বিশ্বাস করা কঠিন, যে যুদ্ধ কয়েক দিন বা মাসের ব্যবধানে বন্ধ হয়ে যেতে পারত, তা এখনো চলছে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। খুব সহজেই ইউক্রেনকে কবজা করা যাবে—রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এমন ধারণা থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু। এরপর লম্বা সময় গড়িয়েছে, কিন্তু যুদ্ধ বন্ধের কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। লিখেছেন ব্র্যাংকো মার্সেটিক।
বিশ্বাস করা কঠিন, যে যুদ্ধ কয়েক দিন বা মাসের ব্যবধানে বন্ধ হয়ে যেতে পারত, তা এখনো চলছে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। খুব সহজেই ইউক্রেনকে কবজা করা যাবে—রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এমন ধারণা থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু। এরপর লম্বা সময় গড়িয়েছে, কিন্তু যুদ্ধ বন্ধের কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। দুই বছরের গণ্ডি স্পর্শ করতে চলা এই যুদ্ধ যেন কোনোভাবেই থামার নয়! এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কী কারণে, কোন পক্ষের দোষে ইউক্রেন যুদ্ধের ইতি ঘটানো যাচ্ছে না?মনে থাকার কথা, স্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য গত বছর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল তুরস্ক। আংকারার দূতিয়ালিতে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে শান্তি সংলাপের আয়োজন করা হয়, কিন্তু কিছু দূর এগোনোর পর ভেস্তে যায় আলোচনা। মজার ব্যাপার হলো, এ নিয়ে ‘নতুন কথাবার্তা’ শোনা যাচ্ছে। সেই উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার জন্য যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে দায়ী করে ইউক্রেনের এমপি ডেভিড আরখামিয়ার দেওয়া এক সাক্ষাত্কার সম্প্রতি নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ২০২২ সালের মে মাসে ঐ সাক্ষাত্কার সামনে আসে। আরখামিয়ার কথার সূত্র ধরে অনেকে বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিশ্বের কিছু সরকার সম্ভবত চায়নি এই যুদ্ধ বন্ধ হোক। ফলপ্রসূ শান্তি আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটুক। এটা বিশ্বাস করা কঠিন বটে, কিন্তু পুরোপুরি অস্বীকার করার মতোও নয়। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পেছনে পশ্চািমাদের ভূমিকাকে কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা আসলেই কঠিন। তবে আরখামিয়ার কথার পরিপ্রেক্ষিতে পেছনের ঘটনার সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতা মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। ডেভিড আরাখামিয়া হচ্ছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’ পার্টির সংসদীয় নেতা। মস্কোর সঙ্গে শান্তি আলোচনায় ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। সাংবাদিক নাটালিয়া মোসিচুককে দেওয়া এক টেলিভিশন সাক্ষাত্কারে আরাখামিয়া বলেন, ‘রাশিয়ার চাওয়া ছিল, আমরা (ইউক্রেন) নিরপেক্ষতার পথ অবলম্বন করে চলি। এর অর্থ, আমরা যেন ন্যাটোতে যোগদান না করি—এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিই। সত্যি বলতে, কিয়েভ নিরপেক্ষ অবস্থানের পথে হাঁটলেই যুদ্ধ শেষ করতে রাজি ছিল মস্কো।’কিয়েভ ন্যাটোয় যোগদানের আশা না ছাড়ার কারণে আলোচনা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়। প্রশ্ন হলো, মস্কোর প্রস্তাবে সে সময় কিয়েভ রাজি হয়নি কেন? আরাখামিয়ার বক্তব্য, এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ ছিল। ন্যাটোভুক্ত হওয়ার জন্য ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের সংবিধানে যে সংশোধন আনা হয়, তা পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়ে এক্ষেত্রে। ইউক্রেন হয়তোবা তাতে রাজিও ছিল, কিন্তু এ বিষয়ে কথা বলতে সে সময় কিয়েভে উড়ে যান যুক্তরাজ্যের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে জনসনের বার্তা ছিল, ‘পশ্চিমারা মস্কোর সঙ্গে কোনো ধরনের চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না।’ জনসন ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেন, ‘আসুন, লড়াই করি। একমাত্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই এই যুদ্ধের অবসান ঘটবে।’সাক্ষাত্কারে আরাখামিয়ার শেষ কথাগুলো ছিল, দর-কষাকষির পর শেষ পর্যন্ত হয়তো সমাধানের রাস্তা একটা বের হতোই। তবে এক্ষেত্রে কিয়েভ পড়ে যায় উভয় সংকটে। একদিকে রাশিয়ার প্রতি কিয়েভের আস্থার অভাব, অন্যদিকে ন্যাটো রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে এ বিষয়ে সমর্থন না পাওয়া। এ দুইয়ের ফলে শান্তিচুক্তি মুখ থুবড়ে পড়ে।আরাখামিয়ার ঐ সাক্ষাত্কার বিস্তৃতভাবে প্রকাশ পায় পশ্চিমাপন্থি ইউক্রেনস্কা প্রাভদা আউটলেটের এক রিপোর্টে। রিপোর্টে উঠে আসে, জনসন জেলেনস্কিকে বলেছিলেন, ইউক্রেন যদি রাশিয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়, তাহলে তা কোনোভাবেই মেনে নেবে না পশ্চিমারা। মস্কোর সঙ্গে কোনো ধরনের শান্তিচুক্তিকে সমর্থন করবে না। রিপোর্টে এ-ও বলা হয়, পুতিনের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনড় ছিল পশ্চিমারা।আরাখামিয়ার সাক্ষাত্কার বা ইউক্রেনস্কা প্রাভদার রিপোর্টকে মিথ্যা প্রমাণ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, জনসন নিজেই এর প্রমাণ। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে ফোনে আলাপকালে ‘জেলেনস্কিকে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর না করার জন্য বলেছি’—এমন কথা হয়েছে জনসনের। কথা বলার সময় তিনি বেশ কয়েক বার এই উদাহরণ টেনেছেন।
বিগত সময় জুড়ে বেশ কিছু লেখায় শান্তিচুক্তির বিষয়ে পশ্চিমাদের মনোভাবের বিষয়ে ধারণা পাওয়া গেছে। সবগুলোতেই দাবি করা হয়েছে, ইউক্রেন ও রাশিয়া শান্তির দ্বারপ্রান্তে ছিল, কিন্তু ন্যাটো রাষ্ট্রগুলোর কারণে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের শিকারে পরিণত হতে হচ্ছে ইউক্রেনকে। পশ্চিমাদের অনুমান ছিল, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তা রাশিয়াকে দুর্বল করে তুলবে। অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে রুশ অর্থনীতি। বিভ্রান্ত হয়ে পড়বেন পুতিন। যদিও তা কতটা হয়েছে, প্রশ্নসাপেক্ষ।আরাখামিয়ার দাবি যে সঠিক, তার আরেক প্রমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা ফিওনা হিলের বক্তব্য। হিলের ভাষ্য, ‘জনসন এমন এক সময়ে কিয়েভ সফর করেন, যখন উভয় পক্ষ অস্থায়ী শান্তিচুক্তিতে পৌঁছানোর পর্যায়ে ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।’এ বিষয়ে ইতিহাসবিদ নিল ফার্গুসনের কথাও বলতে হয়। তার ভাষ্যমতে, ২০২২ সালের মার্চ মাসের দিকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যুদ্ধ বন্ধ করতে পারত। তবে দুই দেশের চাওয়া ছিল অন্য কিছু। বরং এক্ষেত্রে প্রত্যাশা ছিল পুতিন শাসনের অবসান ঘটানো। মস্কোর সঙ্গে আলোচনা অসম্ভব এবং কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় অর্জনের মাধ্যমেই এই সংঘাত শেষ করা যেতে পারে—এই কথায় অনড় ছিল পশ্চিমারা। রাশিয়ার হাতে দখল হওয়া ইউক্রেনের অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধারে এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই—এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছিল। তবে এই ধারণা যে সঠিক ছিল না, তা আজ পরিষ্কার। সত্যি বলতে, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে যেসব উদ্যোগ গ্রহণের কথা চিন্তা করা হয়েছে, তা পাত্তা পায়নি পশ্চিমাদের কাছে। কূটনৈতিক রেজল্যুশন উপেক্ষিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন, ন্যাটোতে ইউক্রেনের যুক্ত হওয়ার ইচ্ছাই এই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু বিধায় কিয়েভের এ বিষয় মাথা থেকে ঝেঁড়ে ফেলার মধ্য দিয়েই যুদ্ধের অবসান ঘটতে পারে। এরকম বহু যুক্তি এসেছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। তবে কোনোটাই পশ্চিমাদের নাগাল পায়নি।আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর প্রায় দুই বছর হতে চলেছে। সংঘাত বন্ধের কোনো রাস্তাই পাওয়া যাচ্ছে না। যুদ্ধের অভিঘাতে কেবল ক্ষয়ক্ষতিই বাড়ছে। চলমান যুদ্ধে ৩ লাখেরও বেশি সেনা কর্মকর্তা ও সদস্য হারিয়েছে ইউক্রেন। বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতিও কম নয়। রাশিয়াও চুকিয়েছে বড় মূল্য। এই যুদ্ধে বহু সেনা হারিয়েছে মস্কো। মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তা ইউক্রেনের জন্য গভীর অর্থনৈতিক সংকট ডেকে আনবে। জনসংখ্যাগত কিংবা আঞ্চলিক ক্ষয়ক্ষতিও বাড়তেই থাকবে।অর্থাত্, শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ হতে বাধা দেওয়া শুধু ইউক্রেনবাসীকে নয়, পুরো বিশ্বকেই বিপদে ফেলেছে। যুদ্ধ শুরুর পর পারমাণবিক শঙ্কা তৈরি হয়েছিল মাঝে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন জনসাধারণকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আশ্বস্ত করেন, ‘ভয়ের কিছু নেই।’ তবে ভয় নামানো যায়নি মাথা থেকে। গত সেপ্টেম্বরে বাইডেন আবারও সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘বিশ্ব সম্ভবত বিগত ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় পারমাণবিক শঙ্কার সম্মুখীন।’রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর আরো কয়েক বার এ বিষয়ে প্রচেষ্টা চালানো হয়। তবে দুঃখজনকভাবে প্রায় সব আয়োজন ভেস্তে গেছে। এখন কেবল অনিশ্চয়তা। বর্তমান বাস্তবতায় রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে যুদ্ধ লেগে গেলে তা অবাক করবে না আমাদের। এমনকি পারমাণবিক সংঘর্ষের ঘটনাও স্বাভাবিক মনে হবে। এই অর্থে বলতে হয়, কার্যকর কূটনৈতিক সমাধানের গুরুত্ব উপলব্ধি না করার কারণেই ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘতর হচ্ছে। কিয়েভের বিপর্যয়ের আসল কারণ এটাই। আর পশ্চিমাদের জন্য ইউক্রেন যুদ্ধ এক বিশেষ শিক্ষা। ভবিষ্যতের কোনো দ্বন্দ্ব সামলাতে এই শিক্ষা বেশ কাজে দেবে।
লেখক: ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ান, ইন দিস টাইমস ও জ্যাকবিনের নিয়মিত কলামিস্ট। ‘ইয়েস্টারডেস ম্যান: দ্য কেস অ্যাগেইনস্ট জো বাইডেন’ বইয়ের লেখক
রেসপনসিবল স্টেট ক্রাফট থেকে অনুবাদ:
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct