৭ অক্টোবর পর থেকে গাজায় কমপক্ষে ২০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সাত দিনের যুদ্ধবিরতি বাদে, সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০০ জন নিহত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক জরুরি পরিচালক রিচার্ড ব্রেনান বলেছেন, তিনি এই হতাহতের পরিসংখ্যানকে বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে করেন। গাজার চিকিৎসকরা বলছেন, মৃতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি হতে পারে। কারণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে থাকা মৃতদেহগুলো হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয়নি। বিবিসি পরিসংখ্যানগুলো বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে এবং অন্যান্য সংঘাতের সঙ্গে তুলনা করে দেখেছে।
ব্যাপক মৃত্যু
বিশ্বজুড়ে সংঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা যাচাই করেন এমন একজন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মাইকেল স্পাগাট বলেছেন,‘হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা অসাধারণভাবে বেশি।’ তিনি বলেন, ‘গাজায় ২০০৮ পর্যন্ত যত যুদ্ধ হয়েছে তার মধ্যে এই যুদ্ধে মানুষ নির্বিচারে হত্যার শিকার হয়েছে।’ বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামরিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে তারা জানতে পেরেছে, ইসরায়েলের ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরণের বোমা এই সংঘর্ষে প্রাণহানির সংখ্যার জন্য সরাসরি দায়ি। এদের মধ্যে কিছু বোমা প্রায় ১০০ পাউন্ড এবং অন্যগুলো ২ হাজার পাউন্ডের মতো বড়। পেন্টাগনের প্রাক্তন সিনিয়র গোয়েন্দা বিশ্লেষক এবং জাতিসংঘের যুদ্ধাপরাধের প্রাক্তন তদন্তকারী মার্ক গারলাসকো বলেছেন, “এই বোমার শকওয়েভ ক্ষণে ক্ষণে যদি মাটিকে তরল করে তুলত, তাহলে পৃথিবীতে সার্ফিং করা যেত।” গাজার জনসংখ্যার ঘনত্ব খুব বেশি তাই মৃত্যুও বেশি হয়েছে। মাত্র ৪১ কিলোমিটার (১৫ মাইল) দীর্ঘ এবং ১০ কিলোমিটার (ছয় মাইল) চওড়া গাজা। সংঘাতের আগে গাজায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে গড়ে পাঁচ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি মানুষ বসবাস করত। ২০১১ এবং ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সংঘাতে জনবহুল এই এলাকায় বিস্ফোরক অস্ত্র ব্যবহার করে, গড়ে ৯০ শতাংশ বেসামরিক মানুষ হতাহত করেছে ইসরায়েল। সশস্ত্র সহিংসতার ওপর গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি গ্রুপ অ্যাকশন এই তথ্য জানিয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দাদের মূল্যায়ন অনুসারে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ইসরায়েল গাজায় ২৯ হাজারের বেশি বোমা ফেলেছিল, যার মধ্যে ৪০-৪৫ শতাংশ ছিল অনির্দেশিত। সিএনএন এই মূল্যায়নটি যাচাই করে দেখেছে। ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলেছে, তারা বেসামরিক জনগণের ক্ষতি এড়াতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এই সতর্কতার মধ্যে ছিল হামলার আগে বেসামরিকদের জানানো। ইসরায়েলে এখনও জোর দিয়ে বলেছে, বেসামরিক মানুষ হত্যার ক্ষেত্রে তার রেকর্ড অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংঘাতের তুলনায় ভাল। তারা বলেছে, ‘আমরা যখন অপ্রত্যাশিত বেসামরিক উপস্থিতি দেখতে পাই তখন আক্রমণ বন্ধ করে দিই। আমরা প্রতিটি লক্ষ্যবস্তুর জন্য সঠিক যুদ্ধাস্ত্র বেছে নিই। যাতে অপ্রত্যাশিত ক্ষতি এড়ানো যায়।’ ইসরায়েল আরো বলেছে, হামাস গাজার বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।
কতজন বেসামরিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে?
হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমান সংঘাতে গাজায় নিহতদের প্রায় ৭০ শতাংশ নারী ও শিশু। গত ১৯ ডিসেম্বর হামাসের সরকারি মিডিয়া অফিস জানায়, ১৯ হাজার ৬৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। যেখানে ৮ হাজারের বেশি শিশু এবং ৬ হাজার ২০০ জন নারী। আরো বলা হয়েছে, ৩১০ জন চিকিৎসা কর্মী, ৩৫ জন বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মী এবং ৯৭ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। যারা সবাই বেসামরিক নাগরিক। যুদ্ধ গাজার শিশুদের ওপর বিশেষভাবে বিধ্বংসী একটি প্রভাব ফেলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ২০২২ সালে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, এই অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার বয়স ১৮ বছরের কম। এ পর্যন্ত সংঘর্ষে ৫২ হাজার মানুষ আহত হয়েছে বলে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। আহত শিশুর কোনো নতুন পরিসংখ্যান না থাকলেও, ৩ নভেম্বরে ২৪ হাজার ১৭৪ জন আহত হয়েছে। যার মধ্যে ৮ হাজার ৬৭ শিশু, ৫ হাজার ৯৬০ জন নারী এবং ১০ হাজার ১৪৬ জন পুরুষ রয়েছেন।জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের মতে, গাজা এখন শিশুদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা। মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক অ্যাডেল খোদর বলেছেন, “সব আশেপাশের এলাকা, যেখানে শিশুরা খেলত, স্কুলে যেত তা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেখানে কোনো জীবর নেই।”
গাহজা যুদ্ধের সঙ্গে অন্য যুদ্ধের তুলনা
প্রতিটি সংঘাত বা যুদ্ধ ভিন্ন, লড়ায়ের ধরনও ভিন্ন। তবে বিবিসি বিশেষজ্ঞরা একমত যে, গাজায় হত্যার হার সাম্প্রতিক যে কোনো যুদ্ধের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। ২০১৪ সাল থেকে যুদ্ধ এবং সংঘাতে বেসামরিক মৃত্যুর ওপর নজর রাখছে এমন একটি সংস্থা এয়ারওয়ারসের এমিলি ট্রিপ বলেছেন, “আমরা বেসামরিক মৃত্যুর যা সংখ্যা দেখছি, তা ইতিমধ্যেই আমাদের নথিভুক্ত করা যে কোনো সংখ্যার হারকে ছাড়িয়ে গেছে।” পেন্টাগনের প্রাক্তন গোয়েন্দা বিশ্লেষক মার্ক গারলাসকো বলেছেন, ‘একটি ছোট জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ব্যবহৃত উচ্চ মাত্রার বিস্ফোরকগুলো আঘাত হেনেছে। এই যুদ্ধের একটি তুলনামূলক উদাহরণ হতে পারে ভিয়েতনাম যুদ্ধ। যেখানে ১৯৭২ সালে প্রায় ২০ হাজার টন বোমা ফেলা হয়েছিল। সেই বোমা হামলায় আনুমানিক এক হাজার ৬০০ ভিয়েতনামের নাগরিক নিহত হয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ২০১৭ সালে সিরিয়ার রাক্কা শহর থেকে আইএসকে তাড়ানোর জন্য চার মাসের অভিযানের সময়, মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান ও কামান হামলায় প্রতিদিন গড়ে ২০ জনেরও কম বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিল। সেই সময়ে সেখানে কতজন বেসামরিক লোক বাস করত তা স্পষ্ট নয়। তবে জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের ধারণা, ৫০ হাজার থেকে এক লাখের মধ্যে ছিল। এক লাখ ৬০ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছিল তখন।একটি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস তদন্ত জানিয়েছে, ২০১৭ সালে শেষ হওয়া ইরাকি শহর মসুলে মার্কিন সমর্থিত ইরাকি বাহিনী এবং আইএস-এর মধ্যে নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে ৯ হাজার থেকে ১১ হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল। যা গড়ে প্রতিদিন আনুমানিক ৪০ জনের কম। ২০১৪ সালে আইএস যখন শহরটি দখল করে, তখন মসুলের আনুমানিক জনসংখ্যা ছিল দুই মিলিয়নেরও কম। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রায় দুই বছর পার হলো। জাতিসংঘ ধারণা করছে, যুদ্ধে কমপক্ষে ১০ হাজার বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ মিশনও সতর্ক করেছে, প্রয়োজনীয় তথ্য, নানা চ্যালেঞ্জ এবং সময়ের কারণে গাজায় প্রকৃত মৃতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি হতে পারে। বিবিসর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সংঘর্ষে হতাহতের হার তুলনা করা কঠিন। কারণ মৃত্যুর সংখ্যা গনণার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
কতজন হামাস যোদ্ধা নিহত হয়েছে?
হামাসকে ইসরায়েলি ও যুক্তরাজ্য সরকার সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ধরে। ইসরায়েল বলেছে তাদের লক্ষ্য হামাসকে ধ্বংস করা। কিন্তু যুদ্ধে কতজন হামাস সদস্যকে হত্যা করেছে তা স্পষ্ট করে বলেনি। কর্মকর্তারা এর আগে বলেছিল, হাজার আবার বলেছিল, ৭ হাজার। সরাসরি জিজ্ঞাসা করা হলে ইসরায়েলি সামরিক বাহীনি বলেছিল, ‘হামাস সন্ত্রাসীদের কতজন নিহত হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা তাদের কাছে নেই।’বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ইসরায়েলের সিনিয়র কর্মকর্তারা জানান, ইসরায়েল প্রতি একজন হামাস যোদ্ধার জন্য দুইজন ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। আইডিএফ-এর মুখপাত্র জোনাথন কনরিকাস সিএনএন-এর কাছে এই অনুপাতটিকে ‘অত্যন্ত ইতিবাচক’ বলে বর্ণনা করেছেন। বিবিসি নিহত যোদ্ধাদের সংখ্যা যাচাইয়ের সুস্পষ্ট পদ্ধতি বের করতে পারেনি।অধ্যাপক মাইকেল স্পাগাট বলেছেন, নিহতদের মধ্যে ৮০ শতাংশ বেসামরিক হলে তিনি অবাক হবেন না। তিনি আরো বলেন, আইডিএফ বিশদ বিবরণ এবং কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই নিহত হামাস যোদ্ধাদের সংখ্যা বলে যাচ্ছে। ইরাক যুদ্ধে মৃত্যুর সংখ্যা পর্যবেক্ষণ করেছে এমন একটি সংস্থা, ইরাক বডি কাউন্টের হামিত দারদাগান এবং জন স্লোবোদা বলেছেন, ‘গাজায় নিহত বেসামরিকদের মধ্যে কতজন হামাস যোদ্ধা তার নির্ভরযোগ্য কোনো পরিসংখ্যান নেই।’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct