সেখ আব্দুল মান্নান : দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল তিনটে দশক, একটা বছর, আমার নিথর দেহে সংঘটিত হওয়া অমানবিক নির্যাতনের। নির্মমতার ছবি নিয়ে লেখা হয়েছিল কত পত্রপত্রিকায়। উন্মত্ততার ছবিতে ছবিতে মুখর হয়েছিল বোকা বাক্সর পর্দা। ধিক্কারে ধিক্কারে গর্জে উঠেছিল আসমূদ্র হিমাচল। তবু সেই নির্যাতনের কারিগররা অবিচল তাদের কৃত দুষ্কর্মের গৌরবগাথায়। ধাতব অস্ত্রের আঘাতে আঘাতে নির্দয়ভাবে আমার সর্বাঙ্গ ক্ষত বিক্ষত করার বিন্দু অনুশোচনা নেই আজও । আমার অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করতে আমার বুকে চালানো হয়েছিল বুলডোজার । ওরা কেন যে আমার ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে মিটিয়ে দিয়ে নতুন স্থাপত্য নির্মাণে ব্রতী হলো! বুঝল না ইতিহাস আর বর্তমানের ফারাক। বুঝল না আমার বুকে নতুন স্থাপত্য রচেও কয়েকশ বছরের ইতিহাসকে মোছা যাবে না। কৃত্রিম কায়দায় ভাঙা কাঁচ জোড়া লাগার পরে দগদগে দাগ থেকে যাওয়ার মতোই আমার ওপর গগনচুমি স্থাপত্য তৈরি করার পরেও ইতিহাসের পাতায় আমি আছি, আমি থাকব, অমর অক্ষয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানবে উন্নাসিক উন্মাদনায় আমার ওপর নির্মিত হয়েছে এক সৌর্য। নতুন স্থাপত্যের অভিপ্সায় আমার কলিজা ছিঁড়ে অনর্থক অনুসন্ধানে মত্ত হলো ওরা। কয়েকশ ফুট গভীরে সেঁদিয়ে আতাপাতি খুঁজল ইপ্সিত নিদর্শন। দুর্ভাগ্য, নির্বোধ প্রযুক্তির সাহায্যে ওরা যত নিচে নামতে লাগল আমি ততই সেঁদিয়ে যেতে লাগলাম গভীরে। যেখান থেকে আমাকে তুলতে পারবে না কোনদিন। আমাকে নিশ্চিহ্ন করে কেন যে ওরা নতুন স্থাপত্যের ভিত গেড়েছে আমার ভিতে! আমার ইট কাঠ পাথরের সত্ত্বাও বোঝে দুর্মুখদের দুর্বুদ্ধিতা। আগে যেমন আযানের ধ্বনিতে জাগত শিহরণ আমার শিরা উপশিরায়, আজও পুলকিত হই বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ আর ঘন্টাধ্বনিতে। ওরা কেন সহদরার মত আমার পাশে নির্মাণ করল না আর এক স্থাপত্য? দুজনেই তো একই স্রষ্টার উপাসক। একজন রহিম, অন্যজন রাম । যে যার ভাষায় উপাসনা করবে স্রষ্টার! পৃথিবীতে স্থান, কাল, পাত্র ভেদে স্রষ্টার সৃষ্টি নানা ভাষা নানা মত, নানা পরিধান। কিন্তু মানুষের কাঠামো এক। চোখ,কান, হাত,পা, মাথা মুখ...। তবু কেন, কেন এ বিভেদ, বৈষম্য? বৈচিত্রের মধ্যে সবারই লক্ষ যদি এক ? ওদের ধারণায় যদি মূলে ফিরে যাওয়াই একমাত্র লক্ষ্য, তবে তো এই দুনিয়ার মানুষ অনেক আদিম জীবের বিবর্তনের ভিন্নরূপ ? হাজার চাইলেও কি মানুষকে আর সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব? সম্ভব নয়। তাহলে কেন এই বালখিল্য ইতিহাস পাল্টানোর ব্যর্থ প্রয়াস? জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত হয়েও মানুষ আজ অজ্ঞানের হীনমন্যতায় ডুবে রয়েছে? রাম রহিম পাশাপাশি থেকে ভিন্ন নামে, ভিন্ন উপায়ে সর্বময় একই স্রষ্টার উপাসনা করলে কি স্রষ্টা রুষ্ট হতেন ? ইট,কাঠ,পাথরের আধারে মানবতাকে বন্দি করে সরলপ্রাণা মানুষগুলোকে বোকা বানানোর উদ্যোগ দেখলে ওই অতি চালাকদের ওপর আমার বড় করুণা হয় । মাটির ওপরে খাঁচাটা বদলে কি ইতিহাস বিকৃত করা যায়? যায় না। আত্মশ্লাঘায় মগ্নরা জেনে রেখো, আমি ইতিহাস হয়ে যেমন ছিলাম, তেমন আছি, তেমন থাকবো আগামী অনন্ত কাল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct