ইসরায়েল একদিকে গাজায় হামলা চালাচ্ছে, অন্যদিকে তারা ফিলিস্তিনিদের নিজেদের মধ্যকার ঐক্যে চিড় ধরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা সাধারণ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে তাঁদের বোঝাতে চেয়েছে, এই প্রতিরোধ যুদ্ধে তাঁদের শামিল হওয়ার কোনো দরকার নেই। ফিলিস্তিনিদের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে তাঁদের মধ্যে বিভাজনরেখা টানা এবং এর মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে প্রতিযোগী মানসিকতা সৃষ্টি করা ইসরায়েলের সরকারের বহু পুরোনো কৌশল। লিখেছেন ফরিদ তামাল্লাহ।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো ও রাজনীতিকেরা ৭ অক্টোবরের পর থেকেই গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধকে ‘ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করে আসছেন। ইসরায়েল শুরু থেকেই বলে আসছে, তাদের এই যুদ্ধ মূলত হামাসের বিরুদ্ধে। কিন্তু দুই মাস ধরে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইসরায়েল কোনো ধরনের বাছবিচার না করে গাজার স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, বেকারি, হাসপাতাল, জাতিসংঘের স্থাপনা, আবাসিক এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালাচ্ছে; অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, আদতে তাদের লক্ষ্যবস্তু শুধু হামাস নয়। ইসরায়েল একদিকে গাজায় হামলা চালাচ্ছে, অন্যদিকে তারা ফিলিস্তিনিদের নিজেদের মধ্যকার ঐক্যে চিড় ধরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা সাধারণ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে তাঁদের বোঝাতে চেয়েছে, এই প্রতিরোধ যুদ্ধে তাঁদের শামিল হওয়ার কোনো দরকার নেই।
ফিলিস্তিনিদের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে তাঁদের মধ্যে বিভাজনরেখা টানা এবং এর মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে প্রতিযোগী মানসিকতা সৃষ্টি করা ইসরায়েলের সরকারের বহু পুরোনো কৌশল।ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণ করতে কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল সরকার নিরাপত্তার নামে তাঁদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে। ফিলিস্তিনিরা যাতে ভবিষ্যতে কখনোই রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারেন, সে জন্য ইসরায়েল তাঁদের সামাজিকভাবে ছিন্নভিন্ন করার চেষ্টা করে গেছে।‘হামাসকে নির্মূল করার পর’ ফিলিস্তিনিরা যাতে এক হতে না পারেন, সে বিষয়ে সম্প্রতি ইসরায়েলের নেতারা আলোচনা করেছেন। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের পশ্চিম তীর এবং গাজাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অভিন্ন ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ধারণাকে নাকচ করে দিয়েছেন। ইসরায়েল খুব ধূর্ততার সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আলাদা আলাদা শ্রেণি গড়েছে। কাউকে বেশি সুবিধা দিয়েছে, কাউকে কম সুবিধা ভোগ করতে দিয়েছে। কাউকে আবার দাসের মতো বানিয়ে রেখেছে। তবে ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করলেও চলমান এই যুদ্ধের কারণে সেই শ্রেণিবিভাজন দূর হয়ে যাচ্ছে।এমনকি এই যুদ্ধের সময় বন্দিবিনিময় চুক্তিতেও গাজার হামাস গোষ্ঠী পশ্চিম তীর, জেরুজালেম এবং ১৯৪৮ সালের ইসরায়েলের দখল করে নেওয়া ভূমি থেকে আটক করা ফিলিস্তিনিদের মুক্তির বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যে শ্রেণীকরণ ছিল, সেটি এখন আর কাজ করছে না। আদতেই ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখে পড়া ফিলিস্তিনিদের নিজেদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ফিলিস্তিনিদের বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করতে ইসরায়েল দীর্ঘদিন থেকেই নানা কৌশল অবলম্বন করে আসছে। যেমন যেসব ফিলিস্তিনির ইসরায়েলি নাগরিকত্ব রয়েছে, তাঁদের ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ ১৯৪৮ সালের ফিলিস্তিনি অথবা ‘ইসরায়েলি আরব’ বলে উল্লেখ করছে। একইভাবে তারা পূর্ব জেরুজালেম এবং পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদেরও ‘ইসরায়েলি আরব’ বলে উল্লেখ করে থাকে। অন্যদিকে গাজার ফিলিস্তিনিদের তারা বলে ‘গাজাবাসী’।২০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনির ইসরায়েলি নাগরিকত্ব রয়েছে এবং ১৯৪৮ সালের নাকবা থেকে এখন পর্যন্ত তাঁরা তাঁদের পৈতৃক ভিটায় বসবাস করে আসছেন।২০০৩ সাল থেকে ইসরায়েল সরকার একটি অস্থায়ী আদেশবলে ইসরায়েলি নাগরিকত্ব পাওয়া ফিলিস্তিনিদের এবং ইসরায়েলের দখলকৃত এলাকার ফিলিস্তিনিদের এক হওয়াকে নিষিদ্ধ করেছে।ইসরায়েলে বসবাসরত ফিলিস্তিনি নাগরিকদের সঙ্গে যাতে পশ্চিম তীর এবং গাজার ফিলিস্তিনিদের কোনো ধরনের সামাজিক বা রাজনৈতিক সম্পর্ক না থাকতে পারে, সে জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৩ সালের আগেও ইসরায়েলে ফিলিস্তিনিদের স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাওয়া এবং সেখানকার ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে পশ্চিম তীর বা গাজার ফিলিস্তিনিদের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি পেতে অশেষ দুর্ভোগ পোহাতে হতো। ইসরায়েলে বসবাসরত কোনো ফিলিস্তিনি পশ্চিম তীর কিংবা গাজার ফিলিস্তিনি নাগরিককে বিয়ে করতে চাইলে ইসরায়েল সরকারের কাছে এর অনুমতি চেয়ে আবেদন করতে হতো। আবেদন করার পর সেই আবেদন গৃহীত বা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সাধারণ গড় সময়সীমা ছিল পাঁচ বছর। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল জেরুজালেম দখল করে নেওয়ার আগে সেখানে যাঁরা বাস করতেন এবং এখনো বাস করেন, তাঁরা মূলত জেরুজালেমবাসী ফিলিস্তিনি। কিন্তু ইসরায়েলের আইন অনুযায়ী, সেখানকার ফিলিস্তিনিরা জেরুজালেমের ‘বাসিন্দা’; নাগরিক নন। এই ‘বাসিন্দাদের’ একটি নীল রঙের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে, যার সাহায্যে তাঁরা সেখানে বসবাসের অনুমতি পেয়েছেন। জেরুজালেম থেকে ইসরায়েল এবং পশ্চিম তীরে যাতায়াতের সময় সেই পরিচয়পত্র তাঁদের নিয়মিত দেখাতে হয়। এর বাইরে তাঁদের একটি জর্ডানিয়ান পাসপোর্ট এবং ইসরায়েলি ট্রাভেল ডকুমেন্ট রয়েছে। এটিকে ইসরায়েলিরা বলেন, ‘লাইসেজ পাসার’। এটি দিয়ে তাঁরা বিদেশে যাতায়াত করতে পারেন; অর্থাৎ জেরুজালেমের ফিলিস্তিনিরা বিদেশে যাওয়ার সময় কোনো ধরনের ফিলিস্তিনি ডকুমেন্ট ব্যবহার করতে পারেন না।জেরুজালেমে বসবাসকারী কোনো ফিলিস্তিনি জেরুজালেমের বাইরের কাউকে বিয়ে করলে তাঁকে নিয়ে সাধারণত জেরুজালেমে বসবাস করার অনুমতি পান না।পশ্চিম তীরে যে ফিলিস্তিনিরা বাস করেন, তাঁদের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ইস্যু করা একটি সবুজ পরিচয়পত্র রয়েছে। ১৯৪৮ সালের দখল করা ইসরায়েলি ভূখণ্ডে এবং জেরুজালেমে তাঁরা যেতে চাইলে তাঁদের পশ্চিম তীরের ইসরায়েলি বেসামরিক প্রশাসনের ইস্যু করা অস্থায়ী পারমিট নিতে হয়; অর্থাৎ ইসরায়েলের অনুমতি ছাড়া পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরাও নিজ এলাকার বাইরে যেতে পারেন না।
পশ্চিম তীরের এই ফিলিস্তিনিদের খুবই শক্ত শর্তে খুবই সীমিত পরিমাণে গাজায় যাওয়ার অনুমতিপত্র দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে গাজা এবং পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ব্যাপক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের বিমানবন্দর ব্যবহার করে বিদেশে যেতে পারেন না। বিদেশে যেতে চাইলে তাঁদের অবশ্যই জর্ডানের সীমান্ত ব্যবহার করতে হয়। সেই সীমান্তও সরাসরি ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সর্বশেষ গাজার ২৩ লাখ ফিলিস্তিনিকে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে তাঁদের চারপাশ থেকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে সেখানকার হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।গাজার ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ইস্যু করা একটি পরিচয়পত্র দেওয়া থাকে। গ্রিন লাইন অতিক্রম করে তাঁদের পশ্চিম তীরে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। তবে ইসরায়েলের দেওয়া বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে তাঁরা সেখানে যেতে পারেন। গাজার সঙ্গে লাগোয়া রাফা সীমান্ত দিয়ে মিসরের একটি যোগাযোগের পথ থাকলেও ২০০৭ সালে মিসরীয় কর্তৃপক্ষ সেই সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিম তীর এবং গাজার বাসিন্দাদের ওপর ইসরায়েল অথবা জেরুজালেম ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা গাজায় এবং গাজার ফিলিস্তিনিরা পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনোভাবে যাওয়া-আসা করতে পারেন না।যদিও আইনগত কোনো বিধিনিষেধ নেই, তারপরও পশ্চিম তীরের কোনো ফিলিস্তিনি গাজার কোনো ফিলিস্তিনি নাগরিককে বিয়ে করতে পারেন না। দুই অঞ্চলের মধ্যে চলাচল করার জন্য ইসরায়েলি সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের যে অনুমতিপত্র নেওয়া লাগে, তার শর্ত হিসেবে আবেদনকারীকে বায়োমেট্রিক ইনফরমেশন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাছে জমা দিতে হয়। এই জন্মসংক্রান্ত তথ্যগুলো পরবর্তী সময়ে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী তাদের সামরিক কার্যক্রমে ব্যবহার করে এবং ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণের কাজে সেগুলো ব্যবহৃত হয়।সেই বিশেষ পরিচয়পত্র বা ম্যাগনেটিক কার্ড পাওয়ার পর ফিলিস্তিনিদের নির্দিষ্ট সময় পর তা নিয়মিত নবায়ন করতে হয়। পরিচয়পত্র নবায়নের ক্ষেত্রে ইসরায়েলি গোয়েন্দা এজেন্টদের অনুমতি নিতে হয়।ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শ্রেণিবিভাজন তৈরি করার জন্য ইসরায়েলের কর্তৃপক্ষ পশ্চিম তীর এবং গাজায় বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনিদের ভিআইপি কার্ড দিয়ে থাকে। মূলত রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উচ্চ অবস্থানে থাকা মানুষেরা এসব ভিআইপি কার্ড পেয়ে থাকেন। ভিআইপি কার্ডধারীরা সহজেই ইসরায়েলে যেতে পারেন এবং ইসরায়েলের এয়ারপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে যাতায়াত করতে পারেন। একইভাবে ইসরায়েল বিএমসি বা (বিজনেস ম্যানস কার্ড) নামের একটি আলাদা ধরনের পরিচয়পত্র ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার বড় বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ীদের দিয়ে থাকে। এই সুবিধাপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনিরা তেল আবিব বিমানবন্দর থেকে বিদেশে যাতায়াত করতে পারেন। খুবই সুচিন্তিতভাবে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শ্রেণিবিভাজন তৈরির লক্ষ্যেই কিছু ফিলিস্তিনিকে এ ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে। এত চালাকি করার পরও ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বন্ধন নষ্ট করতে পারেনি; বরং গাজায় নারী ও শিশুদের নির্বিচার হত্যার মাধ্যমে ইসরায়েল তার আসল চেহারা ফাঁস করে দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে হামাস এবং ফাতাহ আন্দোলনের মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও ফিলিস্তিনিদের বৃহত্তর স্বার্থের ইস্যুতে তাদের উদ্দেশ্য ও আদর্শ একই অবস্থানে রয়েছে।ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে যে ইসরায়েল বিভেদ ঘটাতে পারেনি, সেটি সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর একটি বক্তব্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে। সম্প্রতি গাজা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘গাজা হামাসাস্তানও হবে না, ফাতাহস্তানও হবে না।’ তিনি বলেছেন, তিনি হামাস ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যে নীতিগত কোনো পার্থক্য দেখেন না। ৭ অক্টোবরের আগেও ফিলিস্তিনিরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে এক ছিলেন এবং এই হামলার পর তাঁদের সেই বন্ধন আরও জোরালো হয়েছে। তাঁরা প্রমাণ করছেন, ফিলিস্তিনি রক্তকে দখলদারের বুলেট দিয়ে আলাদা করা যাবে না।
মিডল ইস্ট আই থেকে ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct