এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জলবায়ু সংকট বিষয়ে কাজ করার সুবাদে আমি বলতে পারি যে, জলবায়ু সমস্যার জন্য সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি অগ্রাহ্যতা বা উদাসীনতা নয়, বরং সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি হচ্ছে সন্দেহ ও বিভ্রান্তি। এ কারণেই এবার দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত কপ-২৮-এর ফলাফল এত হতাশাজনক। লিখেছেন জন ডি. সাটার।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জলবায়ু সংকট বিষয়ে কাজ করার সুবাদে আমি বলতে পারি যে, জলবায়ু সমস্যার জন্য সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি অগ্রাহ্যতা বা উদাসীনতা নয়, বরং সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি হচ্ছে সন্দেহ ও বিভ্রান্তি। এ কারণেই এবার দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত কপ-২৮-এর ফলাফল এত হতাশাজনক। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের মতো বিপর্যয়কে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য একটা আন্তর্জাতিক সমাবেশে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে অধিক বাসযোগ্য একটা পৃথিবী গড়তে এবং মানবজাতির ভবিষ্যেক আরো নিরাপদ করতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ একত্রিত হয়েছেন দুবাইয়ে। একটা বিষয় সবার কাছে পরিষ্কার হওয়া উচিত। বায়ু এবং সৌরশক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে বিশ্ব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করবে, মানবজাতির জন্য সেটা ততই মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসবে। এক্ষেত্রে আমাদের সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এবং রাজনৈতিক সহযোগিতা উভয়ই রয়েছে। তার পরও (কনফারেন্স অব পার্টিজ) কপ-২৮-এর আলোচনা বিতর্ক এবং বিভ্রান্তিতে পরিণত হয়েছে। এবারের আয়োজক সংযুক্ত আরব আমিরাত, যে দেশ নিজেই জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে থাকে। এবারের কপ-২৮-এর সভাপতি হলেন—সুলতান আল জাবের, যিনি একাধারে একটি নবায়নযোগ্য শক্তি কোম্জলর প্রধান এবং আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্জলর প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু আলোচনা চালানোর জন্য একজন তেল ব্যবসায়ীকে নিয়োগ করা আর একজন বন্দুক ব্যবসায়ীকে বন্দুকের ব্যবহার বন্ধ করার দায়িত্ব অর্পণ করা একই কথা। এক্ষেত্রে কখনো কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া সম্ভব নয়। এখানে মি. আল জাবের যে মন্তব্য করেছেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ এই বিশ্বে সবাই নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। তিনি বলেছেন ‘এই মুহূর্তে জীবাশ্ম জ্বালানি সম্পূর্ণ বন্ধ করলে আমাদেরকে আবার গুহায় বাস করার যুগে ফিরে যেতে হবে।’ তিনি এটাও বলেছেন জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করলেই যে আমরা গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব, তার কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যতা নেই। অথচ এবারের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কীভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। তিনি কপ-২৮ শুরু হওয়ার পূর্বে গত ২১ নভেম্বর বলেছিলেন, ‘আপনারা আমাকে এমন একটা রোডম্যাপ দেখান, যেখানে জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের মাধ্যমে একটা টেকসই আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করলে আমাদেরকে আবার গুহার যুগে ফিরে যেতে হবে।’ তার এই মন্তব্য আয়ারল্যান্ডের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এবং জাতিসংঘের বিশেষ জলবায়ু বিষয়ক দূত মেরি রবিনসনের সঙ্গে একটা কথোপকথনের অংশ ছিল, যা সর্বপ্রথম দ্য গার্ডিয়ানের একটা রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তারা উক্ত কথোপকথনের ভিডিও তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞান এমন কোনো নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে না, যে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করলেই আমরা বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জন করতে পারব।’ কপ-২৮ চলাকালীন গত রবিবার জাতিসংঘের এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের একটা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘বৈশ্বিক জলবায়ু লক্ষ্য পূরণের জন্য অতি দ্রুত কৌশলগতভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে।’
এরপর সোমবার মি. আল জাবের একটা সংবাদ সম্মেলনে তার কথা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি বিজ্ঞানকে সম্মান করি এবং আমার মন্তব্যগুলোকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। আমি বারবার বলেছি যে, নিরাপদ বিশ্বের জন্য কৌশলগতভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি।’ ততক্ষণে অবশ্য তার আগের মন্তব্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই পুরো প্রক্রিয়ায় মি. আল জাবেরের উদ্দেশ্য নিয়ে পর্যবেক্ষকদের প্রশ্ন করার অধিকার রয়েছে এবং সাধারণ জনগণেরও এটা জানার অধিকার রয়েছে যে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বনেতারা আসলেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা করছে কি না। জলবায়ু সংকট নিরসনে জীবাশ্ম জ্বালানির ভূমিকা সম্পর্কে জনসাধারণের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়ার বিষয়টা অত্যন্ত দুঃখজনক। সেটাও আবার এমন একটা প্ল্যাটফরমে, যার আয়োজনই করা হয়েছে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কীভাবে হ্রাস করা যায়, সে সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য। যেখানে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে জীবাশ্ম জ্বালানি একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এবং সেটা কয়েক দশক আগেই পরিষ্কার হয়ে গেছে, সেখানে এমন মন্তব্য মোটেও সমীচীন নয়। ১৯৭০-এর দশকে জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্জলগুলো তামাকশিল্পের মতো ধূর্ত পন্থা অবলম্বন করে মানুষের মনে তাদের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল। সেই সন্দেহের ফল আজও জলবায়ু সংকট নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার মধ্যে লক্ষ করা যায়। জনসাধারণের মধ্যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করার সুযোগ এমনিতেই কম। বছরে একবার ‘কনফারেন্স অব পার্টিজ’ মিটিংয়ের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকট সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরির একটা সুযোগ পাওয়া যায়। তার ওপর সেখানে যদি মানুষের মধ্যে জলবায়ু সংকটের উত্স সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়, তাহলে তা খুবই হতাশাজনক। ক্লাইমেট চেঞ্জ কমিউনিকেশনের ইয়েল প্রোগ্রামের ২০২১ সালের জরিপ অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ৩৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি জলবায়ু সংকট সম্পর্কে আলোচনা করে। আমাদের গ্রহের বাসযোগ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকায় আমরা যা আশা করি, তা পুরোপুরিভাবে পাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের বিশ্ব যে আজ দাবানল, চরম আবহাওয়া, খরাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে, তার কারণ আমরা নিজেরাই। আমরাই আমাদের বিশ্বকে ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছি। আমরা যে কতটা বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, তা মি. আল জাবেরের মন্তব্য পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়। সাময়িক লোভের জন্য নিজেরাই আমাদের বাসস্থানকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গত তাপ ও কার্বনের ফলে বছরের পর বছর দূষণ বেড়েই চলেছে। প্রচুর লোক এবং কোম্জল রয়েছে যারা এটা থেকে লাভবান হচ্ছে। সম্ভবত আল জাবেরকে পদত্যাগ করার আহ্বান কপ-২৮-এর বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করার জন্য একটা স্বল্পমেয়াদি সমাধানের অংশ হতে পারে। তবে এখানে একটা বিষয় রয়েছে, যা সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। সেটা হলো আমাদের অবশ্যই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার দাবি তুলতে হবে। কপ-২৮-এ উপস্থিত বিশ্বনেতাদের উচিত, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার সীমিতকরণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং সে উদ্দেশ্যে কাজ করা। জনসাধারণের কাছে এ ব্যাপারে তাদেরকেই জবাবদিহি করতে হবে।
লেখক: জলবায়ু সাংবাদিক এবং ননফিকশন চলচ্চিত্র নির্মাতা। জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির এনভায়রনমেন্টাল মিডিয়ার ভিজিটিং প্রফেসর
সিএনএন থেকে অনুবাদ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct