কেন্দ্রের মসনদে দ্বিতীয়বারের মতো ‘সম্রাটের’ ভূমিকায় নরেন্দ্র মোদি। তার শাসনামলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি তলানিতে, বৃদ্ধি পেয়েছে বিদ্বেষের মাত্রা। যদিও নির্বাচনে ডাক দিয়েছিলেন ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। বাস্তবে তার যথার্থ প্রতিফলন না ঘটলেও প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে নিজের ইমেজ তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। তা নিয়ে আলোকপাত করেছেন ড. দিলীপ মজুমদার।
আধুনিক বিজ্ঞানের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর বিজেপির সহযোদ্ধারা। তথাপি দেশের মানুষকে তাঁরা বিজ্ঞানবিমুখ করার চেষ্টা করেন। এর পেছনে রাজনীতি আছে। মানুষের বিজ্ঞানবোধ প্রখর হলে , মানুষ যুক্তি-প্রবুদ্ধ হলে শাসককে প্রশ্ন করতে পারে। ধর্মীয় কুসংস্কারের আবরণে তাদের আচ্ছন্ন করে রাখতে পারলে শাসকের আর আশঙ্কা থাকে না। শশী থারুর মশায় ‘বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিজেপির যুদ্ধ’ নামে একটি চমৎকার নিবন্ধ লিখেছেন। এই যুদ্ধে অবশ্যই নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। থারুর মশায় প্রথমেই ভারতের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সত্যপাল সিং-এর কথা বলেছেন। এই সত্যপাল সিং চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদকে অবৈজ্ঞানিক আখ্যা দিয়ে বেশ গর্বের সঙ্গে বলেছেন , ‘ আমাদের পূর্বপুরুষ বা কোন কালের মানুষ কখনও বলে নি বা লেখে নি , তারা বানরকে মানুষ হতে দেখেছে। ‘ভারতের সংবিধানে বিজ্ঞানভিত্তিক মনন , মানবিকতা এবং অনুসন্ধান ও সংস্কারের উন্নয়ন ঘটানোকে প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য বলে মনে করেছে ; সেটাকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলেও নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি দল সেই নির্দেশকে সরাসরি অমান্য করে চলেছে। ডারউইনকে উড়িয়ে দিয়ে তারা পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভবকে বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে উল্লিখিত নানাবিধ তত্ত্বের কথা বলতে চেয়েছে।বিজেপির আর এক নেতা রাজস্থানের শিক্ষামন্ত্রী বাসুদেব দেবননী আর এক নতুন তত্ত্ব জাহির করেছেন। তাঁর মতে গরুই একমাত্র প্রাণী যে নিশ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেন যেমন গ্রহণ করে তেমনি অক্সিজেন বর্জনও করে। অথচ সত্যপাল সিং এবং বাসুদেব দেবননী শিক্ষিত মানুষ। রসায়ন বিজ্ঞানে সত্যপালের ডিগ্রি আছে , আর বাসুদেব একজন প্রশিক্ষিত প্রকৌশলী। তাঁরা কেন এমন অবৈজ্ঞানিক কথা বলেন ? এখানেই বিজেপির দ্বিচারিতার প্রশ্ন। আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস যে এঁরা যা বলছেন , মনে মনে তা বিশ্বাস করেন না। ভোট ব্যাঙ্কের স্বার্থে মানুষকে বোকা বানানোর জন্যই এসব অবৈজ্ঞানিক তথ্য পরিবেশন।রাজস্থান হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি মহেশচন্দ্র শর্মার বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি আছে। তিনি বলেছেন ভারতের জাতীয় পাখি ময়ূর চিরকুমার। চিরকুমার যে তার প্রমাণ হিসেবে তিনি শ্রীকৃষ্ণের পাথার সিকি পাখা হিসেবে ময়ূরের পাখনার কথা বলেছেন। শর্মা মশায়ের বক্তব্য , শারীরিকভাবে মিলিত না হয়েও শুধুমাত্র ক্রন্দনাশ্রু দিয়ে ময়ুরীকে গর্ভবতী করতে পারে ময়ূর। থারুর মশায় বলেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদির কথাও। ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে মুম্বাই হাসপাতাল উদ্বোধন করতে গিয়ে মোদি বলেছিলেন যে প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির প্রচলন ছিল। প্রমাণ ? প্রমাণ হল গণেশ দেবতা , যাঁর মানবদেহে হাতির মাথা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। করোনার সময়ে এই মোদি থালা বাজাতে , মোমবাতি জ্বালাতে বলেছিলেন। মোমবাতি জ্বালালেই না কি করোনার হদপিণ্ড ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের মোদি বলেছিলেন গ্লোবাল ওয়ার্মিং ব্যাপারটা সম্পূর্ণ মনের ব্যাপার। শশী থারুর বলেছেন , বিজেপির এই পশ্চাৎপদ দর্শন ও ভণ্ডামি যে শুধু রাজনীতিকরা প্রচার করছেন , তা নয়। এর বাইরেও অনেক ‘বাবা’ আছেন। সমকামীদের নিরাময় করার ওষুধ বিক্রি করা যোগগুরু ও আয়ুর্বেদ প্রবক্তা বাবা রামদেবের মতো অনেকেই মোদির কাছের মানুষ। এই বাবা রামদেব না কি করোনার অব্যর্থ ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। যোগী বাসুদেব ২০১৫ সালের চন্দ্রগ্রহণের সময় বলেছিলেন গ্রহণের সময় খাবার খেলে সে খাবার বিষাক্ত হয়ে যায়। বিজেপির কোন কোন প্রবক্তা দাবি করেন যে জঙ্গি বিমান ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র বৈদিক যুগেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। ভারত যে বিশ্বগুরু এটা প্রমাণ করার জন্য তাঁরা প্রচার করেন যে প্রাচীন ভারতবর্ষের কাছে সব প্রশ্নের উত্তর আছে এবং আধুনিক ভাবনা-চিন্তা ও জীবনযাপনের যে সব রীতি বাহির থেকে আসছে সেগুলোর চেয়ে প্রথাগত ভারতীয় বিশ্বাস ও জীবনযাত্রা অনেক মহান।
এরকম ধ্যান-ধারণার প্রচার কেন ?
শশী থারুরের মতে , “ বিজেপি ও তার সহযোগীরা ঘুরে-ফিরে প্রাচীন ভারতের রীতি-নীতিকে সামনে আনতে চায় , কারণ তারা বিশ্বাসনির্ভর সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদকে তুলে ধরতে চায় এবং এর মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রিয় হয়ে উঠতে চায়।
“তাদের কাছে ধর্ম কোন ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয় নয় বরং প্রথাগত পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মাধ্যমে তারা সামাজিক আচার ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে চায়। বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তন ঠেকানোর হাতিয়ার হিসেবে ধর্মকে তারা ব্যবহার করতে চায়।
“যখন মন্ত্রীরা ডারউইনবাদ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কিংবা গরুর অলৌকিক ক্ষমতার কথা প্রচার করেন , তখন বুঝতে হবে তাঁরা শুধু বৈজ্ঞানিক থিওরি ও বিশ্বাসনির্ভর ব্যাখ্যার থেকে কোন একটিকে বেছে নিতে বলার জন্য এসব বলছেন না। বরং তাঁরা এর মধ্য দিয়ে সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চান , বিশ্ববাসীর ভাবনার সঙ্গে ধর্মীয় চিন্তার জগৎ মিশে আছে। এই বক্তব্য প্রচারের মধ্য দিয়ে তাঁরা ধর্মীয় আবরণে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চান। “
২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি ‘টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় বিজেপির সায়েন্স লরিয়েটদের কথা লিখেছিলেন পরান বালকৃষ্ণান :
“For the BJP, when comes to India’s record of scientific achievments stacked against Western attainments , it’s ‘been there , done that’.
“The ruling party has an array of leaders that can be relied on to insist every Western scientific accomplishment was already in the Vedas or the Mahabharata , The heavy-hitters fall roughly into two divisions :
a ]“ Those who revel in obscurantism and disown all science or insist that all wisdom and scientific discoveries were already known and practised in the Mahabharata , Vedas or ancient India .
b] “ Those who are constantly praising cows , and their urine and dung , nicknamed by some the ‘udderly nonsense brigade .”
এবার সায়েন্স লরিয়েটদের তালিকা তুলে ধরব আমরা :
১] নরেন্দ্র মোদি [ প্রধানমন্ত্রী ]। তাঁর মহান আবিষ্কার : প্রাচীন ভারতের প্লাস্টিক সার্জারি . মহাকাশ বিজ্ঞান , করোনার হৃদপিণ্ড ফাটানো মোমবাতির আলো।
২] জগদীপ ধনখড় [ পশ্চিমবঙ্গের সাবেক রাজ্যপাল ]। তাঁর মহান আবিষ্কার : প্রাচীন ভারতে উড়োজাহাজের ব্যবহার ছিল , অর্জুনের তিরে ছিল পারমাণবিক শক্তি।
৩] বিপ্লব দেব [ ত্রিপুরার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ]। তাঁর মহান আবিষ্কার : প্রাচীন ভারতে স্যাটেলাইট কানেকশন ও ইন্টারনেট ছিল
৪] অনন্তকুমার হেগড়ে [ সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ]। তাঁর মহান আবিষ্কার : ভবিষ্যতের সুপারকম্পিউটারের ভাষা হবে সংস্কৃত।
৫] রঞ্জিত শ্রীবাস্তব [ উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতা }। তাঁর মহান আবিষ্কার : গরু হিন্দু বলে মুসলমানদের মতো তাকে কবর দেওয়া উচিৎ নয় , তাকে দাহ করা প্রয়োজন।
৬] ত্রিবেন্দ্র সিং রাওয়াত [ উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী ]। তাঁর মহান আবিষ্কার : গরুর কাছাকাছি থাকলে যক্ষ্মা রোগ সেরে যায় , গর্ভবতী নারীর গরুঢ় গঙ্গার জল পান করা উচিৎ।
৭] গিরিরাজ সিং [কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ]। তাঁর মহান আবিষ্কার : গরুর গোবর ও মূত্রের অনেক গুণ , তা নিয়ে গবেষণা দরকার।
৮] সত্যপাল সিং [ মন্ত্রী ]। তাঁর মহান আবিষ্কার : ভারতের হিন্দুরা ঋষির সন্তান , ডারউনের বিবর্তনবাদে নুতনত্ব কিছু নেই।
৯] প্রজ্ঞা ঠাকুর [ সাংসদ]। তাঁর মহান আবিষ্কার : গোমূত্র পান করলে ক্যানসার সেরে যায় , গরুর গায়ে হাত ঘষলে রক্তচাপ কমে।
১০] হর্ষবর্দ্ধন [ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ]। তাঁর মহান আবিষ্কার : ভারতই অ্যালজাবরা ও পিথাগোরাস তত্ত্বের আবিষ্কর্তা।
ভারতের চন্দ্রযান চাঁদের মাটি স্পর্শ করার পরেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে ছুটে এলেন ইসরোতে। সেদিন রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই স্বপ্নটা আপনাদের কাছে পরিবেশন করছি। স্বপ্নের একটা শিরোনামও দিলাম।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct