সনাতন পাল : কথা সাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায় বলেছিলেন-” মিথ্যারও মহত্ত্ব আছে। হাজার হাজার মানুষ কে পাগল করিয়া দিতে পারে মিথ্যার মোহ। চিরকালের জন্য সত্য হইয়াও থাকিতে পারে মিথ্যা।” এই কথার সত্যতা যেমন হিটলার প্রমাণ করেছিলেন, তেমনি আজও প্রাসঙ্গিক। একথা সত্যিই যে,মিথ্যা কথা বলে মানুষকে স্বপ্নের রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়া যায়। এর প্রধান কারণ হলো আমরা বেশির ভাগ মানুষই মোহ গ্রস্ত। তাই আমাদের সহজেই মিথ্যে বলে মোহের মায়াজালে আবদ্ধ করে বিপথে পরিচালিত করা খুব একটা কঠিন কাজ নয় । কেউ যদি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বড় কোনো স্বপ্ন দেখান, তাহলে মানুষ তার পেছনেই ছুটতে থাকেন। তখন যদি কেউ বলেন যে - ও পথে যেও না, বৃথাই কষ্ট করছো কিছুই পাবে না, কিন্তু সে ঐ কথা শুনতে চাইবে না। ভাবে যদি কিছু ভালো হয়! কিছু মানুষের এরূপ মানসিক স্থিতির কারণেই বোধহয় বর্তমানে চাকরি দেবার নাম করে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুঁষ নিয়ে দালাল রা মানুষের সাথে প্রতারণা করতে সক্ষম হচ্ছেন।
বিগত দিনে যে সকল বড় বড় দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছে, সে সবের ভিত্তি ভূমিতেও এই একই থিয়োরি কাজ করেছে বলে মনে হয়। মিথ্যের মোহে সত্যিই মানুষ কে পাগল করে দেওয়া সম্ভব। শুধু মিথ্যে টা ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতে পারলেই অনেক ক্ষেত্রে এটা সম্ভব। এই রকম মিথ্যের মোহে পাগল করেই প্রেমের অভিনয় করে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কত যুবতি অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছেন পরে বিয়ে না করে প্রতারক প্রেমিকরা কেটে পড়ছেন! অনেকেই ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে ঘর ছাড়ছেন, অবশেষে ভিন রাজ্যে বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন। মানুষের স্বাভাবিক একটা প্রবণতা রয়েছে, সেটা হলো নিজের প্রশংসা এবং নিজের বা পরিজনের ভালো কথা বা স্বার্থ সিদ্ধির কথা সে শুনতে ভালোবাসে। কোনো মানুষের স্বপ্ন পূরণের প্রতিশ্রুতি বা আশার কথা শুনতে ভালোবাসে। সেটা যদি মিথ্যা হয় তবুও শুনতে আগ্রহী হবে। কিন্তু সত্যি টা যদি খারাপ হয় তাহলে সে সহজে তেমন সত্যির মুখোমুখি হতে চাইবে না। নিষ্ঠুর সত্যির চেয়ে সে মধুর মিথ্যে শুনতেই বেশি ভালোবাসেন। মানুষের এই দুর্বলতা কে কাজে লাগিয়ে সমাজে একশ্রেণীর মানুষ, তাঁরা নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করে চলেছেন। আজকাল জ্যোতিষীরাও অনেকে এই থিওরি কে কাজে লাগাচ্ছেন। মানুষ যখন একবার জ্যোতিষীর কাছে যান, সেই জ্যোতিষি মিথ্যে হলেও ভালো ভালো কথা যদি গুছিয়ে বলতে পারেন তাহলে ঐ ব্যক্তি ঐ জ্যোতিষিকে দক্ষিণা দিতে কোনো ইতঃস্তোত বোধ করেন না। পাশাপাশি ঐ ব্যক্তির কাছে রত্ন বিক্রি করতেও জ্যোতিষীকে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। আবার মানিক বন্দোপাধ্যায় এটাও বলেছেন যে- “ কেহ বিশ্বাস করে, কেহ করে না। যে বিশ্বাস করে সেও সত্য- মিথ্যা যাচাই করে না, যে অবিশ্বাস করে সেও করে না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নটা নির্ভর করে মানুষের খুশির উপর।” এই জন্যই বোধহয় বর্তমান সমাজে সত্যের আলাদা কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন । সত্য আর মিথ্যা মিলেমিশে এমন একটা কিছু তৈরী হয়, যেমন অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন মিলে জল তৈরী হয়। যার মধ্যে আলাদা করে অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেনের গুণাবলী থাকে না। হয়তো এমনি ভাবেই সমাজে সত্যি এবং মিথ্যার আলাদা কোনো গুণাবলীর সন্ধান পাওয়া কঠিন । মানুষের বিশ্বাস-অবিশ্বাস করা খানিকা আবেগের উপরেও নির্ভর করে। এর কারণ হলো রবীন্দ্রনাথের সেই কথা- “ যুক্তির একটা ব্যকরণ আছে, অভিধান আছে, কিন্তু আমাদের রুচির অর্থাৎ সৌন্দর্যজ্ঞানের আজ পর্যন্ত একটা ব্যকরণ তৈরী হইল না। তাহার কারণ , সে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে নির্ভয়ে বাস করিয়া থাকে- এবং সে দেশে “ কেন “-আদালতের ওয়ারেন্ট জারি হইতে পারে না। “ এক্ষেত্রে বলা যেতেই পারে যে যুক্তির ব্যকরণ থাকলেও যদি রুচির ব্যকরণ না থাকে তাহলে যুক্তির পক্ষে রুচিকে নির্ণয় করা খুবই কঠিন কাজ। আবার কবিগুরুর এই কথাও ঠিক -” আগুন কে যে ভয় পায়, সে আগুনকে ব্যবহার করতে পারে না”। অনুরূপ ভাবে যাঁরা সত্যি কে ভয় পায় তাঁরা কখনও সত্যি কথা বলতেই পারে না, ফলে মিথ্যা,সত্যের ঘাড়ের উপর এমন ভাবে জাঁকিয়ে বসে যে, সেখান থেকে সত্যকে টেনে বের করা ভীষণ কঠিন হয়ে পরে ।যে সমাজে অধিকাংশ মানুষই সত্য কে ভয়, সেই সমাজে সত্যের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ভীষণই কঠিন। এবার সকলেই বিচার করুন আমরা ঠিক কি রূপ পরিস্থিতির মধ্যে সমাজে জীবিত রয়েছি? যদি মনে হয় বর্তমান পরিস্থিতির বদল ঘটানো দরকার, তাহলে সবার প্রথম কাজ হলো নিজেকে বদলানোর মধ্য দিয়েই সেই পরিবর্তনের অভিমুখে গমন শুরু করা। আর এই যাত্রা পথে যদি কখনও কোনো বাধা আসে, তবে তাকে মারিয়েই সামনের দিকে এগোতে হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct