রুদ্ধতায় একমুঠো শুদ্ধতা
আহমদ রাজু
শুধু আমি বুঝলেতো হবে না, গ্রামের সবারতো বুঝতে হবে। যাইহোক আমি কম বেশি সবাইকে বুঝিয়ে বলেছি জ্যামের কথা। সবাই মেনেও নিয়েছে। যাও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আসো।’আমার অন্তরে ধেয়ে আসে কান্নার বান। কী করবো এখন? সারা রাস্তা যা ভেবে এসেছি তার কিছুইতো হচ্ছে না। বাবাকে বললাম, ‘আব্বা, যখন বাঁধা পড়েছে তখন বিয়ে করতে যাওয়া কি ঠিক?’কথাটা শুনে তিনি যেন তেলে বেগুণে জ্বলে উঠলেন। বললেন, ‘আমি শুনেছি শিক্ষা অনেক কিছু শেখায়; আমি সেটা অনুভবও করেছি।’‘আমি কি কিছু বলেছি আব্বা?’‘কিছু বলো নি। তবে বলতে বাদও দাওনি। একটা মেয়ে অপেক্ষায় আছে, তাকে আজ কোন রাজার কুমার রানী করে নিয়ে যাবে। একটা পরিবার অপেক্ষায় আছে, তাদের কন্যা শ্বশুর বাড়ি যাবে স্বামীর হাত ধরে। আর একটা গ্রাম অপেক্ষায় আছে- তাদের গ্রামে একটা নতুন জামাই আসবে। আর তুমি কোথায়......’আমি বুঝতে পারছি বাবা কথাটাকে জটিল দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এমনিতে আমি আর নিস্তার পাবো না। তাহলে কেন এই কথার বহর বৃদ্ধি করা। তারপরও যদি বাংলা সিনেমার মতো শেষ দৃশ্যে ভাল কিছু হয় তার জন্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সঁপে দিই। বরযাত্রীর বহর নিয়ে আমরা যখন কথাদের বাড়িতে পেঁছাই তখন রাত আটটা। কিন্তু কী আশ্চর্য, কারো মুখে বিরক্তির কোন ছাপ লক্ষ্য করা গেল না। আমি মুখ রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখা বর তাতে কী, চোখ তো খোলা। সুযোগ বুঝে এদিক ওদিক তাকিয়েছি বেশ। বিয়ে শেষে নিজেদের বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত এগারোটা। বাড়ি ভর্তি লোকজন। নতুন বউ বাসর ঘরে বসে আছে। আমি সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে মোড়ের চায়ের দোকানে যাই কফি খেতে। কিছু না হোক. সারাদিনে দু’চার কাপ কফি না হলে আমার চলেই না। কফি খেয়ে উপস্থিত পরিচিত মুখগুলোর সাথে কথা বলতে বলতে রাত বেশ গভীর হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে দেখি কেউ ঘুমায়নি। কাল দুপুরে বৌভাতের অনুষ্ঠান থাকায় সবার ভেতরে একটা অন্যরকম আমেজ তখনও কাজ করছে। আমাকে সবার মাঝে বসতে দেখে ডনার মা ভাবী আমার হাত ধরে টেনে তুলে বাসর ঘরের দিকে নিয়ে একপ্রকার জোর করেই ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে সিটকিনি লাগিয়ে দেয়।নতুন বউ পালঙ্কের ওপর ঘোমটা টেনে বসে আছে। অগত্যা আমি আর কি করি, তার পাশে যেয়ে বসি। ঘরের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে আলনার পাশে একটা মৃদু শব্দ হওয়ায় সেদিকে চোখ পড়তেই পরাণ আমার চমকে ওঠে- সামনে অগ্নিমূর্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুষি। হয়তো এক্ষুনি তার চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসবে আমাকে আহত করার জন্যে। আমিতো মহা বিস্ময়ে বিস্মিত। ভুল দেখনি নাতো? সেই গেটআপ-মেকআপ, চেনা শার্ট-প্যান্ট! চেহারায়ও কোন পরিবর্তন নেই! যার সাথে বিগত এক বছর ধরে সংসার করছি তাকে দেখতে ভুল কীভাবে হতে পারে? ভয়ে হাত পা কাঁপতে থাকে। আমার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিতে সে হিন্দিতে বলল, ‘কী বলবে এখন?’ গলা- ঠোঁট শুকিয়ে আসে আমার। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের করতে পারি না। এমন সময় বাইরে থেকে বাবার কণ্ঠ. ‘বৌমা, আমার বোকা ছেলেটাকে আর কষ্ট দিও না।’তুষি গুটি গুটি পায়ে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার ঝাঁকড়া চুলের ভেতরে তার দুই হাতের আঙুলগুলি ঢুকিয়ে বিলি কাটতে কাটতে শুদ্ধ বাংলায় বলল, ‘আচ্ছা বাবা। আপনার ছেলে যে বোঝে না, সেটাও বোঝে না।’ অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ে সে। বাইরে বাবা-মা সহ সকলের হাসির রোল আমাকে ভাসিয়ে দেয় চরম শুদ্ধতায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct