হিন্দুত্বের রাজনীতির বিপণন
কেন্দ্রের মসনদে দ্বিতীয়বারের মতো ‘সম্রাটের’ ভূমিকায় নরেন্দ্র মোদি। তার শাসনামলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি তলানিতে, বৃদ্ধি পেয়েছে বিদ্বেষের মাত্রা। যদিও নির্বাচনে ডাক দিয়েছিলেন ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। বাস্তবে তার যথার্থ প্রতিফলন না ঘটলেও প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে নিজের ইমেজ তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। তা নিয়ে আলোকপাত করেছেন ড. দিলীপ মজুমদার।
এবার গুজরাট গণহত্যার বিবরণ। ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। গোধরা স্টেশনে সবরমতী এক্সপ্রেস পৌঁছাল ৪ ঘণ্টা দেরিতে। যেখানে ট্রেনের ৫ মিনিট দাঁড়ানোর কথা সেখানে সেদিন ট্রেন দাঁড়িয়েছিল ২৫ মিনিট। তারপর ট্রেন চলতে শুরু করে। গোধরা থেকে ১ কিলোমিটার দূরে চেন টেনে থামানো হল গাড়ি। জায়গাটা মুসলমান অধ্যুষিত সিগন্যাল ফালিয়া অঞ্চলের কাছে। ট্রেন থামল আর তার পরেই আগুন লাগল ট্রেনে। ২০ মিনিটের মধ্যে ট্রেনের এস-২ কামরা পরিণত হল অগ্নিকুণ্ডে। আগুনে ঝলসে, ধাোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মারা গেল ২৬ জন মহিলা আর ১২জন শিশুসহ ৫৮জন যাত্রী।
কে আগুন লাগালো? কেন লাগালো? ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘দ্য হিন্দু’ লিখছে: “ প্রত্যক্ষদর্শীর মতে প্রায় ১২০০ করসেবক ছিল ওই ট্রেনে। তার কিছুদিন আগে অযোধ্যা যাওয়ার পথে ওই একই ট্রেনে সফররত করসেবকরা মুসলমান অধ্যুষিত গোধরা শহরের স্থানীয় মানুষদের উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেছিল। ঘটনার দিন সকালে তাদের ফিরতি পথে যখন ট্রেনটি গোধরা স্টেশনে ঢোকে, রামসেবকরা স্লোগান দিয়ে প্ররোচনা ছড়াতে শুরু করে। “
গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হল যে মুসলমানরা হিন্দু করসেবকদের আক্রমণ করেছে। পরের দিন অর্থাৎ ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালের সূর্যালোকে নেমে এল রাতের অন্ধকার। রাস্তা দাপিয়ে বেড়ালো বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, দুর্গা বাহিনী, শৌর্যবাহিনীর সদস্যরা।শুধু সেদিন নয়, এরপরের কয়েক মাস ধরে চলে দাঙ্গা। সরকারি হিসেব অনুযায়ী দাঙ্গায় নিহত হয় ১০৪৪ জন, যার মধ্যে মুসলমান ৭৯০ জন। আহত হয় ২৫০০জন, নিখোঁজ হয় ২২৩ জন। কিন্তু বেসরকারি মতে নিহতের সংখ্যা ২০০০-এরও বেশি। দেশ-বিদেশে ঝড় ওঠে নিন্দার। মুখ্যমন্ত্রী মোদি ও তাঁর প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ। কিন্তু ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্ট মোদির বিরুদ্ধে অভিযোগ খারিজ করে দিলেন। ঠিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ব্যাপারে অভিযুক্তরা যেমন ক্লিন চিট পেয়েছিলেন।
আমরা বুঝলাম হিন্দুত্ব রক্ষা বড় কঠিন কাজ। সেই হিন্দুত্ব রক্ষার দোহাই দিয়ে, রামমন্দির গড়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোদি ক্ষমতায় এলেন ২০১৪ সালে।
ঐতিহাসিক তনিকা সরকারের ‘হিন্দু ন্যাশনালিজম ইন ইণ্ডিয়া’ বইটির সমালোচনা করতে গিয়ে লেখক-সাংবাদিক সেমন্তী ঘোষ বলেছেন যে হিন্দু জাতীয়তাবাদ এক সুদীর্ঘ রাজনৈতিক প্রকল্প ---” কাশ্মীরে সেনার দমন থেকে উত্তরপ্রদেশে ত্রাসের শাসন, গোরক্ষার গুণ্ডামি থেকে রামনবমীর অস্ত্রাভিযান, ভারতে হিন্দুত্ববাদ এখন তার শীর্ষ ছুঁতে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে।“
মনে রাখতে হবে হিন্দুধর্ম আর হিন্দুত্ববাদ এক নয়। হিন্দুধর্ম এক অরাজনৈতিক জীবনধারা। হিন্দুধর্ম সংগঠনহীন, কাঠামোহীন, প্রাতিষ্ঠানিক গঠনতন্ত্রহীন। অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের জটিল মিশ্রণ থেকে গড়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞের মতে হিন্দুত্ববাদ ধর্ম নয়, জীবনধারা নয় ; এটা একটা সাম্প্রতিক ও আগ্রাসী রাজনৈতিক দর্শন যার মধ্যে জিঙ্গোইজম বা উগ্র দেশপ্রেম, উৎকট জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় সত্তা বিমিশ্রিত হয়েছে। মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতা লাভ করার পরে সেই হিন্দুত্ববাদের উৎকট বিকাশ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।
“ ভারত রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও মোদির আমলে এর প্রমাণ পায় নি বিশ্ব। হিন্দুধর্ম ছাড়া সকল ধর্মের মানুষই মোদির আমলে নিষ্পেষিত ও নির্ষাতিত হয়েছে ও হচ্ছে। বিশেষ করে মুসলিমদের ওপর নির্ষাতনের নতুন নতুন রূপ বিশ্ব দেখেছে এই সরকারের আমলে। সুকৌশলে, সুচিন্তিত পরিকল্পনা করে মুসলিমদের ওপর নির্ষাতন চালিয়েছে তার দল। শুধুমাত্র গোমাংস খওয়ার দোহাই দিয়ে মানবতার ইতিহাসের জঘন্যতম কাজটি করেছে সংঘ পরিবার। একটা শিশুর জীবনও রক্ষা পায় নি তথাকথিত গো-রক্ষকদের হাত থেকে।
“ উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির বিপুল সাফল্যের পর যোগী আদিত্যনাথকে যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী করা হল তখনই স্পষ্ট বোঝা গেল যে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। প্রদেশটিতে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটেছে নানাভাবে । কেন্দ্রে মোদি আর উত্তরপ্রদেশে যোগী—এই দুইজনের নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে গোটা দেশে। গো-রক্ষার নামে কট্টর মনোভাব, গরু পরিবহনকারীদের গণপিটুনি। তাতে মারা গেছে চার-পাঁচজন। “ ( ‘মোদির ভারত: হিন্দুত্ববাদ ও সাম্প্রদায়িকতার নয়া উথ্থান ‘ / ওমর ফারুক )
বিপুল উৎসাহে রামমন্দির গড়ার কাজ শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০০০কোটি টাকা ; পরবর্তী ব্যয়ের জন্য ব্যাঙ্কে গচ্ছিত আছে আরও ৩০০০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে, লোকসভা নির্বাচনের আগে দ্বারোদ্ঘাটন হবে রামমন্দিরের। সেদিন একটা ‘পরিকল্পিত সংঘর্ষে’র অশঙ্কা থেকে যায়। রামজন্মভূমি আন্দোলনের সময় হিন্দুত্ববাদীরা স্লোগান দিয়েছিলেন: ‘ইয়ে তো স্রিফ ঝাঁকি হ্যায় / কাশী মথুরা বাকি হ্যায়।‘ কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদ এবার তাঁদের লক্ষ্য কি না কে জানে ! কিন্তু কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের মোহন্ত বলে ফেলেছেন একটা বেসুরো কথা। তিনি বলেছেন:
১] আওরঙ্গজেবের চেয়ে বেশি মন্দির ভেঙেছেন মোদি ও তাঁর দল। কাশী বিশ্বনাথ করিডোর তৈরি করতে গিয়ে অনেক শিবলিঙ্গ ফেলে দেওয়া হয়েছে।
২] হিন্দুইজম মোদি ও তাঁর দলের ব্যবসা।
ইতিহাসের পাঠ্যসূচি থেকে মুসলমান আমল বাদ দেওয়া, হিন্দুত্ববাদের পাহারাদার হিসেবে অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড গঠন, বিখ্যাত অভিনেতা শা্হরুখ খান-আমির খান-সলমান খানকে পাকিস্তানে গিয়ে বসবাস করার কথা বলা, কেরালা-উত্তরপ্রদেশ- গুজরাট-ছত্তিশগড়ে চার্চগুলিকে ভাঙচুর করা, ওস্তাদ গুলাম আলিকে মনে করিয়ে দেওয়া যে তিনি মুসলমান ও শত্রুদেশের মানুষ, তিন তালাক বিরোধী আইন, লাভ জিহাদের অভিযোগে নির্যাতন, মুসলিম ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক স্থান নামের পরিবর্তনের হিড়িক মোদির দলের কর্মসূচি।
আমরা এই অধ্যায়টি শেষ করব আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন উল্লেখ করে। সে প্রতিবেদন পড়ে মনে হতে পারে লোকসভা নির্বাচনের আগে আবার হিন্দুত্ববাদের একটা বিস্ফোরণ ঘটাতে চান মোদি ও তাঁর দল :
নানা পোশাকে পুজো পিথোরাগড়ে, হিন্দুত্বের বার্তা দিলেন মোদি
উত্তরাখণ্ডে আপাতত কোন ভোট নেই। কিন্তু সেখানে রয়েছে বহু প্রাচীন মন্দির। রয়েছে পাহাড়ঘেরা নির্মল নিসর্গ। ভোটমুখী রাজ্যে বার্তা দেওয়ার জন্য উত্তরাখণ্ড যথেষ্ট উপযুক্ত।
নয়াদিল্লির রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই দুটিকেই কাজে লাগিয়েছেন বিচক্ষণ ভাবে, যা আসন্ন বিধানসভা ভোটের মুখে দাঁড়ানো রাজ্যগুলির ভোটারদের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি আরও পোক্ত করার বার্তাবহ। একের পর এক মন্দিরে গিয়ে ধ্যান, পূজা, আরতি, শঙ্খধ্বনি, ডুগডুগি বাজিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতির পালে তাতে দিনভর বাতাস লেগেছে। মনে করা হচ্ছে, সেই সঙ্গে মোদি তৈরি করেছেন নিপুণ এক দৃশ্য তৈরির রাজনীতি। কোনও মন্দিরে তিনি পরেছেন সাদা পাগড়ি সাদা আলখাল্লার মতো ঝুলওয়ালা স্থানীব জনজাতির পোশাক।
আবার পরের মন্দিরে তাঁকে দেখা গিয়েছে কালো কুর্তা সাদা চুড়িদারে। ক্যামেরা তাঁকে ধরেছে স্থল ও অন্তরীক্ষ থেকেও। তিনি হেঁটে গিয়েছেন পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে . ক্যামেরা দেখিয়েছে, যেন এক দীর্ঘ পাহাড়ি পথে তিনি একাকী পথিক।
আজ উত্তরাখণ্ডের গ্রামোন্নয়ন, সড়ক . শক্তি, পানীয় জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিপর্যয় মোকাবিলার মতো বিভিন্ন বিষয়ে ৪২০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের শিলান্যাস করেছেন মোদি। সেই সঙ্গে পিথোরাগড়ে পার্বতী কুণ্ড, আদি কৈলাশ মন্দির, যোগেশ্বর মন্দিরে পুজো ও আরতি করেছেন।
পুজো দেওয়ার পর গুঞ্জি গ্রামে স্থানীয়দের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। মোদি বলেন,’ বিশ্বাস ও জাতীয় প্রতিরক্ষার এই ভূমিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে ধন্য বলে মনে করছি।
উত্তরাখণ্ডের উন্নয়ন এবং এখানকার মানুষের বিকাশ আমাদের সরকারের প্রধান লক্ষ্যগুলির একটি। এই দশকটি উত্তরাখণ্ডের দশক হতে চলেছে।‘ তাঁর প্রিয় ডবল এঞ্জিন সরকারের সুফলতত্ত্ব এখানেও আমদানি করেছেন মোদি।
চলবে...
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct