নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব
প্রিন্স বিশ্বাস
গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঋতুকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান হল নবান্ন। যা প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাস ‘জুড়ে পালিত হয়। তাই অগ্রহায়ণ মাস এলেই গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে বেজে ওঠে এই উৎসবের পদধ্বনি।“বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ” আর এই তেরো পার্বণের অন্যতম একটি পার্বণ নবান্ন উৎসব। গ্রামীন উৎসব বলে পরিচিত এই নবান্ন উৎসব। ‘নবান্ন’ শব্দটির অর্থ কিংবা উৎপত্তির দিকে আমার যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তারপরও এক কথায় বলতে পারি, ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। নবান্ন ঋতুকেন্দ্রিক একটি উৎসব। হেমন্তে নতুন ধান ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করা হয়। এই উৎসব পালিত হয় অগ্রহায়ণ মাসে। অগ্র অর্থ ‘প্রথম’। আর ‘হায়ণ’ অর্থ ‘মাস’। এ থেকে সহজেই ধারণা করা হয়, এক সময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। এই মাস বাঙালির ঐতিহ্যবাহী, অসাম্প্রদায়িক ও মাটির সঙ্গে চির বন্ধনযুক্ত। কিন্তু শিল্পায়ন ও নগরায়নের কশাঘাতে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার আনন্দময় সরল জীবন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তরুণ প্রজন্মের ওপর পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রবল প্রভাব। তবে নাগরিক জীবনে নবান্নের শুভক্ষণের শুভ ছায়া ছড়িয়ে দিতে অগ্রহায়ণের প্রথমদিনে আয়োজন করা হতো নবান্ন উৎসব। সত্যিই কথা বলতে কী- বর্তমানে শহুরে জীবনে যে নবান্ন উৎসব করা হয়, সেটা তো প্রতীকী।আজকের গ্রামবাংলার শিশুরাও নবান্নের উৎসবের ইতিকথা বাবা-মা কিংবা ঠাকুরদা-ঠাকুমার মুখে মুখে শোনে। বিশ্বায়নের এই যুগে গ্রামীন বাংলার ঐতিহ্যগুলো ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে। আসলেই, নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। অগ্রহায়ণের শুরুতেই এপার বাংলা ও ওপার বাংলাতে চলতো উৎসবের নানা আয়োজন। নতুন ধান কাটা আর সেই ধানের প্রথম অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হতো নবান্ন উৎসব। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। এ যেন সত্যি হৃদয়ের বন্ধনকে আরো গাঢ় করার উৎসব। এক সময় হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া প্রকৃতি ছেয়ে যেতো সোনালি ধানের ক্ষেত। পাকা ধানের সোনালি রঙ দেখে কৃষকের মন আনন্দে ভরে যায়। এই শোভা কারণ, কৃষকের ঘর ভরে উঠবে গোলাভরা ধানে। বাঙালির প্রধান কৃষিজ ফসল ধান, কাটার ক্ষণ। স্মরণাতীত কাল থেকে বাঙালির জীবনে পয়লা অগ্রহায়ণকে বলা হয়ে থাকে বার্ষিক সুদিন। এ দিনকে বলা হয় নবান্ন। নবান্ন উৎসবে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক রকমের খাবার; বাড়ির আঙিনা নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে। ছোটবেলায় দেখেছি- অগ্রহায়ণের নতুন ধান ঘরে আনার আগে বাড়ির মেয়েরা গোবর গুলিয়ে বাড়ির আঙিনা ও ধানের গোলা লেপে পরিপাটি করত। লোকজন নতুন ধানের আঁটি মাথায় করে এনে ফেলতো লেপে রাখা ওই উঠোনে। এরপর মাড়াই করে ধান রোদে শুকিয়ে মচমচে করা হতো। সেই ধানের চাল ঢেঁকিতে গুঁড়ো করে তৈরি করা হতো পিঠা-পায়েস। কৃষকরা সারাদিন কায়িক পরিশ্রম করে উঠোনের পাশে বসে যেতেন খেতে। আর আমরা পিঠাপুলি নিয়ে আনন্দে ছোটাছুটি করতাম। বাড়ি বাড়ি পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যেত। এক সময় ঢেঁকির সুরেলা শব্দ ফুটিয়ে তুলত নবান্ন উৎসব।
একসময় নবান্ন উৎসবের দিন বংলার বিভিন্ন স্থানে খাবার খাওয়ার প্রতিযোগিতা করা হতো। যে যত বেশি খেতে পারত তাকে উপহার দেয়া হতো। উপহার ছিল দুগ্ধবতী গাভী কিংবা ছাগল। বিভিন্ন স্থানে মেলা বসত। অবস্থা ভালো যেসব কৃষকের তারা নবান্ন উৎসবকে ঘিরে লাঠিখেলা, হাডুডু, ষাঁড়ের লড়াই, নৌকাবাইচ সহ বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন করত। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে নবান্নে বাড়ির জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়। মেয়ে আসত তার বাবার বাড়ি। নবান্ন আর পিঠেপুলির উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। কৃষকের ঘরে পূজার আয়োজনও চলত। এখন এসব অতীত। আর বর্তমান ডিজিটাল যুগে খেলার জায়গা বলতে এক চিলতে বারান্দা। নগরীতে শিশুর খেলা মাঠ এখন ট্যাব, মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের ছোট্ট মনিটর। দুরন্ত শৈশবটাই যেন হারিয়ে যাচ্ছে তাদের। নগরায়ন আর আধুনিকতার অজুহাতে বিলীন হয়েছে খেলার মাঠ। তেমনি গ্রামীণ জনপদে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ আছে; কিন্তু কৃষকের ঘরে নেই নবান্নের আমেজ। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। সিকি শতাব্দী আগেও নবান্নের ধান কাটার উৎসবে মুখরিত হতো গ্রামের প্রতিটি আঙিনা। গ্রামীণ জনজীবনে নবান্ন উৎসব এখন শুধুই স্মৃতি। আগে কৃষকের প্রধান খাদ্যশস্য ছিল আমন ধান। বর্তমানে আমনের জায়গা দখল করেছে আউশ-আমন-বোরো ধান। বিভিন্ন জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান বাজারে আসায় নতুন ধানের গন্ধ হারিয়ে যাচ্ছে এবং স্বল্প সময়ে ওইসব ধান উৎপন্ন হওয়ায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব হারিয়ে যেতে বসেছে। ধানের বীজ থেকে চাল উৎপাদন হওয়া পর্যন্ত সব কাজই এখন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে হচ্ছে। এখন ধান উৎপাদনে আগের সেই পরিশ্রমও যেমন নেই, তেমনি চালের মজাও নেই। যখন ছোট ছিলাম, তখন আমাদের বাবা-কাকারা গরু-লাঙল দিয়ে চাষ করত আবার গরু দিয়ে ধান মাড়াই করে অনেক কষ্টে নতুন ধান উৎপন্ন করতেন, তখন তারা এই আনন্দে পিঠাপুলির আয়োজন করত। এখন সেই কষ্টও নেই, সেই আনন্দও নেই। এক সময় অগ্রহায়ণজুড়ে কৃষক এবং তাদের পরিবারের সবাই নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে মুগ্ধ থাকত। উৎসব আর আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত কৃষকের ঘরে ঘরে। আজ বর্তমান যুগে রাইস মিলে চাল ভাঙ্গার কাজ চলছে। কোনো কোনো স্থানে ডিজেলের মেশিন ছাড়াও ভ্যান গাড়িতে ইঞ্জিন নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান ভানা ও মাড়াই করছে। নবান্ন উৎসবকে ঘিরে লাঠিখেলা, হাডুডু, ষাঁড়ের লড়াই, নৌকাবাইচসহ বিভিন্ন খেলাধুলার কথা ভুলতে বসেছে নতুন প্রজন্ম। কারণ বর্তমানে ভিনদেশী চাকচিক্য সংস্কৃতি সমাজে প্রবেশ করে আমাদের পুরনো নিজস্ব ঐতিহ্যকে পশ্চাতে ফেলে যেন জ্যামিতিক হারে এগিয়ে চলছে। ঠিক আমাদের পুরনো সংস্কৃতি গাণিতিক হারের মতো দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাই এই দুর্বলতাকে পাশ কাটিয়ে আমাদের সংস্কৃতিকে আমরাই লালন করতে হবে। তখন ইতিহাসের পাতায় পড়া ছাড়া বাস্তবে খুঁজে পাওয়া দুষ্প্রাপ্য হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct