ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ চলছে দুই মাসের বেশি সময় ধরে। মাঝে কিছুদিনের জন্য যুদ্ধবিরতি ছিল। তবে এই সংঘাত যে খুব বেশি দিনের জন্য বন্ধ থাকার নয়, তা জানাই ছিল। যদিও স্থায়ী যুদ্ধবিরতিই কামনা ছিল সবার। সন্দেহ নেই, এই যুদ্ধ যত সামনের দিকে গড়াবে, ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে থাকবে ততই। যুদ্ধের দামামায় গাজার অবস্থা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠবে। এই সংবাদ নিতান্ত দুঃখজনক বটে। লিখেছেন ইয়োসি মেকেলবার্গ।
ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ চলছে দুই মাসের বেশি সময় ধরে। মাঝে কিছুদিনের জন্য যুদ্ধবিরতি ছিল। তবে এই সংঘাত যে খুব বেশি দিনের জন্য বন্ধ থাকার নয়, তা জানাই ছিল। যদিও স্থায়ী যুদ্ধবিরতিই কামনা ছিল সবার। সন্দেহ নেই, এই যুদ্ধ যত সামনের দিকে গড়াবে, ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে থাকবে ততই। যুদ্ধের দামামায় গাজার অবস্থা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠবে। এই সংবাদ নিতান্ত দুঃখজনক বটে।যুদ্ধবিরতির পর আবারও ভয়াবহ হামলা শুরু হয়েছে গাজায়। ইসরাইলি বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে প্রতিদিন শত শত মানুষ মরছে গাজা উপত্যকায়। অর্থাত্, সামনের দিনগুলোতে গাজাকে আরো মূল্য চোকাতে হবে। শুধু গাজাবাসীর বেলায় নয়, এই সংঘাত শঙ্কার মুখে ফেলে দিয়েছে হামাসের হাতে জিম্মি থাকা ইসরাইলি নারী ও শিশুদের জীবনও।হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার, মোহাম্মদ দেইফসহ দলের সিনিয়র কর্মকর্তাদের হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে ইসরাইলি সেনারা। ইসরাইলের অনুমান, দক্ষিণ গাজায় লুকিয়ে আছে তারা। এতে করে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ফোকাস এখন দক্ষিণাঞ্চলে। হামলা করতে করতে ক্রমশ এই অঞ্চলে ঢুকে পড়েছে নেতানিয়াহু বাহিনী। সম্ভবত খান ইউনিস শহরের মাটির নিচের টানেলের অন্ধকার পরিবেশে লুকিয়ে আছে হামাস—এমন ধারণা থেকে এই অঞ্চলে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। এতে করে শুরু হয়েছে নতুন সমস্যা। নিকটস্থ শরণার্থী শিবিরসহ এতদাঞ্চলে নেমে এসেছে অসহনীয় মানবিক সংকট।মনে থাকার কথা, উত্তর গাজায় যখন হামলা চালাচ্ছিল ইসরাইলি বাহিনী, তখন সেখান থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে দিয়েছিল তারা। বাধ্য হয়ে দক্ষিণ গাজায় আশ্রয়শিবির ও শরণার্থী শিবিরিগুলোতে মাথা গুঁজে ছিল আতঙ্কিত মানুষ। হামাস নেতাদের ধরতে এখন এই অঞ্চলেও ইসরাইলি বাহিনী হামলা চালানোর কারণে পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে।অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেছিলেন, চলমান যুদ্ধ সপ্তাহব্যাপী বন্ধ থাকলে সংঘাত বন্ধের কোনো না কোনো রাস্তা ঠিকই বের হবে। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি মানবিক যুদ্ধবিরতির পটভূমি রচিত হবে। স্থায়ী যুদ্ধবিরতি না হোক, অন্তত বেশ খানিকটা লম্বা সময় যুদ্ধ বন্ধ থাকার ব্যবস্থা করা হবে, এমন প্রত্যাশাও ছিল অনেকের। তবে দুঃখজনকভাবে দিন কয়েকের যুদ্ধবিরতি শেষে সংঘাত আরো তীব্রতর হয়ে উঠছে। এই মুহূর্তে ইসরাইল এমন এক অবস্থানে রয়েছে, মনে হচ্ছে—এই যুদ্ধ যেন কোনোমতেই শেষ হওয়ার নয়! তেল আবিব যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, চূড়ান্ত বিজয়ের দেখা না পাওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা আসবে না তাদের মুখ থেকে। চুপচাপ বসে নেই হামাসও। তাদের পক্ষ থেকেও আত্মসমর্পণের সম্ভাবনা কম। আরো দুঃখজনক কথা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও যেন যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার বিষয়ে ভাবনাহীন! এ তো মহা মুশকিলের কথা!একটা বিষয় হয়তো চাপা পড়ে যাচ্ছে এসবের ভিড়ে—গাজার বেসামরিক মানুষের কথা। কোনো সন্দেহ নেই, এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হলো গাজার নিরপরাধ বেসামরিক মানুষ। বিশেষত এই সংঘাতে কয়েক হাজার নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ ঝরেছে। নিহতদের তালিকায় রয়েছেন বহু নারী ও বয়স্ক নাগরিক। হামাস যোদ্ধাদের টার্গেট করে গাজায় বোমা ছুড়ছে ইসরাইলি সেনারা, যাতে বেঘোরে মারা পড়ছে নিরীহ মানুষ—গাজাবাসীকে হতভাগ্যই বলেতে হয়।অচিরেই যদি এই যুদ্ধ বন্ধ না হয়, তাহলে আগামী দিনগুলোতে লাশের সংখ্যা হিসাবের বাইরে চলে যাবে। সাধারণ ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ-দুর্দশা বাড়তে থাকবে আরো দ্রুত গতিতে। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ গাজা অত্যন্ত জনবহুল এলাকা। এই অঞ্চলে অভিযানের অর্থ হলো মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ ঝরা। এই অর্থে বলতে হয়, নিজেদের উত্তর গাজার বসতবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসার পরও রেহায় মিলছে না গাজাবাসীর। নারকীয় পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য আর কোনো রাস্তাই খোলা নেই তাদের সামনে। মহাবিপদের কথা!ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই যুদ্ধবিরতি বেশি দিন না গড়ানোর জন্য হামাসকে দোষারোপ করে আসছে। এই পক্ষের অভিযোগ, হামাস তাদের হাতে আটক থাকা ইসরাইলিদের মুক্তি দিতে গড়িমসি করছে। টালটবাহনা করছে। নানা রকম শর্ত দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, ইসরাইলে আবারও ৭ অক্টোবরের মতো ভয়াবহ হামলা চালানো হবে বলে হুমকি দিচ্ছেন হামাস নেতারা। বলা বাহুল্য, তেল আবিব ও ওয়াশিংটনের এহেন প্রতিক্রিয়া পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তুলবে আগামী দিনগুলোতে।
যুদ্ধবিরতির বিষয়ে হামাস নেতারা ঠিক কী ভাবছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে তারা যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে ছিলেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। কারণ, এটাই এখন অনেক বেশি প্রয়োজন, বিশেষ করে গাজাবাসীকে বাঁচানোর প্রশ্নে। তবে ইসরাইলের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, যুদ্ধবিরতি তো ঘটবেই না, বরং ইসরাইলের ওপর ভয়াবহ হামলার জন্য দায়ীদের কঠিনতম শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত হামলা চালিয়ে যাবে তারা। হামাস সম্পূর্ণ পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে। ভুলে গেলে চলবে না, এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত বহু প্রাণ ঝরে গেছে। ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার জবাবে সেদিন থেকেই গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় এ পর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। অন্যদিকে, ১ হাজারের কিছু বেশি ইসরায়েলি নিহত হয়েছে হামাসের হামলায়। তাছাড়া বহু গণমাধ্যমকর্মী, অ্যাথলেট, মানবাধিকার, ত্রাণকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার লোক নিহত হয়েছেন। অর্থাত্, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, পরিস্থিতি কতটা বিপর্যয়কর। যুদ্ধ চলছে দুই মাসের বেশি সময় ধরে, কিন্তু ইসরাইল এখনো এ বিষয় পরিষ্কার করেনি যে, বেসামরিক মানুষের দুর্ভোগ না ঘটিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঠিক কী ধরনের কৌশল ধরে এগোতে চায় তারা। বিষয়টি খোলাসা হওয়া উচিত। কারণ, চলমান পরিস্থিতি গাজার জনগণের জন্য কেবল অসহনীয় অনিশ্চয়তাই তৈরি করবে। আরো বড় চিন্তা, যুদ্ধ ক্রমশ ঝুলে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। প্রচণ্ড ভয় ও চাপের মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। অথচ যুদ্ধ বাধার পেছনে এসব মানুষের কোনো হাতই ছিল না। অনেকেই বলে থাকেন, ইসরাইল এমন মনোভাব নিয়ে হামলা চালাচ্ছে, যেন এক দিনের মধ্যেই সব হিসাব চুকিয়ে নিতে চায়। যুদ্ধেবিরতি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে বোমাবর্ষণ তীব্র করেছে ইসরাইল, তাতে করে তেল আবিব ও তার মিত্রদের কঠিন মনোভাব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় বইকি। অতি সম্প্রতি খান ইউনিস থেকে রাফাহ পর্যন্ত আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। এর ফলে কতটা আতঙ্ক, ভয় ও উদ্বেগ ঘিরে ধরেছে এই অঞ্চলের মানুষকে, তা সহজেই অনুমেয়। সব থেকে বড় কথা, উত্তর গাজাকে মৃত্যুপরীতে পরিণত করে ইসরাইলি বাহিনীর এখন নজর পড়েছে দক্ষিণ গাজার দিকে। এতে স্বভাবতই উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা বেড়ে গেছে। আমরা দেখে আসছি, হামলার শিকার গাজাবাসী কী মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে! খাদ্য নেই, পানি নেই; নেই মাথা গোজার ন্যূনতম ঠাঁই। সহায়সম্বলহীন একধরনের ‘ভয়ের জগতে’ বাস করছে তারা। অথচ এত বড় দুর্ভোগের পরেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন বধির! খুব ভালো করে খেয়াল করার বিষয়, ইসরাইলি ভূখণ্ডে হামাস হামলা চালানোর সূত্র ধরে হামাস নেতাদের নির্মূলে ইসরাইল একধরনের ‘আইনগত সুযোগ’ পেয়ে যায়। যেন যুদ্ধ চালানোর অধিকার হাতে আসে ইসরাইলের! আশ্চর্য হওয়ার বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই হামলায় হতবাক হয়ে সমর্থন জানায় ইসরাইলকে। যাহোক, আজ না হোক কাল, এই সংঘাত শেষ করতে হবে সেই একই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। সুতরাং, যুদ্ধের অবসান ঘটাতে কেন এই কালবিলম্ব? অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, একটি ভালো ভবিষ্যত্ নিশ্চিত করা গেলেই কেবল এই যুদ্ধে মধ্যস্থতাকারীরা প্রশংসা পাবে। যুদ্ধের অবসান ঘটলে স্পষ্টতই ফিলিস্তিনিদের বেশি লাভ হবে। তবে ইসরাইলেরও কম লাভ হবে না। কারণ, লম্বা সময় ধরে এই যুদ্ধ চলতে থাকলে নিজের খোড়া গর্তেই একসময় পড়ে যেতে হবে ইসরাইলকে। নৈতিকতার প্রশ্নে তো বটেই, আন্তর্জাতিক সমর্থন হারানোর বিষয়টিও এক্ষেত্রে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে তেল আবিবের জন্য।
লেখক: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ও কাথাম হাউজের মেনা প্রোগ্রামের সহযোগী ফেলো
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct