যোগেন্দ্র যাদব : প্রধানমন্ত্রী বললেন ‘হ্যাটট্রিক’। বাকি সকলেও ‘হ্যাটট্রিক’ বলছে। সকাল থেকেই দেশ জুড়ে বার্তা ছড়িয়ে পড়ে যে তিন রাজ্যে জয়ের পর এখন বিজেপিকে তৃতীয়বার লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। বিজেপি সমর্থকরা ইতিমধ্যেই জয়ের উচ্ছ্বাসে মত্ত। অন্যদিকে বিরোধীরা হতাশ। কিন্তু কারও জিজ্ঞাসা করার সময় নেই: এই সারমর্ম কি আদপে সত্যি? এভাবেই বিজেপি মনস্তাত্ত্বিক খেলা খেলে এবং জিতে যায়। সত্যের একটি ছোট বেলুন এত বড় করে ফুলিয়ে তোলা হয় যে বিপরীত সত্যিটা লুকিয়ে পড়ে। লড়াই শুরুর আগেই প্রতিপক্ষের মনোবল ভেঙে পড়লে ম্যাচ ওয়াক ওভার পেতে পারে। অতএব, আমাদের এই দাবিটি ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ।
ধাপ ১: নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট দিয়ে শুরু করুন। চারটি রাজ্যে সব দলের প্রাপ্ত মোট ভোট যোগ করুন। বিজেপি, যারা বিজয়ের শিঙা ফুঁকছে, মোট ভোট পেয়েছে ৪,৮১,৩৩,৪৬৩। যেখানে নির্বাচনে “পরাজিত” কংগ্রেস পেয়েছে ৪,৯০,৭৭৯০৭ ভোট। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বিজেপির থেকে প্রায় সাড়ে নয় লাখ বেশি ভোট পেয়েছে কংগ্রেস। তারপরও চারদিকে আলোচনা যেন কংগ্রেসকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে বিজেপি।আমরা যদি তিনটি রাজ্যের আসন সংখ্যার দিকে তাকাই, বিজেপিকে বিজেপি বলে মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে ভোটের খুব বেশি পার্থক্য নেই। রাজস্থানে, বিজেপি পেয়েছে ৪১.৭% ভোট আর কংগ্রেস পেয়েছে ৩৯.৬% ভোট, অর্থাৎ পার্থক্য মাত্র ২%। অন্যদিকে, ছত্তিশগড়ে পার্থক্য ৪%: বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ৪৬.৩% ভোট এবং কংগ্রেসের ৪২.২% ভোট৷ শুধুমাত্র মধ্যপ্রদেশে পার্থক্য ৮% এর বেশি: বিজেপি ৪৮.৬% ভোট এবং কংগ্রেস ৪০% ভোট পেয়েছে। তিনটি রাজ্যেই হেরে গেলেও, কংগ্রেসের ৪০% বা তার বেশি ভোট রয়েছে, যেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করা খুব কঠিন হবে না। তিনটি হিন্দিভাষী রাজ্যে বিজেপি যে পরিমাণ ভোট বেশি পেয়েছে তা শুধুমাত্র একটি রাজ্য তেলেঙ্গানা থেকেই পুষিয়ে যায়। তেলেঙ্গানায়, কংগ্রেস ৩৯.৪ % (৯২ লক্ষের বেশি) ভোট পেয়েছে, যেখানে বিজেপি ১৩.৯% (৩২ লক্ষের কম) ভোট পেয়েছে। এই রাজ্যে কংগ্রেস ২০১৮ সালের পরে নির্বাচনী দৌড় থেকে বাদ পড়েই ছিল, সেখানে এমন ফল করে শীর্ষে পৌঁছানো আসলে রাজনৈতিক উত্থান এবং প্রাণশক্তির লক্ষণ।
ধাপ ২: হ্যাটট্রিক মিথ পরীক্ষা করার জন্য ইতিহাস পর্যালোচনা করুন। গত দু দশক ধরেই মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ের নির্বাচনের কয়েক মাসের মধ্যেই লোকসভার নির্বাচন হয়ে আসছে। শেষবার ২০১৮ সালে, এই তিনটি রাজ্যেই বিজেপি হেরেছিল। তখন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা মিডিয়া কেউই দাবি করেনি যে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত। যখন সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন বিজেপি এই তিনটি রাজ্যে এবং বাকি হিন্দি অঞ্চলে তুমুল বিজয় লাভ করে। অন্যদিকে, ২০০৩ সালে কংগ্রেস যখন এই তিনটি রাজ্যে হেরেছিল, তার মাত্র কয়েক মাস পরে, ২০০৪ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস অপ্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করেছিল। এর মানে হল বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনের প্রকৃতি ভিন্ন এবং বিধানসভা থেকে সরাসরি লোকসভা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া ভুল হবে। বিজেপি যদি ফলাফল উল্টে দিতে পারে তবে কংগ্রেস কেন পারবে না?
তৃতীয় ধাপ: ২০২৪ সালে ক্ষমতা পরিবর্তনের সমীকরণটি দেখুন। বিজেপি হিন্দি বলয়ের এই তিনটি রাজ্যের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু বিরোধীদের আশা শুধুমাত্র এই অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল নয়। ইন্ডিয়া জোটের নির্বাচনী অঙ্ক কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, বিহার এবং বাংলায় বিজেপির আসন কমানোর উপর নির্ভর করে আছে। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং রাজস্থানের ৬৫ আসনের মধ্যে বিজেপির ইতিমধ্যেই রয়েছে ৬১ এবং কংগ্রেসের মাত্র ৩টি। এর মানে বিজেপির চ্যালেঞ্জ হল এই সমস্ত আসন ধরে রাখা এবং সম্ভব হলে তেলেঙ্গানায় জেতা চারটি আসনের থেকে আসন সংখ্যা বাড়ানো। অন্যদিকে, এই রাজ্যগুলিতে কংগ্রেসের হারানোর কিছু নেই। অর্থাৎ এই বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি নতুন কিছু করতে পারেনি।
চতুর্থ ধাপ: বিধানসভার এই ফলাফলকে লোকসভার নিরিখে দেখুন। আসলে, লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের বিধানসভার এই ফলাফল উল্টে দেওয়ারও দরকার নেই। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, তেলেঙ্গানা এবং মিজোরামে মোট ৮৩টি লোকসভা আসন রয়েছে। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে, বিজেপি ৬৫টি আসন পেয়েছিল, মাত্র ৬টি কংগ্রেসের কাছে গিয়েছিল, বাকিগুলি BRS, MNF এবং MIM-এর কাছে গিয়েছিল। যদি ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে, বিজেপি এবং কংগ্রেস ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রে ঠিক একই সংখ্যক ভোট পায়, তাহলে পরিসংখ্যান এইরকম হবে- রাজস্থান: বিজেপি ১৪, কংগ্রেস ১১, ছত্তিশগড়: বিজেপি ৮, কংগ্রেস ৩, মধ্যপ্রদেশ: বিজেপি ২৫, কংগ্রেস ৪ এবং তেলেঙ্গানা: কংগ্রেস ৯, বিজেপি ০ (BRS ৭ এবং MIM ১), মিজোরাম: জেএমপি ১ আসন। সামগ্রিকভাবে, এই বিধানসভার প্রাপ্ত ভোট অনুসারে, লোকসভার ৮৩টি আসনের মধ্যে, বিজেপি ৪৬টি আসন এবং কংগ্রেস ২৮টি আসন পায়। অর্থ, এই বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল অনুসারে, লাভের বদলে বিজেপি ১৯টি আসন হারাতে পারে এবং কংগ্রেস ২২টি আসন বেশি পেতে পারে। কেবলমাত্র কংগ্রেসকে নিশ্চিত করতে হবে তাদের বিধানসভায় প্রাপ্ত ভোট যেন লোকসভাতেও ধরে রাখা যায়। এখন কেউ বলবেন এটাতো হল সহজ গণিত। “মোদী ম্যাজিক” এর কথা ধরে তো হিসাব করা হয় নি। মোদী ম্যাজিক কাজ করলে এই সমস্ত রাজ্যে কংগ্রেস নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু যদি “মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়” এর কথাই হয়, তাহলে বিধানসভা নির্বাচনী ফলাফল ধরে হ্যাটট্রিকের যুক্তি দেওয়ার কী দরকার? ঐ ম্যাজিকে বিশ্বাসী হলে শুধু তার কথাই বলুন, বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে আড়াল খোঁজার কি দরকার?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct