শেখ কামাল উদ্দীন, বারাসত, আপনজন: মসজিদে তখন শুক্রবারের জুম্মার নামাজের আজানের ধ্বনি। আজান দিচ্ছেন মসজিদের মুয়াজ্জেন সারাফাত আলি। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পাশাপাশি তিন-চারটি গ্রাম থেকে আসছেন মসজিদে শুক্রবারে জুম্মার নামাজ পড়তে। আর ঠিক মসজিদের বাইরের ফাঁকা জায়গাটায় সুন্দর করে সাজানো চেয়ারে বসে রয়েছেন কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর, অধ্যাপক অমলেন্দু দেবনাথ, তাপস মৈত্র প্রমুখরা। তাদের পানির বোতল, গোলাপ ফুল আর মিষ্টি দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছেন বোসবাড়ির বর্তমান কর্ণধার দীপক কুমার বসুর উত্তরসূরী পার্থসারথি বসু, পাপিয়া বসু, বেবি বসু প্রমুখরা। ঘটনাটি উত্তর ২৪ পরগনায় বারাসত মহকুমার পশ্চিম ইছাপুর গ্রামের। গ্রামের মসজিদে যেটি ‘বোসবাড়ির মসজিদ’ নামে পরিচিত, সেখানকার। ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ ও ‘ভারতীয় গণসংস্কৃতি সংঘ’ নামে দু’টি সংস্থার পক্ষ থেকে মসজিদ প্রাঙ্গণে একটি মত বিনিময় সভায় এই চিত্র দেখা গেল। ভারতব্যাপী ‘ঢাই আখর প্রেম’ নামাঙ্কিত সংস্কৃতি পদযাত্রার অঙ্গ হিসেবে ওই দুটি সংস্থার রাজ্য ও জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে অন্যান্য সদস্যরা ওই মসজিদে যান। নবপল্লীর ছোটবাজার মোড়ে গান্ধীমুক্তিতে মাল্যদান করে এই পদযাত্রার সূচনা করেন ‘প্রগতি লেখক সংঘ’-র রাজ্য সভাপতি কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর। ভারত এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী হিন্দু মুসলিমের একটি অংশ পরস্পরের সম্পত্তি বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এবং অধুনা বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। তারই সূত্র ধরে এখন থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে বারাসাতের পশ্চিম ইছাপুরে আসেন চট্টগ্ৰামের বসু পরিবার। এখানে বনজঙ্গলে ঘেরা জমিতে দেখতে পান একটি ‘মেম্বার’। তিনি বুঝতে পারেন এখানে নিশ্চয়ই একসময় নামাজ পড়া হোত। কিন্তু কালক্রমে সেখানে নামাজ পড়া বন্ধ হয়ে যায়। তারা যোগাযোগ করেন এখানকার পূর্বতন বাসিন্দাদের সঙ্গে এবং ঘটনাটি জানান। প্রত্যুত্তরে এখানকার তদানীন্তন জমির মুসলমান মালিকরা, যাঁরা বাংলাদেশে রয়েছেন জানান, যেহেতু তারা জমি বিনিময় করে এসেছেন, ফলে তাদের যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। বসু পরিবার সিদ্ধান্ত নেন, জঙ্গল পরিষ্কার করে যাতে আবার নিয়মিত নামাজ আদায় যাতে সেই চেষ্টা তারা করবেন। সেই থেকে বসু পরিবারের বর্তমান প্রজন্মও মসজিদ দেখভাল করছেন। ওই পরিবারের বর্তমান উত্তরাধিকারী পার্থসারথী বসু জানান, তিনি নিজে সারা রমজান মাস রোজা রাখেন এবং সাধারণ রোজাদারদের সঙ্গে ইফতারও করেন। অন্যান্য মুসলিম অনুষ্ঠানগুলিও মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়। কোনো মানুষের কাছ থেকে কোনো চাঁদা তারা নেন না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে ইমাম ও মোয়াজ্জিনরা ভাতা পেয়ে থাকেন। এলাকার মানুষও তাদের ব্যবহারে খুশি। ভবিষ্যতে নিজেদের অর্থে এই মসজিদের উন্নতি সাধনে তারা বদ্ধপরিকর। ইতোমধ্যেই নতুন প্রবেশদ্বার তৈরি হয়েছে। শীঘ্রই অন্যান্য কাজ করা হবে বলে জানান ওই পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের বধূ পাপিয়া বসু। একদিকে দেশে যখন ঘৃণাভাষণে একটি সম্প্রদায়কে নিশানা করা হচ্ছে তখন বারাসাতের বসু পরিবারের এই সদিচ্ছা সম্প্রীতির একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে এলাকায় পরিচিত হয়ে আসছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct