যোগেন্দ্র যাদব: জন গণ মনের চেতনার সঙ্গে মানুষকে সংযুক্ত করা আজ ভারতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। স্বভাবতই দেশ আছে মানেই জনগণ আছে। জনগণের রাজও রয়েছে। স্পষ্টতই মানুষের মনও আছে। জনগনের নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করার মঞ্চ নাও থাকতে পারে, জনমতের আওয়াজের কোনও অভাব নেই। টিভি, সংবাদপত্র, সোশ্যাল মিডিয়া সবাই জনমতের দাবিদার। কিন্তু মানুষের মন ও জনমতের মধ্যে সামঞ্জস্য নেই। জনমন ও জনমতের সংযোগকারী কোনও শক্ত সেতু নেই। মানুষের মনে ও মতামতে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার কোনও উপায় নেই। জনসাধারণের নামে গণতন্ত্র লুট বন্ধ করার কোনও ব্যবস্থা নেই।
এই লুট বন্ধ করাই আমাদের আজকের সময়ের চ্যালেঞ্জ। এবার দিল্লিতে দেশের ৭৫তম প্রজাতন্ত্র দিবস তার ৪ দিন আগে অযোধ্যায় রাম মন্দির উদ্বোধনের ছায়ায় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। ২২ জানুয়ারি, সাংবিধানিক গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী অযোধ্যায় রামের মূর্তির প্রাণপ্রতিষ্ঠায় পৌরোহিত্য করবেন। তাঁর সঙ্গে থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপালও। পুরুষোত্তম রামের নাম করে, ভোটব্যাঙ্কের কাজ করা হবে। যার সঙ্গে মর্যাদা, বিশ্বাস বা ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। জনগণের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে জনমত দখল করা হবে এবং গণতন্ত্র অপহরণ করা হবে। ঐতিহ্যের নামে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার এই রাজনৈতিক খেলার কার্যকর উত্তর হতে পারে আমদের ভারতের গভীর ঐতিহ্যকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে, জনগণের মনে চাপা থাকা সংস্কৃতিকে জাগ্রত করে এবং সম্প্রদায়ের দায়িত্বকে বাঁচিয়ে রেখে।
এ ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য জানুয়ারি মাসটি সবচেয়ে উপযুক্ত। এই মাসে আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবস পালিত হয় বলেই নয়, আমাদের গানের মূল চেতনার প্রতিনিধিত্বকারী অনেক ঘটনা এবং দিন এই মাসে পড়ে। ২৬ জানুয়ারি দিবসটি আমাদের প্রজাতন্ত্রের মূল চেতনার দ্বৈত অভিব্যক্তি দেয়। এই দিনটি আমাদের সংবিধান কার্যকর হওয়ার দিন, এটি সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং এর মধ্যে নিহিত মূল্যবোধকে স্মরণ করার দিন। আবার, আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে ২৬ নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত ভারতীয় সংবিধান বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তটি জাতীয় আন্দোলনের সময় পূর্ণ-স্বরাজের জন্য জাতীয় প্রস্তাবের দিনটিকে স্মরণ করার জন্য নেওয়া হয়েছিল।
জানুয়ারি মাস স্বাধীনতা সংগ্রামের যোদ্ধাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। ২৩ জানুয়ারি, নেতাজি সুভাষ বসুর জন্মবার্ষিকী, আজাদ হিন্দ ফৌজে সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভারতীয় যোদ্ধাদের অংশগ্রহণের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। ২০ জানুয়ারি সীমান্ত গান্ধী অর্থাৎ খান আব্দুল গফফার খানের জন্মবার্ষিকী যা আমাদের অহিংস সংগ্রামের শক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। ৯ জানুয়ারি উপজাতি বিদ্রোহ উলগুলানের দিন। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকী ১১ জানুয়ারি, আমাদের মর্যাদার পাঠ শেখায়। জানুয়ারি মাস সামাজিক ন্যায়বিচারের সাংবিধানিক মূল্য স্মরণ করার সময়। ৩ জানুয়ারী সাবিত্রীবাই ফুলের জন্মবার্ষিকী এবং ৯ জানুয়ারি ফাতিমা শেখের জন্মদিন নারী শিক্ষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। ১৭ জানুয়ারী রোহিত ভেমুলার শহিদ দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সামাজিক ন্যায়বিচারের সংগ্রাম এখনও অসম্পূর্ণ। ইনকিলাব জিন্দাবাদের স্লোগান দেওয়া হাসরাত মোহানির জন্মবার্ষিকীও ১ জানুয়ারি।
এই মাসটি আমাদের দেশে ধর্ম ও সংস্কৃতির উদার প্রকৃতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময়। দেশে, সংক্রান্তি উপলক্ষে, ১৩, ১৪, ১৫ জানুয়ারি বিভিন্ন নামে উত্সব পালিত হয় যা কোনও ধর্ম বা বর্ণের মধ্যে আবদ্ধ নয়। হিন্দু ধর্মের মহান ব্যাখ্যাকার স্বামী বিবেকানন্দের জন্মবার্ষিকী ১২ জানুয়ারি। গুরু গোবিন্দ সিংয়ের জন্মবার্ষিকী ১৭ জানুয়ারি গুরু পরব হিসাবে পালিত হয়।
মহাত্মা গান্ধীর শহিদ দিবস ৩০ জানুয়ারি আমাদের প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে এই মাসের সমস্ত উত্সকে সংযুক্ত করে। একজন হিন্দু উগ্রপন্থী কর্তৃক রাম ভক্তের হত্যা, রামের নামে পরিচালিত সমসাময়িক রাজনীতি সম্পর্কে সতর্ক করে। গান্ধীজির জীবন আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির চূড়ান্ত মূল্যবোধকে সকল ধর্মের সমতার সঙ্গে সংযুক্ত করে। ২০২৪ সালটি ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটি নির্ধারক বছর হবে যা কেবল আমাদের দেশের অবস্থাই নয়, এর দীর্ঘমেয়াদী দিকনির্দেশনাও নির্ধারণ করবে। এই বছর শুরু করা জন গণ মন অভিযান আমাদের প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য সত্যিকারের অবদান হবে।
অনুবাদ: শুভম সেনগুপ্ত
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct