বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এক অধঃপতনের যুগে মওলানা মোহাম্মাদ আকরম খাঁ-র জন্ম। সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর আবদান অবিস্মরণীয়। বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে বাঙলার মুসলমান সমাজকে তিনি ইসলামে প্রকৃত অনুসারী ও দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আজীবন সাধনা করেছেন। তাঁর স্মৃতিচারণায় ইতিহাসবেত্তা খাজিম আহমেদ...
বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এক অধঃপতনের যুগে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার হাকিমপুর নামক গ্রামের বিখ্যাত খাঁ পরিবারে মওলানা মোহাম্মাদ আকরম খাঁ-র জন্ম (১৮৬৯-১৯৬৮)।শৈশবেই ‘এতিম’ হওয়ার পর সংসারের নানাবিধ অভাব অবহেলা ও প্রতিকূল অবস্থার অবিশ্রান্ত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আকরম খাঁ সাহেব ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মাদ্রাসার শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আরবি সাহিত্যে তাঁর প্রশংসনীয় দখল ছিল। যৌবনে ফারসি কাব্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ আমাদের চমকিত করে। তাঁর ফারসি কবিতা চর্চার কথা আমরা অনেকেই জ্ঞাত নই। কলকাতা মাদ্রাসার তৎকালীন প্রিন্সিপ্যাল স্টিন সাহেব, মওলানার ফার্সী শায়েরী চর্চার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। আলেমবর্গ জনাব আকরম খাঁ-কে পরম আপনারজন হিসেবে আলিঙ্গন করেন।
উপমহাদেশের মুসলমানদের জীবনের হর স্তরে ক্রমাবনতির প্রেক্ষাপটেই মওলানা আকরম খাঁ-র কর্ম ও সাধনা শুরু হয়। সাধারণ মানুষকে করুণ ও মানবেতর জীবনযাপন থেকে উদ্ধার করার জন্য নিজের জীবনকে চালিত করেন। তিনি ছিলেন যথার্থ ‘হিউম্যানিস্ট’।প্রথমেই তিনি সংবাদপত্র প্রকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন। মাত্র এক টাকা তের পয়সা পুঁজি নিয়ে পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এটি কত যে দুঃসাহসিক ‘প্রজেক্ট’ তা ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। তবু তিনি ভয় পাননি।মাসিক মোহাম্মদী (১৯০৩), পাক্ষিক মোহাম্মদী, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, উর্দু দৈনিক জামানা, আল-ইসলাম, দৈনিক সেবক, দৈনিক আজাদ-এর মাধ্যমে একটি উপেক্ষিত জাতিসত্তার মর্যাদার অন্বেষণে নিজের জীবনকে মহান আল্লাহর দরবারে সঁপে দেন। অতি অল্পদিনের মধ্যেই সাবেক বাংলার বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে নতুন করে প্রাণস্পন্দন শুরু হয়। তাঁদের মধ্যে নয়া-জাগরণের সাড়া পড়ে যায়। মওলানা সাহেব প্রকাশিত এসব পত্রপত্রিকাকে কেন্দ্র করে একদল মুসলমান লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিক আত্মপ্রকাশ করেন যাঁরা পরবর্তীকালে দেশের কৃতী সন্তান হিসেবে পরিচিতি পান। এই প্রসঙ্গে আবুল কালাম শামসুদ্দিন এবং আবুল মনসুর আহমদের নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে।সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর আবদান অবিস্মরণীয়। বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে ইসলামের মর্মবাণী প্রচার করেছেন। বাঙলার মুসলমান সমাজকে তিনি ইসলামে প্রকৃত অনুসারী ও দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আজীবন সাধনা করেছেন। এমন বিচিত্র কর্মপ্রবাহে তাঁর ‘দোস্তজী’ খুবই কম, কিন্তু শত্রু ছিল অনেক। কিন্তু তিনি এক অপরাজেয় শক্তিতে বলীয়ান হয়ে, অপ্রতিহত গতিতে সম্মুখপানে এগিয়ে গেছেন। হর মুশিবতকে জয় করে তিনি দিশেহারা স্থবির মুসলমান কওমকে কল্যাণের পথে, মর্যাদা অর্জনের পথে পরিচালিত করেন এবং তাঁদের উজ্জ্বল জীবনের ‘অ্যাভিনিউ’-এর সামনে সটান দাঁড় করিয়ে দেন। এই কারণেই মওলানা মোহাম্মাদ আকরম খাঁ কালজয়ী।আর দু একটি কথা বলে আলোচনাটি শেষ করছি। ‘আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা’ আন্দোলনের কর্তা হিসেবে তিনি প্রকাশ করেছিলেন ‘আল-এছলাম’ নামক একটি পত্রিকা। এই পত্রিকার প্রবন্ধাবলী পাঠে বাংলার মুসলমানদের আত্মিক ও ধর্মীয় সত্তার অসাধারণ উজ্জীবন ঘটে। আন্তর্জাতিক ইসলামি চিন্তার কারণে ‘খেলাফত’ আন্দোলনে প্রত্যক্ষ যোগ দেন, কারারুদ্ধ হন, তেমনতরো সময়ে পবিত্র কুরআনের ‘আমপারা’-র সুললিত বঙ্গানুবাদ অনুবাদ করেছিলেন। এটি তাঁর তুলনারহিত পবিত্র কাজ। তাঁর রচিত ‘মোস্তফা চরিত’ তাঁর মহান দীর্ঘ জীবনের শ্রেষ্ঠ আর মহৎকৃত্য সম্পাদন বলে বিবেচিত হয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct