জাইদুল হক: সামনে লোকসভা নির্বাচন। তার আগে রাজ্যের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে জোর তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। আর এই লোকসভা নির্বাচন ঘিরে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসতে শুরু করেছে। তার মধ্যে অন্যতম হল, এ রাজ্যে কি বিজেপি তাদের গতবারের লোকসভা আসন ধরে রাখতে পারবে। আর অপরদিকে, কংগ্রেস কি মালদা দক্ষিণ আর বহরমপুরের আসন ধরে রাখতে পারবে। এই সব প্রশ্নে ইতিমধ্যে অঙ্ক কষা শুরু হয়ে গিয়েছে। যদিও বিজেপি বিরোধী জোট;ইন্ডিয়া-র সাম্প্রতিক বৈঠকে বাংলার ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসে রাজ্যে যে দুটি আসন কংগ্রেসকে ছাড়ার কথা বলেছে বলে শোনা যাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে বহরমপুরও। কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেসের দাবি সাতটি আসন। তাই বলা যেতে পারে, আসন রফা হলে বহরমপুর আসনে নিশ্চিত জয় পেতে পারে কংগ্রেস। অন্যথায় পথ কণ্টকময়। অবশ্য সেক্ষেত্রে বিজেপি কতটা লড়াই দিতে পারে সেটা নিয়ে সন্দিহান।
তবে, গত বিধানসভা নির্বাচন ও তৎপরবর্তী পরিস্থিতিতে বিজেপির মধ্যে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। অনেক বিজেপি বিধায়ক ও সাংসদ রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়ায় বিজেপির শক্তিক্ষয় নিয়ে প্রশ্ন নেই।
কিন্তু কংগ্রেসের দুটি লোকসভার আসন নিয়ে জোর চর্চা। যদিও ইন্ডিয়া জোট গঠনের পর থেকে তৃণমূল সুপ্রিমো যেমন এ রাজ্যে কংগ্রেসের প্রধান মুখ বহরমপুরের সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরির বিরুদ্ধে সুর একটু নরম করেছেন, তেমনি অধীরকেও আর ততটা আক্রমণাত্মক হতে দেখা যাচ্ছে না। এর মূলে অবশ্য সোনিয়া গান্ধি ও রাহুল গান্ধির সঙ্গে মমতার বিশেষ সম্পর্ক। অতীতে দেখা গেছে সোনিয়া গান্ধির কাছে এ রাজ্যের কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি অধীরের নামেই নালিশ করেছেন। এমনকী বহরমপুরে বিজেপির সঙ্গে অধীরের সংযোগেরও অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের তরফ থেকে। তার কারণ হল বিজেপি নিয়ে অধীরের যতটা নীরবতা তৃণমূল তথা মমতার বিরুদ্ধে অধীর ততটাই সরব। তবুও মুর্শিদাবাদে অধীরের দাপট কমেনি। সাগরদিঘি বিধানসভার উপনির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী বায়রন বিশ্বাসকে জিতিয়ে আনার পিছনে অধীরের ভূমিকা রয়েছে। বায়রন পরে তৃণমূলে যোগ দিলেও তার জেতার পিছনে অধীরের যে বিশেষ ভুমিকা ছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
তবে, বায়রনকে তৃণমূলে নিয়ে মমতার বাজি, অধীরে সাম্রাজ্যে থাবা বসানো। সেই কাজ ততটা যে সহজ নয়, তা তৃণমূল টের পেয়েছে। অধীরের সাংগঠিক ভিত্তি যে তাকে শক্ত জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যদিও, অধীরের আমি সর্বস্ব মনোভাবের কারণে কংগ্রেসের বহু বিধায়ক তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। তার ফলে, ক্রমে ক্রমে অধীরের শক্ত হাত কম জোর হয়ে পড়ে। তার ফলে অধীরের নিজের লোকসভা ক্ষেত্র বহরমপুরের আওতাধীন বিধানসভা কেন্দ্রগুলির কোনওটিতেও কংগ্রেস জয়ের মুখ দেখতে পারেনি। কিন্তু তৃণমূল চায় বহরমপুরে টিম টিম করে জ্বলা কংগ্রেসের বাতি অধীরকে যেভাবেই হোক হারাতে। সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অবশ্য সেই প্রচেষ্টায় জল ঢালতে পারে যদি ইন্ডিয়া জোট হয়। আর মমতা এ রাজ্যে দুটি আসন কংগ্রেসকে ছাড়তে রাজি হন। সেক্ষেত্রে মমতা কিছু শর্ত চাপিয়ে দিতে পারেন। তা কংগ্রেস হাইকমান্ড কতটা মানবেন তা নিয়ে সন্দিহান রয়েছে।
এ রাজ্যে সিপিএম বা বামেদের কোনও লোকসভার সাংসদ নেই। আর তৃণমূল শূন্য হাতে ফেরাতে চায় কংগ্রেসকেও। বিশেষ করে তাদের লক্ষ্য, অন্তত বহরমপুর লোকসভা আসনটি অধীরের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা।
কিন্তু গত বিধানসভায় বহরমপুরে কংগ্রেস হারলেও বিজেপি জেতায় অনেকটাই হতাশ হতে হয় তৃণমূলকে। তাই লোকসভা আসন ধরে রাখতে বহরমপুর বিধানসভা আসনটি বিজেপিকে উপহার দেওয়া হয়েছে বলে অধীর-বিজেপি আঁতাতের অভিযোগ ওঠে। যদিও অধীর সে অভিযোগ নস্যাৎ করেছেন।
সামনে লোকসভা ভোট। তাই প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক, অধীর কি তার আসন ধরে রাখতে পারবেন, নাকি তৃণমূল নতুন কোনও চালে মাত করবেন অধীরকে? তবে, সাগরদিঘি উপনির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে মমতা নতুন কৌশল অবলম্বন না নিলে যে অধীরকে হাারনো কঠিন তা সবাই বিলক্ষণ বোঝেন। সেই নতুন সমীকরণ কি তা খোঁজা দরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সে ক্ষেত্রে মমতার অবশ্যই ঢাল হতে পারে মুসলিম ভোট।
উল্লেখ্য, সারা দেশে ১৫টি লোকসভা কেন্দ্র এমন আছে, যেখানে মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই ১৫টি কেন্দ্রে শুধু মুসলিমদেরই ভোটে কেউ জিতে যেতে পারেন। সেই ১৫টি কেন্দ্রের মধ্যে শুধু পশ্চিমবঙ্গের চারটি লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলি হল বহরমপুর, জঙ্গিপুর, মুর্শিাদাবাদ,ও মালদা দক্ষিণ। দেশের বাকি যে এগারোটি লোকসভা কেন্দ্রে মুসলিম ভোটার বেশি সেগুলি হল বারামুলা, অনন্তনাগ, শ্রীনগর, লাক্ষা দ্বীপ, কিষাণগঞ্জ, হায়দরাবাদ মালাপ্পুরম, ওয়ানাদ, ধুবড়ি, অসম ও বরপেটা।
এবার বহরমপুর লোকসভা আসনের দিকে নজর দেওয়া যাক।
বহরমপুর লোকসভা আসনের মধ্যে রয়েছে সাতটি বিধানসভা এলাকা। সেগুলি হল, বহরমপুর, বড়ঞা, রেজিনগর, নওদা, কান্দি, ভরতপুর ও বেলডাঙা। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় বহরমপুর কেন্দ্রে মোট ভোটার ছিল ১৬৩ ২০৮৭। আর বুথের সংখ্যা ছিল ১৮৪৪টি। ভোট পড়েছিল ৭৯.১ শতাংশ।
যদিও ২০১১ সালে জনগণনা অনুযায়ী এই সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের আওতায় রয়েছে বিভিন্ন ব্লক ও পৌরসভা এলাকা। সেগুলি হল, বেলডাঙা-১, বেলডাঙা-২,বহরমপুর (গ্রামীণ), ভরতপুর-১, ভরতপুর-২, বড়ঞা, কান্দি (গ্রামীণ), নওদা। আর রয়েছে বেলডাঙা, বহরমপুরও কান্দি পৌরসভা এলাকা। সব মিলিয়ে বহরমপুর লোকসভা আসনে মুসলিম জনস্ংখ্যার হার ৫৫.২৩ শতাংশ। আর হিন্দু জনসংখ্যার হার ৪৪.৪৪ শতাংশ। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থীর ভাগ্য ঝুলে রয়েছে মুসলিম ভোটারদের উপর।
ভোট বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী অধীর চৌধুরি ৪৫.৯৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। তৃণমূল প্রার্থী অপূর্ব সরকার পেয়েছিলেন ৩৯.৭৭ শতাংশ ভোট। আর বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ১১.০২ শতাংশ ভোট। তবে, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র বহরমপুর লোকসভা আসনের অন্তর্গত সেগুলিতে মিলিতভাবে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ৫০.১ শতাংশ ভোট। বিজেপি পেয়েছে ৩১.৬ শতাংশ ভোট আর কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ১৫.১ শতাংশে ভোট। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বহরমপুর আসন থেকে অধীর চৌধুরি কংগ্রেস প্রার্থী হলেও তার জেতার পথ মসৃণ নয়। সেক্ষেত্রে ইন্ডিয়া জোট বহরমপুর আসন কংগ্রেসকে দিলে তবেই তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারে। যদিও, জোট না হয় সেক্ষেত্রে তৃণমূলের সঙ্গে অধীর চৌধুরির মধ্যে মূলত লড়াই হবে। সেক্ষেত্রে তৃণমূলের প্রার্থী নির্বাচনের উপরই নির্ভর করবে অধীরের ভোট টানার বিষয়টি। যদিও গত লোকসভা আসনে একদা অধীর ঘনিষ্ঠ অপূর্ব চৌধুরি তৃণমূলের হয়ে লড়লেও কল্কে পায়নি।
কিন্তু কেন কল্কে পায়নি তা অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে কংগ্রেস সংখ্যালঘুদের একটা বড় অংশের ভোট পেয়েছিল। যদিও জোট না হয় তাহলে অধীরের বিরুদ্ধে তৃণমূলের প্রার্থী কে হবেন এখনও তা নির্ধারণ হয়নি। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, অধীরের মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কে থাবা বসাতে তৃণমূল যদি কোনও ভাল মুসলিম প্রার্থী দেন তাহলে বিপদ হয়ে উঠতে পারে অধীরের জন্য। সেক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি পথ খোলা রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য অধীরকে হারানোর জন্য যার মধ্যে অন্যতম হল মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কের সিংহভাগ অর্জন করা। গত বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে মধ্যে যে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে তার মধ্যে ছটি তৃণমূলের দখলে। আর মার মধ্যে চারজন মুসলিম বিধায়ক। শুধু টিম টিম করে জ্বলছে বিজেপি বহরমপুর বিধানসভা কেন্দ্রে।
অতীতে তৃণমূল কোনও মুসলিম প্রার্থীকে বহরমপুর আসনে প্রার্থী করেনি। এবার জোট না হলে তৃণমূল অধীরের বিরুদ্ধে কোনও মুসলিম প্রার্থী দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তৃণমূলের এক বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, তার জন্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি কয়েক বছর আগে থেকে পরিকল্পনা করে রেখেছেন। অধীর চৌধুরি যেহেতু মুর্শিদাবাদের ভূমিপুত্র আর হেভিওয়েট প্রার্থী তায় তার বিরুদ্ধে প্রার্থী করা হতে পারে প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ মইনুল হাসানকে। মুর্শিদাবাদের এক সংখ্যালঘু মহল থেকে শোনা গেছে, ভবিষ্যতে সাংসদ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই নাকি মইনুল হাসানকে তৃণমূলে আনা হয়েছে। আর তাকে হয়তো অধীরের বিরুদ্ধে ঢাল করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে কিন্তু অধীরের জয়ের পথ অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ বহরমপুর লোকসভা আসনে যেহেতু ৫৫.২৩ শতাংশ মুসলিম ভোট, তাই শুধু মুসলিম ভোটের উপর নির্ভর করেই তৃণমূল মইনুল হাসানকে প্রার্থী করে বাজিমাত করতে পারে। তবে, এসব কিছু নির্ভর করছে ইন্ডিয়া জোটে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের সমঝোতার উপর।
ইতিমধ্যে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে জোট নিয়ে আসন রফার বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যে রয়েছে। তবে,আগে যেমন অধীর চৌধুরি তৃণমূলের সঙ্গে জোটের বিষয়ে নারাজ হতে দেখা গিয়েছিল এখন কিন্তু তিনি অনেকটাই নরম মনোভাব নিয়ে চলছে। এটা হয়তো তৃণমূলের সঙ্গে জোটের ইঙ্গিত। তবে জোট না হলে মুসলিম ভোট তৃণমূলের দিকে ঝুঁকলে বহরমপুরে যে অধীরের জয়ের পথ কঠিন হয়ে উঠতে পারে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct