বসন্তের কোকিল
সনাতন পাল
বসন্ত কাল। চারিদিকে পত্র বিহীন গাছের ডালে থোকা থোকা লাল টুকটুকে পলাশ ফুলে ভর্তি। কুহু কুহু রবে মধুর কন্ঠে কোকিল ডাকছে। সেই ডাক শুনে পথের ধারে অন্ধ কানাই আনমনা হয়ে ফিক করে এক গাল হেসে দিল। তাই দেখে একটা কাক মনে মনে ভাবল, “ আমি যদি কোকিল হতে পারতাম ! তাহলে আমার মধুর কন্ঠ শুনেও হয়তো কোনো অন্ধ যুবক এমন ভুবনমোহন হাসি হাসত।” তারপরে সে ভাবল যে করেই হোক কোকিল হতে হবে। শত চেষ্টা করেও সে কোকিলের মত মধুর কন্ঠ করতে পারল না। এবার সে ভাবল দেহ টাকে যদি কোনো মতে কোকিলের মত করা যায়! কিন্তু কাকের গায়ের রং কালো হলেও কোকিলের চেয়ে অনেকটা বড় এবং আকৃতিও কোকিলের থেকে কিছুটা ভিন্ন। সে মনে করল এবার দেহটাকে ছোটো করতে হবে। সে এক নাপিতের কাছে গিয়ে বলল, “ হাতে কাজ কাম কিছু নাই বুঝি। বেশ ভালো সময়েই এসে পড়েছি, ভায়া। আমার গায়ের পালক গুলো ছেঁটে ছুটে একটু কমিয়ে দাও দেখিনি।” নাপিত বলল, “ হঠাৎ করে তোমার আবার কি হলো!”, সে উত্তরে বলল,” না এমন কিছুই হয়নি, ভাবলাম শরীরটা একটু হাল্কা পাতলা করে নিই। “ কাকের মনে যে কোকিল সাজার সাধ জেগেছে এবং সেই জন্যই যে সে নাপিতের কাছে এসেছে সেটা আর সে নাপিত কে বলল না। কাকের কথা শুনে নাপিত তার ধারাল কাঁচি দিয়ে পালক গুলো সব ছেঁটে ছোটো করে দিল। কাক বলল, “ এবার তাহলে আসি, ভায়া। আবার পরে দেখা হবে।” নাপিত বলল, “ বেশ যাও, কিন্তু আমার পাওনাটা বুঝিয়ে দিয়ে যাও ভায়া।” , কাক বলল, “ দেব। আগে দেখি সবাই আমাকে কোকিল ভাবে কি না। যদি কোকিল ভাবে,তাহলে আগামী রবিবারে কিছু মাংসর টুকরো ম্যানেজ করে তোমাকে দিয়ে যাবো।” নাপিত বলল, “ সে কি গো! তুমি তো আগে একথা বলোনি যে তোমার পালক ছেঁটে কোকিল বানিয়ে দিতে হবে! এমন শুনলে আমি আগেই হাত তুলে দিতাম। এখন ওসব কথা চলবে না , কাজ করেছি তার জন্য উপযুক্ত পারিশ্রমিক চাই। তাই শুনে কাক নাপিতের কানের কাছে ভীষণ জোরে চিৎকার করে উঠল। নাপিত কাকের প্রতি অসন্তোষ দেখাতেই কাক রেগে গিয়ে বলল, “ বেশি কথা বললে এমন হাঁক ডাক শুরু করব, তখন সেটা শুনে অমঙ্গলের ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করবে। আর ঘরের জানালার পাশে মরা জীব জন্তুর পচা দেহ ফেলে দিয়ে যাবো, গন্ধে খাবার পেটে ঢুকবে না, তখন বুঝবে মজা।” নাপিত ভয় পেল। কাককে বলল, “ অযথা ঝামেলা করে কি হবে, ভায়া ! তোমার প্রস্তাবেই আমি রাজি।” কাক মুচকি হেসে বলল, “ তাই বলো, অবশেষে তাহলে লাইনে এলে !” শুনে নাপিত মৃদু স্বরে বলল, “ না এসে কি আর রক্ষা আছে। জোর যার মলুক তার।” কাক বলল, “ এই তো এতক্ষণে ঠিকঠাক বুঝেছ। “ এবার কাক নিজেদের মহল্লায় গেল। তাকে দেখে অন্য কাকেরা বলল, “ এ কি হাল করেছ ! এতো বিশ্রী লাগছে তোমাকে, সেটা আর বলা যাবে না। শুনে কাক তৎক্ষণাৎ ছুটল নাপিতের কাছে। বলল, “ আমার কাটা পালক গুলো আবার জুড়ে দাও।” শুনে নাপিত বলল, “ তা আর সম্ভব নয়।” শুনে কাক ভীষণ রেগে গেল। নাপিতকে বলল, “ পালক যদি জুড়ে দিতে না পারো, তাহলে তোমাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। “ নাপিত বুঝল এবার সে সত্যিই বিপদে পড়েছে। কাককে অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করল। কাক কিছুতেই বুঝল না। অবশেষে নাপিত ভীষণ রাগান্বিত হয়েও ভয়ে হাসিমুখে বলল,” ঠিক আছে কি ক্ষতিপূরণ চাও, বলো। “ কাক বলল, “ আজকে তোমার বাড়িতে কি বাজার করেছো ? “ বলল,” মাংস “। কাক বলল, “ বেশ, তাহলে ওগুলোই আমাকে দিয়ে দাও। এটাই ক্ষতিপূরণ। “ নাপিত মুখটা ভার করে কাঁচা মাংস গুলো সব কাককে দিয়ে দিল। কাক সেগুলো নিয়ে গিয়ে মহল্লার কাকদের বিতরণ করে দিয়ে বলল, “ এবার বল, পালক গুলো কেটে ভালো করেছি, নাকি খারাপ করেছি?” সবাই এক বাক্যে বলল, “ খুব ভালো করেছো, বস্। কাক মুচকি হেসে বলল, “ হ্যাঁ। এবার থেকে সবাই আমার গুণগান করবি,তাহলে মাঝে মধ্যেই ছিটা ফোঁটা খুদ গুড়ো পাবি।” তাতে সবাই রাজি হলো।
তারপরে একদিন হঠাৎ করেই ঐ কাক কে একটা শালিক বলল, “ তুমি যদি কোকিল হতে, তাহলে আমি সারাজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকতাম।” শুনে কাক বলল, “ তুমি কি না শেষে আমাকে কোকিল হতে বলছ! কোথায় কোকিল আর কোথায় আমি ! কোকিলের পুচকি একটু দেহ। আমি তো ওদের পাত্তাই দিই না। সারা বছর দেখা নেই। শুধু বসন্ত কাল এলেই যত সব হাঁক ডাক শুরু হয়। আমরা সারা বছরই সব খানে থাকি। আর গলার জোর! সে তো কোকিলের থেকে আমারই অনেক বেশি। শালিক টা মুচকি হেসে বলল, “ তা অবশ্য ঠিকই বলেছ। তোমার গলার জোর সত্যিই বেশি। কিন্তু বড্ড কর্কশ। তোমার ডাক শুনলে মানুষ ভাবে এই বুঝি কোনো অমঙ্গল সংবাদ এলো। আর কোকিলের ডাক শুনলেই মানুষ ভাবে এই বুঝি বসন্ত উৎসব এলো। নানা রঙে সবাই নিজেকে রাঙাবে। বৃন্দাবনে ধুম পড়ে যাবে। যৌবনের নীল দিগন্তে ডানা মেলে মনটা উড়ে যাবে। আরও সব কত কি !” কাক শালিকের সব কথা মন দিয়ে শুনে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “তোমার বোধহয় নাপিতের মত দশাই করতে হবে।” শালিক ভাবল হঠাৎ আবার নাপিতের কথা এলো কেন ? ভাবতেই কাক বলল, “চল্ পথের ধারে নাপিতের কাছে আমার মহিমার কথা নিজে কানেই শুনে আয়।” কাক আর শালিক নাপিতের কাছে গেল। কাককে নাপিত দেখেই মনে মনে ভাবল , আবার সেই বিপদ এসে হাজির!মনের ভেতরে ভয় অথচ হাসতে হাসতে সে কাককে বলল, “ এই যে ভায়া, হঠাৎ আবার কি মনে করে এই অধমের কাছে আসা হয়েছে?” কাক বলল, “ তেমন কিছুই না, সেদিন তোমার কি হাল করেছিলাম সেটা এই ছ্যাঁচড়া শালিকটাকে একটু ভালো করে শুনিয়ে দাও তো।” তারপরে নাপিতের কাছে শালিক সব শুনে কাকের দিকে ঘুরে মাথা নিচু করে বলল, “ তোমার কাছে কোকিলের খাওয়া নাই বস্। কোথায় তোমার মত ডাকুবুকু পালোয়ান আর কোথায় ঐ পুচকি কোকিল! আজ থেকে আমি তোমার গোলাম হয়ে গেলাম। “ কাক শালিকের এই কথা শুনে বলল কেন ! কোকিলের মিষ্টি কন্ঠ আর শুনবি না!” শালিক বলল, “ ও সব ফালতু মিনমিনে কন্ঠ কেউ শোনে নাকি! তোমার আওয়াজের ধারে কাছে নাই।” ওদের সঙ্গে আরও একটা কাক এবং একটা শালিক ছিল। এরপরে দুই শালিক একদিকে গেল আর দুই কাক আরেক দিকে চলে গেল। খানিকটা দূরে গিয়ে এক শালিক আরেক শালিককে বলছে, “ তুমি কাককে মিছেই প্রশংসা করলে কেন? উত্তরে অন্য শালিক টি বলল,” না বলে কি আর রক্ষা আছে! ভয়ে সত্যি কথা বলার উপায় নাই, ভায়া। অনেক সময় জীবনে বাঁচতে এবং কিছু সুবিধা পেতে সত্যের গলা টিপে খুন করতে হয়। আমিও সেটাই করেছি। অযথা কে ঝামেলায় জড়াবে! তার চেয়ে কাক কে তোষামদ করে চললে বরং অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে আবার অত্যাচারের হাত থেকেও বাঁচা যাবে।” ওদিকে আবার এক কাক আরেক কাককে বলছে ,” দেখলি! ঠ্যালার নাম কেমন বাবাজি! সত্যের ভূত কেমন ঘাড় থেকে নেমে দৌড়ে পালাল? কষে একটা দিলেই সব ফুটুস। অপর কাক উত্তরে বলল, “ এসব জুলুম বাজি না করে আমরা যা সেটা থাকাই কি ভালো নয় !” অন্য কাক শুনে ভীষণ রেগে গিয়ে বলল, “ তোর সব যত সতীপনা। ছাড় তো এসব। আমাদের সবাই ঝাড়ুদার ভাবে আর ঐ কোকিল কে গায়ক বলবে ! এসব মানতে হবে নাকি ?” আমাদের কি পেস-টিজ নাই!” অপর কাকটি শুনে বলল, “ আমরা যা সেটাই বলবে তাতেই বা ক্ষতি কি! “ অপর কাক উত্তরে বলল, “ ব্যাপারটা লাভ ক্ষতির নয়, ইজ্জতের। ইজ্জত জোর করে আদায় করতে হবে। অন্তর থেকে সম্মান না করলেও চলবে- ভয়ে ভক্তি করলেই হবে।” উল্টো দিকের কাকটি শুনে বলল, “ এটা কি ঠিক?” উত্তরে সে বলল,” এখন এটাই চলছে।”
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct