;ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’ -এর বার্ষিক কোরাপশন ইনডেক্সে ভারত ৮৬তম স্থান পে্য়েছে। ২০১৩ সালে ভারত ছিল ৯৪তম স্থানে। মাত্র ৬টি স্থান অতিক্রম করেছে ভারত এই ৮ বছরে। একে নেহাতই প্রান্তিক স্তরের উন্নতি বলা যায়। ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার ঝুঁকি কতটা রয়েছে , সেই বিষয়ে দেশে ব্যবসারত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় ‘গ্লোবাল ব্রাইবারি রিস্ক ইনডেক্স’। সেই তালিকায় ২০১৩ সালে ভারত ছিল ১৮৫তম স্থানে। ২০২০ সালে অনেকটা এগিয়ে এসেছে ভারত এই তালিকায় , ঘুষের ঝুঁকির নিরিখে ভারত রয়েছে ৭৭তম স্থানে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct