১৩ ডিসেম্বর সংসদে লাফিয়ে পড়ে যুবাদের প্রতিবাদ নিঃসন্দেহে একটি গুরুতর ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা আমাদের কাছে গুরুত্বের, গভীর চিন্তার ও তদন্তের দাবি রাখে। কিন্তু এই ঘটনার পরে মিডিয়া একে অপরাধ রহস্যের কিনারা করার গোয়েন্দা তদন্তের মত করে বদলে দিচ্ছে। কী ঘটেছে এবং কীভাবে ঘটেছে তা নিয়ে আমরা সবাই আগ্রহী, তবে কেন ঘটেছে তা গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে আমরা প্রস্তুত নই। লিখেছেন যোগেন্দ্র যাদব।
৩ ডিসেম্বর সংসদে লাফিয়ে পড়ে যুবাদের প্রতিবাদ নিঃসন্দেহে একটি গুরুতর ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা আমাদের কাছে গুরুত্বের, গভীর চিন্তার ও তদন্তের দাবি রাখে। কিন্তু এই ঘটনার পরে মিডিয়া একে অপরাধ রহস্যের কিনারা করার গোয়েন্দা তদন্তের মত করে বদলে দিচ্ছে। কী ঘটেছে এবং কীভাবে ঘটেছে তা নিয়ে আমরা সবাই আগ্রহী, তবে কেন ঘটেছে তা গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে আমরা প্রস্তুত নই। টিভি চ্যানেলগুলো দেশকে ‘মারো ধরো’ধরণের উন্মাদনার ভিড়ে পরিণত করতে চায়। সরকার ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে চায়। বিরোধীরা এই অজুহাতে সরকারকে কোণঠাসা করতে চায়।কেউ গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে চায় না। সর্বোপরি, সংসদে লাফিয়ে পড়া এই তরুণরা কারা? কোন সমস্যা তারা তুলে ধরতে চেয়েছিল? কেন এমন ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে গেল তারা? গণতন্ত্রে আওয়াজ তোলার অন্য সব উপায়ে কেন তাদের আস্থা ছিল না? এসব প্রশ্নের মুখোমুখি না হলে আমরা সংসদ ভবনকে নিরাপদ করতে পারি ঠিকই, কিন্তু দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে পারি না। এখনও পর্যন্ত পুলিশ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত যে ছ জনকে গ্রেপ্তার করেছে, স্পষ্টতই তারা কেউই পেশাদার অপরাধী বা গুন্ডা নয়। দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা প্রত্যেকেই সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। এই অস্থিরতার জন্যে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক হতাশা তো বটেই, তার সাথে ব্যক্তিগত নিরাশাও কাজ করেছে। এর আগে তাদের কারও কোনও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার নজীর নেই।এটাও স্পষ্ট যে সংসদে ঢুকে হিংসা বা ক্ষতি করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। লুকিয়ে রং ধোঁয়ার বদলে তারা আরও মারাত্মক কিছু নিয়েও ঢুকতে পারত। তারা তা করেনি। সংসদে ঢোকার পর কাউকে আক্রমণ করেনি, নিজেরা মার খেয়েছে কিন্তু পাল্টা জবাব দেয়নি। পুলিশি তদন্ত বলছে যে আগে তারা সংসদের মধ্যে আত্মাহুতি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল, যা তারা বাতিল করা দেয়। তারা সঙ্গে করে “নিখোঁজ প্রধানমন্ত্রী” লেখা পোস্টারও নিয়ে এসেছিল, যা বিতরণ করতে পারেনি। ঘটনা যাই হোক, তারা সন্ত্রাস করতে চায়নি। তাদের সন্ত্রাসবাদী বলা যাবে না।
সংসদে বা সংসদের বাইরে ধরা পড়লে তাদের কী অবস্থা হবে, তা অজানা থাকার মত বোকা এই যুবারা নয়। তাদের ওপর অত্যাচার হবে, পরিবারের সদস্যদের ওপর অত্যাচার করা হবে, দীর্ঘদিন জেল খাটতে হবে কিংবা এর চেয়েও বড়ো কোনও শাস্তি হতে পারে, নিশ্চয় করে এগুলো জেনেই তারা এসেছিল। আঙুল কেটে শহিদ হওয়ার চমক দিয়ে এবং তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ গড়ার মতো ঘটনা বলে ওদের ঘটনাটা মনে হয় না। অন্তত নিজেদের চোখে তারা সবাই দেশের স্বার্থে এক বৃহৎ উদ্দেশ্যে নিজেদের উৎসর্গ করেছিল।সাগর শর্মার ডায়েরিতে লেখা লাইনগুলি থেকে তাঁর চিন্তাভাবনা অনুমান করা যায়: “এমনটা নয় যে সংগ্রামের পথ আমার পক্ষে সহজ ছিল। আমি ৫ বছর ধরে প্রতি মুহূর্তে অপেক্ষা করেছি যে এক দিন আসবে যখন আমি আমার দায়িত্ব পালন করব। আমি এগিয়ে যাবো। যে ছিনিয়ে নিতে জানে সে দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর নয়। সবচেয়ে শক্তিশালী সে যে সব সুখ ত্যাগ করার ক্ষমতা রাখে।” এমন ভাষা কোনও সন্ত্রাসবাদী বা বিশ্বাসঘাতকের হতে পারে না।তাই বলে এদের ভগৎ সিং বা বটুকেশ্বর দত্তের সঙ্গে এক সারিতে রাখা যাবে না। শুধুমাত্র সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলীতে বোমা ছুঁড়ে ও প্রচারপত্র বিলি করেই ভগৎ সিং শহিদশ্রেষ্ঠ হয়ে যাননি। তার বিপ্লবী অতীত ছিল, চিন্তার গভীরতা ছিল এবং ফাঁসির মঞ্চে যাওয়া অবধি তিনি ছিলেন ত্যাগ ও সংকল্পে অবিচল। এই তরুণদের সম্পর্কে এখনই তা বলা যাবে না। তবে এতটুকু বলা যায় যে তাদের কর্মকাণ্ডকে অপরাধ বা সন্ত্রাসবাদের চোখে না দেখে রাজনৈতিক প্রতিবাদের চোখে দেখা উচিত। আমরা ওদের পদ্ধতির সঙ্গে একমত না হতে পারি। এটা ঠিক সংসদের ভেতর লাফিয়ে পড়ে কার্যক্রম ব্যহত করাকে মহিমান্বিত করা যায় না। তবে অবশ্যই আমাদের দায়িত্ব এই প্রতিরোধের কণ্ঠকে অপরাধ, সন্ত্রাস বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার বলে এড়িয়ে না গিয়ে, অবশ্যই তাঁরা কী বলতে চায় তার দিকে নজর দেওয়া। তাদের বার্তা সহজেই বুঝতে পারা যাচ্ছে। এটা পরিস্কার যে বেকারত্বের প্রশ্নকে তারা সারা দেশের নজরে আনতে চেয়েছে। কোনও সন্দেহ নেই যে বেকারত্ব শুধুমাত্র ঐ তরুণদের বা দেশের এক ছোট খাটো জনসংখ্যার সমস্যা। এটিই আজ দেশের যুব সমাজের সবচেয়ে বড়ো সংকট, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবচেয়ে বড়ো প্রশ্নচিহ্ন। তা ছাড়া এই তরুণরা মণিপুরের ইস্যু তুলেছে, নারী কুস্তিগীরদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কথা বলেছে এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও স্লোগান দিয়েছে।স্পষ্টতই ওরা মনে করেছে নিঃশব্দে স্বৈরাচার দেশে এত মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে যে সাধারণ গণতান্ত্রিক উপায়ে এই প্রশ্নগুলি তোলার মত কোনও জায়গা অবশিষ্ট নেই। তারা নিশ্চয়ই এটাও বুঝতে পেরেছিল যে, গণমাধ্যমের সাহায্যে বা গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের মাধ্যমে তাদের আওয়াজ তুলে কোনও লাভ নেই। ওদের এই মূল্যায়ন ভুল হতে পারে। কিন্তু আদর্শবাদী, চিন্তাশীল ও নির্ভীক যুব সমাজের একটা ছোট অংশও যদি এমনভাবে চিন্তা করে, তবে তা গোটা দেশের জন্যই বিপদের ইঙ্গিত। ইতিহাস সাক্ষী যে, এ ধরনের কণ্ঠকে উপেক্ষা করলে তার ফল ভাল হয় না।
অনুবাদ: শুভম সেনগুপ্ত
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct