এ বছর প্রথম বারের মতো আমার কাজের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করেছি। আমি বিশ্বাস করি, অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে আমরা এখন একটা বিশাল প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এটা একাধারে উত্তেজনাপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর সময়। এআই সামনের দিনগুলোতে কেমন রূপ নেবে, তা একদমই অনিশ্চিত। তবে একটা বিষয় আগের চেয়ে পরিষ্কার যে, এআই ভবিষ্যতে আমাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রোডাক্টিভিটি ছাড়াও অজানা অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। আমি সর্বদা একটা নীতিতে বিশ্বাস করি—উদ্ভাবনই অগ্রগতির চাবিকাঠি। লিখেছেন বিল গেটস।
এ বছর প্রথম বারের মতো আমার কাজের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করেছি। আমি বিশ্বাস করি, অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে আমরা এখন একটা বিশাল প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এটা একাধারে উত্তেজনাপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর সময়। এআই সামনের দিনগুলোতে কেমন রূপ নেবে, তা একদমই অনিশ্চিত। তবে একটা বিষয় আগের চেয়ে পরিষ্কার যে, এআই ভবিষ্যতে আমাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রোডাক্টিভিটি ছাড়াও অজানা অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। আমি সর্বদা একটা নীতিতে বিশ্বাস করি—উদ্ভাবনই অগ্রগতির চাবিকাঠি। এজন্য আমি মাইক্রোসফট শুরু করেছি। এ কারণেই মেলিন্ডা ও আমি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে গেটস ফাউন্ডেশন পরিচালনা করছি। আর এ কারণেই গত শতাব্দীতে বিশ্ব জুড়ে জীবনযাত্রার মান কিছুটা হলেও উন্নত হয়েছে বলে আমার ধারণা।২০০০ সালের পর থেকে বিশ্বে পাঁচ বছর বয়সের আগেই মারা যাওয়া শিশুদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। উদ্ভাবন এই সাফল্যের পেছনে বড় একটা কারণ। বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিন তৈরির নতুন নতুন উপায় নিয়ে এসেছেন, যা আগের চেয়ে অনেক দ্রুত, সস্তা এবং নিরাপদও বটে। তারা বিভিন্ন ধরনের ডেলিভারি মেকানিজম তৈরি করেছেন, যার কল্যাণে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গম জায়গাগুলোতেও ভ্যাকসিন পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এর ফলে আরও বেশি বাচ্চাদের কাছে জরুরি সরবরাহ পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। তারা নতুন ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, যা শিশুদের রোটাভাইরাসের মতো মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা করছে।
আমাদের এই বিশ্বে সম্পদ বেশ সীমিত। এমতাবস্থায় আমাদের সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। ব্যয়কৃত প্রতিটি ডলার থেকে সর্বাধিক লাভের চাবিকাঠি হলো উদ্ভাবন। এই মুহূর্তে এআই এমন গতিতে নতুন আবিষ্কারের হারকে ত্বরান্বিত করে চলেছে, যা আমরা এর আগে কখনো দেখিনি। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সাফল্যগুলোর মধ্যে একটা হলো নতুন ওষুধ তৈরি করা। এআই প্রযুক্তি ওষুধ আবিষ্কারের প্রক্রিয়ার গতি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে এবং কিছু কোম্পানি ইতিমধ্যে এই প্রযুক্তির সাহায্যে ক্যানসারের ওষুধ নিয়ে কাজ করছে। গেটস ফাউন্ডেশন এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে এইডস, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ার মতো স্বাস্থ্যসমস্যা মোকাবিলার জন্য কাজ করছে। আমার ধারণা, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে এআই বিপুল সম্ভাবনা বয়ে আনবে। আমি সম্প্রতি সেনেগাল ভ্রমণের সময় উন্নয়নশীল দেশগুলোর বেশ কয়েক জন উদ্ভাবকের সঙ্গে দেখা করেছি। তারা তাদের নিজস্ব সম্প্রদায়ের লোকদের উপকার করার উদ্দেশ্যে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষণাকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বেশির ভাগ কাজ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তবে আশা করা যায়, চলতি দশক শেষ হওয়ার আগেই তারা অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হবেন।তারা কত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন, তা দেখে আমি অবাক না হয়ে পারি না। আমি যে দলগুলোর সঙ্গে দেখা করেছি, তারা গবেষণা করছে এআই কীভাবে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে, মানুষ কীভাবে তাদের এইচআইভির ঝুঁকি আরো ভালোভাবে মূল্যায়ন করতে পারবে, স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে চিকিত্সা তথ্য কীভাবে আরো সহজলভ্য করে তোলা সম্ভব। উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্ভাবকেরা যেভাবে তাদের দেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার চেষ্টা করছেন, তা দেখে আমি সত্যিই বিস্মিত হয়েছি।ভারতে প্রতি দুই মিনিটে একজন নারী সন্তান প্রসবের সময় বা গর্ভাবস্থায় মারা যান। ভারতের একটা দল এই প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের চেষ্টা করছে। ‘এআরএমএমএএন’-এর বৃহত্ ভাষার মডেল একদিন উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণের চিকিত্সা করা স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সহ-পাইলট হিসেবে কাজ করবে। এটা ইংরেজি ও তেলেগু উভয় ভাষাতেই ব্যবহার করা যেতে পারে। এর সবচেয়ে ভালো দিক হলো এটার ইউজার ইন্টারফেস এতটাই সহজ যে, কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই যে কেউ এটা ব্যবহার করতে পারবে। এ ধরনের প্রকল্পের জন্য আমাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। আমাদের সামনে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেমন :গুণমান ঠিক রেখে কীভাবে এই প্রযুক্তি বৃহত্ সংখ্যায় উত্পাদন করা সম্ভব এবং কীভাবে সেগুলো সময়ের সঙ্গে আপডেট করা যায়, তা নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা ও তহবিল প্রয়োজন।
এসব ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আমাদের এআই থেকে উদ্ভূত কিছু বিস্তৃত ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে কীভাবে পক্ষপাত ও হ্যালুসিনেশন প্রতিরোধ করা যায়। হ্যালুসিনেশন বলতে সেই সময়কে বোঝায়, যখন একটা এআই সিস্টেম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এমন কিছু দাবি করে, যা সত্য নয়। চিকিত্সার ক্ষেত্রে এআই ভুল তথ্য প্রদান করলে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি হয়। যদিও কিছু গবেষক মনে করেন, ‘হ্যালুসিনেশন এআই প্রযুক্তির অন্তর্নিহিত সমস্যা। তবে এ ব্যাপারে আমি একমত নই। আমি আশাবাদী যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এআই মডেলগুলোকে মিথ্যা থেকে সত্যকে আলাদা করতে শেখানো সম্ভব। ওপেন এআই এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।এআই প্রযুক্তি যাদের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হচ্ছে, তারা যেন এর সঠিক ব্যবহার করতে পারে, সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আমি ‘সোমানাসি’ নামক একটা এআইভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে যে এআইভিত্তিক শিক্ষা সরঞ্জাম পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো সত্যিই চমকপ্রদ। কারণ সেগুলো প্রতিটি স্বতন্ত্র শিক্ষার্থীর জন্য তৈরি করা হয়েছে। সোমানাসি শব্দের অর্থ ‘একসঙ্গে শিখুন’। কেনিয়ার শিক্ষার্থীদের জন্য এই প্রযুক্তি বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। এটা স্থানীয় পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট মাথায় রাখা হয়েছে, যেন শিক্ষার্থীরা এটা ব্যবহার করার সময় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।আমি অনেক গবেষক দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি, যারা কীভাবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে নতুন প্রযুক্তি স্থাপন করা যায় সে বিষয়ে গবেষণা করছেন। আমরা যদি এখন স্মার্ট খাতে বিনিয়োগ করি, তাহলে এআই ভবিষ্যতে বৈষম্য দূর করে বিশ্বকে আরো ন্যায়সংগত করে তুলতে পারবে। অনেক সময় লক্ষ করা যায়, একটা ধনী দেশ এই মুহূর্তে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, তা দরিদ্র দেশের হাতে যেতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। এআই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে এই ব্যবধান কয়েক মাসে নামিয়ে আনা সম্ভব। এআই প্রযুক্তি যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে ধারণা করা যায়, তিন বছরের মধ্যে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, এই যাত্রা আমাদের জন্য মোটেও সহজ হবে না।এই ব্যবধান কমানো সম্ভব হলে বিশ্ব জুড়ে বৈষম্য ঘোচানোর পথ অনেক সহজ হয়ে যাবে। এমন চ্যালেঞ্জিং সময়েও আমি আশাবাদী, এআই ব্যবহার করে ভবিষ্যত্ পরিবর্তনকারী প্রযুক্তি তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব, যাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজন।
লেখক: বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি এবং ব্রেকথ্রু এনার্জির প্রতিষ্ঠাতা।
সিএনএন থেকে অনুবাদ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct