কেন্দ্রের মসনদে দ্বিতীয়বারের মতো ‘সম্রাটের’ ভূমিকায় নরেন্দ্র মোদি। তার শাসনামলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি তলানিতে, বৃদ্ধি পেয়েছে বিদ্বেষের মাত্রা। যদিও নির্বাচনে ডাক দিয়েছিলেন ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। বাস্তবে তার যথার্থ প্রতিফলন না ঘটলেও প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে নিজের ইমেজ তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। তা নিয়ে আলোকপাত করেছেন ড. দিলীপ মজুমদার।
দামোদর বীর সাভারকর নন, ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন বাঙালি লেখক চন্দনাথ বসু। সাভারকরের ‘Essentials of Hinditva’ প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে, তাঁর ‘ Hinditva ; who is Hindu’ প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে। কিন্তু চন্দ্রনাথ বসুর ‘হিন্দুত্ব’ বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৯২ সালে। তবে চন্দ্রনাথ বসুর ‘হিন্দুত্ব’ প্রকাশের অনেক আগে থেকেই বাংলায় বিচ্ছিন্নভাবে হিন্দুত্বের চর্চা হয়েছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের ছদ্মনামে ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘উনবিংশপুরাণ’। এই বইতে ভারতকে মাতৃরূপে কল্পনা করা হয়। অনেকের মতে ভূদেব মুখোপাধ্যায় ছদ্মনামে বইটি লিখেছিলেন। এর পরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারতমাতার’ ছবি আঁকেন। ১৮৬৭ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবগোপাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু প্রভৃতিরা গড়ে তোলেন ‘হিন্দুমেলা’। এই মেলা উপলক্ষে সংগীত রচনা করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই সংগীতের প্রথম পঙতি: ‘ মলিন মুখ-চন্দ্রমা মা ভারত তোমারই’। ১৮৭০ সালের শেষদিকে বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করেন ‘বন্দেমাতরম’ সংগীত, যা পরে ১৮৮০ সালে তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে স্থান পায়। ১৮৮২ সালে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’ নিবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র মুসলমান শাসকদের শাসনকালকে বাংলার ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত করতে অনীহা প্রকাশ করেন ; বাঙালি হিন্দুকে তিনি বাংলার যর্থার্থ ইতিহাস লিখতে অনুরোধ করেন। সে ইতিহাস হবে হিন্দুর ইতহাস।
১৮৯২ সালে ২০১, কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের মেডিকেল লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হয় চন্দ্রনাথ বসুর ‘হিন্দুত্ব’। বইটির সূচিপত্র এ রকম:
ক] সোহহং
খ] লয়
গ] নিষ্কাম ধর্ম
ঘ] ধ্রুব
ঙ] তুষানল
চ] কড়াক্রান্তি
ছ] পুত্র
জ] আহার
ঝ] ব্রহ্মচর্য
ঞ] বিবাহ
ট] তেত্রিশ কোটি দেবতা
ঠ] প্রতিমা বা মূর্তিপূজা
ড় ] মৈত্রী
ঢ় ] ক্রোড়পত্র
উনবিংশ শতকের শেষ দিকে বাংলায় দেখা যায় নব্য হিন্দু আন্দোলন। সে আন্দোলন সম্বন্ধে মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন সুনীতিরঞ্জন রায়চৌধুরী। নব্য হিন্দু আন্দোলনের নায়করা হলেন: রামকৃষ্ণ পরমহংস, শশধর তর্কচূড়ামণি, কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন, চন্দ্রনাথ বসু, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ। স্বদেশে পরবাসী হবার বেদনা ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতিক্রিয়ায় হিন্দুধর্মের যে পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছিল, শতাব্দীর শেষে তা হিন্দু জাতীয়তাবাদে পরিণত হল। বিপ্লবাদীরা এক হাতে ‘গীতা’ ও অন্য হাতে বন্দুক নিয়ে ব্রিটিশ বিরোধিতায় পথে নামলেন। স্বাভাবিকভাবে মুসলমানরা এর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইলেন। হিন্দুত্বের এই আস্ফালনকে অন্যভাবে উস্কে দিলেন কর্নেল ইউ এন মুখোপাধ্যায়। ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হল তাঁর বই ‘Hindus: a dying race’ . এই বইতে তিনি বললেন হিন্দুদের মহা বিপদের কথা। কারণ মুসলমানরা সংখ্যায় দ্রুত বাড়ছে । কর্নেল মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : “ There are various ways people have dwindled and finally disappeared from their own country and we are in a fair way of sharing their fate .,,,,,,, We are also a decaying race . Every census reveals the same fact. We are getting proportionally fewer and fewer …… Year after they [the Hindus] are being pushed back, the land once occupied by them is being taken up by Mohammedans and their relative proportion to the population of the country is getting smaller and smaller .” ভারতবর্ষে হিন্দু জনসংখ্যার হ্রাসের যে ভয়াবহ ছবি কর্নেল মুখোপাধ্যায় এঁকেছেন, তা স্বকপোলকল্পিত। হিসেব নিলে দেখা যাবে গত ১০০ বছর হিন্দু জনসংখ্যা ২০ কোটি থেকে ১০০ কোটিতে পৌঁচেছে।
এবার দামোদর বীর সাভারকরের বইএর আলোচনা। সাভারকরের ‘এসেন্সিয়াল অব হিন্দুত্বে’র আলোচ্য বিষয়গুলি এই রকম:
1] Essentials of Hindutva 2] What is in a name 3] Hindutva is different from Hinduism 4] What is a Hindu 5] Name older still 6] Hindus, a nation 7] Other names 8] How Names are given 9] Fall of Buddhism 10] Buddhism --- a universal religion 11] Then came reaction 12] Institutions in favour of Nationality 13] Commingling of Races 14] Back to the Vedas 15] Sindhusthan 16] What is Arya 17] Hindu and Hindusthan 18] Reverence to Buddha 19] Hindus: all one in a nation 20] Hindusthani Language 21 ] Foreign Language 22] Hindutva at work 23] Stupid notions must go 24] Essential implications of Hindutva 25] Bond of common blood 26] common culture 27] what is civilization? 28] Common laws and rites 29] Who is a Hindu 30] Hindus in Sindh 31] Unique Natural Blessings to Hindusthan .
কিন্তু হিন্দত্বের প্রথম দিকের প্রচারক হলেও সাভারকর গো-পূজনের বিরোধিতা করেছেন। যে গো-পূজন বর্তমানের বিজেপি-র অন্যতম কর্মসূচি, যে গো-পূজনের জন্য তাদের দ্বারা মুসলমানরা প্রায়শ আক্রান্ত হয়, সাভারকর তার বিরোধী ছিলেন। তাঁর ‘গোপালান হেভে গোপুজান নাভেহে’ নিবন্ধটি প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন মানুষ তাকেই পূজা করে যে তার চেয়ে উন্নততর। গরুর প্রতি মানুষের কৃতজ্ঞতা আছে কিন্তু তাই বলে গরুকে ঈশ্বর হিসেবে বিবেচনা ভুল ও বোকামি। গোমূত্র ও গোবর খাওয়ারও বিরোধিতা করেছেন সাভারকর। তিনি যে গো-ভক্ষণের বিরোধী ছিলেন না, তাঁর বহু উক্তি থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। তাছাড়া হিন্দুধর্মের অন্তর্লীন অস্পৃশ্যতা ও বর্ণভেদেরও বিরোধী ছিলেন তিনি।পার্থপ্রতিম মৈত্র তাঁর ‘হিন্দুত্বের ক্রোনোলজি ও স্বাতন্ত্র্যবীর সাভারকর ‘ নিবন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন: “ আজ এতদিন পরে একজন আদ্যোপান্ত নাস্তিক, পরধর্মবিরোধী এবং একই সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী মানুষের ইতিহাসের পাতা থেকে পুনরুথ্থান ঘটছে কেন? কেন নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহ বা নাগপুর ব্র্যাণ্ড হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা সাভারকরকে স্বীকৃতি দিতে মরিয়া?
শ্রীমৈত্র তার কারণগুলি উল্লেখ করেছেন এইভাবে:
১] হিন্দুত্ববাদের তাত্ত্বিক পটভূমি রচনার কৃতিত্ব বিনায়ক দামোদর সাভারকরের উপরেই বর্তায়। তাঁর ‘হিন্দুত্ব’ নামের বইটি সেই পটভূমি।
২] তিনি ছিলেন মুসলমান ও খ্রিস্টান বিরোধী। ভারতীয়ত্ব ও হিন্দুত্ব সমার্থক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করায় সাভারকরের অবদানই তাঁকে ইতিহাসের অন্ধকার থেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা দিয়েছে।
৩] গান্ধীর অহিংসা নীতি ও নেহেরুর সমাজতান্ত্রিক উদারমনস্কতার বিরোধিতা সাভারকর সারাজীবন করেছেন, জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতা করেছেন ভারতভাগের জন্য। একবিংশ শতকের ভারতে এই ঐতিহাসিক ভিত্তিভূমি রাজনৈতিকভাবে অতীব প্রয়োজনীয়।
৪] হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ববাদ যে এক নয়, মুসলমান ও খ্রিস্টানদের বাদ দিয়ে বৃহত্তর হিন্দু সমাজ গড়ে তোলা যে আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতাদখলের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় তা সাভারকরের তত্ত্বে নিহিত আছে।
৫] সাভারকর হিন্দু পরিচয়, হিন্দু সংস্কৃতি এবং হিন্দু ঐক্যের উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি মৌর্য, গুপ্ত, চোল, মারাঠা প্রভৃতি হিন্দু নেতাদের প্রতিমূর্তি পুনর্নিমাণ করেছিলেন। সাভারকরের মতে এঁরা এবং এঁদের মতো আরও অনেক রাজনৈতিক পথপ্রদর্শক যেমন পুরু, পৃথ্বীরাজ চৌহান, রানা প্রতাপ, শিবাজি, মহারানি লক্ষ্মীবাই প্রমুখ, যাঁরা বিদেশি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের কাহিনিই জনগণকে অনুপ্রাণিত করবে। সাভারকরের মতে বৈদিক যুগ থেকে পৃথ্বীরাজ চৌহানের শাসনের শেষ অবধি হিন্দু রাজাদের শাসন ছিল ভারতের হিন্দুদের স্বর্ণযুগ। ১৫৫৭ সালে দিল্লির সুলতানি আমলের সময় থেকে ব্রিটিশদের আগমন পর্যন্ত ইসলামিক বিজয়ীদের যুগ, যা ছিল হিন্দুদের অন্ধকার যুগ। হিন্দুদের জন্য ব্রিটিশরা অনেক কিছু করতে পারত, কিন্তু তারা তা করেনি। হিন্দুদের উপর অত্যাচারে মুসলমানদের মতো ব্রিটিশরাও নির্মম ছিল।
৬] আন্দামান সেলুলার জেলে বারবার ব্রিটিশের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা ও শেষে মুক্তি ---- এই ঘটনার যুক্তি হিসেবে বলা হয় যে ছত্রপতি শিবাজির পটভূমিকাতেই ঘটনাটিকে দেখতে হবে। শিবাজি ১৬৬৬ সালে আগ্রায় কৌশলে আওরঙ্গজেবের বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে যান ; ঠিক তেমনি ১৯১০ সালে সাভারকর ব্রিটিশ জাহাজ এস এস মোরিয়া থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিলেন ; কিন্তু তিনি ফরাসি বন্দর মার্সাইএর কাছে ধরা পড়েন। তাঁকে যখন ভারতে আনা হয়েছিল তখনও তিনি ব্রিটিশ হেফাজৎ থেকে পালানোর চেষ্টা করেন। শিবাজি তাঁর বন্দিদশাকালে আওরঙ্গজেবের কাছে চারটি ক্ষমা চেয়েছিলেন। চারটি ক্ষমার ভিত্তিতে মোগল ও শিবাজির মধ্যে একটি চুক্তি হয়। এটা ছিল কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশল। সাভারকরও সেই কৌশল অবলম্বন করেছিলেন।
৭] সাভারকর ছিলেন বিভাজনের রাজনীতির জন্মদাতা। হেডগেওয়ার, গোলওয়াকার, মোহন ভাগবত থেকে শুরু করে বাজপেয়ী, আদবানি . মোদি এবং অমিত শা্হ সকলেই বিভাজনের রাজনীতির প্রচারক।
৮] উত্তেজক জাতীয়তাবাদের সমর্থক ছিলেন সাভারকর। রাজনৈতিক স্বার্থে বিজেপি বীর সাভারকরের কথা বলেন বটে, কিন্তু সাভারকর তাঁদের ‘গুরুজি’ নন। তাঁদের গুরুজি হলেন মাধব সদাশিবরা্ও গোল্পয়ালকর।গোলওয়ালকর মহারাষ্ট্রের নাগপুরের নিকটস্থ রামটেকে এক মারাঠি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন । বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে তিনি মিশনরি সম্প্রদায় পরিচালিত হিসলপ কলেজে ভর্তি হন। সেখানে হিন্দুধর্মের অবমাননার জন্য বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। এখান থেকে তিনি বিজ্ঞানে স্নাতক হন, পরে জীববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। মেরিন বায়োলজিতে ডক্টরেট করার জন্য মাদ্রাজ গিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু পিতার মৃত্যুর কারণে তা শেষ করতে পারে নি। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকাল প্রাণীবিদ্যা পড়িয়েছিলেন গোলওয়ালকর। তাঁর দাড়ি আর লম্বা চুলের জন্য ছাত্ররা তাঁকে ‘গুরুজি’ বলে ডাকত। এখানে থাকার সময়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ভাইয়াজি দানির। ভাইয়াজি আর এস এসের সরসঙ্ঘচালক হেডগেওয়ারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। তারপরে হেডগেওয়ারের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় হয়। গোলওয়ালকর যোগ দেন আর এস এসে। নাগপুর শাখার সচিব হন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct