ইতিহাস অনুসন্ধান ও সমাজভাবনার এক অনবদ্য দলিল
আলোচক: সুলেখা নাজনীন
সমাজ জীবনে রাজনৈতিক চর্চার পাশাপাশি, সাংস্কৃতি ও সামাজিক চর্চার কথা এসে পড়ে। সেই সামগ্রিক বিষয় নিয়ে ‘উজ্জীবন’-এর জুন-জুলাই ২০২৩ সমৃদ্ধ হয়েছে। রাজনৈতিক জীবনে যে সামাজিক পটভূমি তার এক বাস্তব প্রতিফলন ফুটে উঠেছে শফিকুল হক-এর ‘পঞ্চায়েত ভোট: এতো রক্ত কেন?’ নিবন্ধে। পঞ্চায়েত নির্বাচন এলেই সচারচর দেখা মেলে রক্তস্নাত। গোলাগুলি আর বোমাবাজির কবলে পড়ে কত মানুষের যে অকাল মৃত্যু তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় সেই প্রাণহানির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন লেখক। তার লেখনিতে স্পষ্ট করে দিয়ে বলেছেন, পঞ্চায়েত ভোট হবে আর বিশ তিরিশ জনের প্রাণ যাবে না তা হয় না। পঞ্চায়েত নির্বাচন এলেও যে দশ বিশটা বাড়ি জ্বলবে, ইট পাথর ছুড়তে থাকবে, লাঠি কিংবা অস্ত্র হাতে নারী পুরুষ নির্বিশেষে একে অপরের দিতে তেড়ে যাবে সেই বাস্তব চিত্র যে অস্বীকার করা যায় না। তাই পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সম্প্রচারে চোখ রাখেন মানুষ। এই বুঝি কার প্রাণ যায়।এ সবের মধ্যে লেখকের মনে প্রশ্ন জাগে, নির্বাচন এলে বিবাদমান রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষ বাধে ঠিকই, কিন্তু প্রাণ হারাতে দেখা যায় মূলত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে। উদাহরণ হিসেবে ডোমকল কিংবা ভাঙড়ের কথা তুলে ধরেছেন লেখক। যেখানে নির্বাচন মানেই মৃত্যু। এই অসহিষ্ণুতা নিবারণে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের চুপ করে বসে থাকা যে কাম্য নয়, তা ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন লেখক। সেই লেখকের মনে প্রশ্ন জাগে, এই লাগাতার মৃত্যু থেকে বাঁচার কি কোনও সমাধান নেই। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে কি তাজা প্রাণকে বাঁচানো যায় না?এই মৃত্যুর পিছনে লেখক দেখেন গরিব হাভাতে নিরক্ষর জনগণের মধ্যে ক্ষমতা দখলের প্যাচে পড়ে অঘোরে প্রাণ দেওয়ার নির্বুদ্ধিতা।লেখকের মতে পাড়ায় পাড়ায় এখন বেড়েছে দাদাগিরি আর মাস্তানি। তাদের দৈত্যময় মনোভাবের জন্য মানুষ যেন প্রহর গুনছে। েএটা সমাজের কাছে অভিশাপ হয়ে উঠছে সেটা আর কবে বুঝবে মানুষ, সেকথাই বোঝোতে চেয়েছেন লেখক। লেখকের বদ্ধমূল ধারণা, সমাজের এই নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতে বেশি করে আলোচনা দরকার। তাহলেই হয়তো বেরিয়ে আসতে পেরে কোনও পথ। সাংস্কৃতিক চর্চার বাহন ‘উজ্জীবন’-এ এই রাজনৈতিক চর্চা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ তা অস্বীকার করা উপায় নেই।
বাংলার প্রতিষ্ঠা দিবস নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এখন বিতর্ক তুঙ্গে। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস চাইছে ১ বৈশাখ হোক পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠা িদবস। আর বিরোধী দল কিংবা রাজ্যপাল ২০ জুনকে বাংলার প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এই ২০ জুনের পিছনে রয়েছে বঙ্গবঙ্গের ইতিহাস। ১৯৪৭ সালের সেই ২০ জুন তৎকালীন অখণ্ড বাংলা বিভাজনের বিষযটি উত্থাপিত হলে, বঙ্গভঙ্গের পক্ষে বেশি ভোট পড়ে। ফলে দু’টুকরো হয়ে যায় বাংলা। তৈরি হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) এবং অপর একটি অংশ পশ্চিমবঙ্গ নামে পরিচিতি পায়। কিন্তু যারাই এই বঙ্গবঙ্গের পক্ষে সায় দিয়েছেন, তারাই আবার ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদে ভূমিকা নেন। তাই স্বাধীনতার প্রাককালে অবিভক্ত বাংলার কতৃত্ব মুসলিমদের হাতে আসতে পারে এই আশঙ্কা থেকেই বঙ্গভঙ্গ নিয়ে মত পাল্টে যায় িহন্দুত্ববাদীদের। তাই তারা ২০ জুনের বঙ্গ ভঙ্গকে সমর্থন করেন। এর পর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে তাই বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বিতর্ক থেকে যায়। সেই বঙ্গভঙ্গ নিয়ে এক বিশ্লেষণ মূলক আলোচনা করেছেন মুহাম্মদ আফসার আলী তার ‘বঙ্গ চুক্তি খারিজ: শতবর্ষের আলোকে পর্যালোচনা।’ আফসার আলী অকপটে লিখেছেন, প্রাক স্বাধীনতা যুগে অবিভক্ত বাংলায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তারা ৫৪ শতাংশ হলেও শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে লাগাম ছিল কিন্তু হিন্দুদের হাতে। লেখকেএ প্রসঙ্গে ১৯২৩ সালে ‘বঙ্গ চুক্তি’র কথা উল্লেখ করেছেন, যা খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল। স্বরাজ পার্টি ও বঙ্গ প্রাদেশিক পার্টির এই বঙ্গ চুক্তিতে যেসব শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে তাতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান হয়, রচিত হয় সম্প্রীতির বন্ধন। এর মধ্যে অনেক শর্ত মানা হলে আজকের দিনে ধর্মীয় বৈষম্য কিংবা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়তো রোখা যেত। যেমন ওই চুিক্ততে মুসলিমদের ৫৫ শতাংশ চাকরি কিংবা মসজিদের পাশ দিয়ে বাজনা বাজানো নিষিদ্ধ করার উল্লেখ রয়েছে। লেখক সেসব তুলে ধরে বঙ্গ চুক্তির সার্থকতার পক্ষে সওয়াল করেন। সেই অতীত ইতিহাস রোমন্থন করে লেখক, বোঝাতে চেয়েছেন বঙ্গভঙ্গের পর এ রাজ্যে সংখ্যালঘু মানুষের অধিকার সুরক্ষিত হয়নি। জনপ্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি গণতন্ত্রে। লেখকের মতে হিন্দু মুসলমানের কল্যাণে নয়, বাঙালি জাতির কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করে েগলে তবেই বাংলা গড়ার সার্থকতা।রাজনৈতিক পটভূমিকায় ‘উজ্জীবন’ মূল্যবান প্রবন্ধের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আলোচনায় বলিষ্ঠ ভাবে স্থান পেয়েছে কবি তৈমুর খানের কবিদের কী করে ভালোবেসেছিলেন’ নিবন্ধে। তৈমিুর খানের মতে, কবির হৃদয়ই একটা দেশ, বাাঁর ও মরণের দেশ। কবিতা অনুগ্রাহী আজ কি মৃতপ্রায় সেই প্রশ্ন প্রথমেই তুলেছেন কবি। এক কবির একটি কবিতা ৭০টি পত্রিকায় প্রকাশের পরও কারো নজরে না পড়ায় কবিতার পাঠক সমাজ নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেছেন কবি। লেখক তার নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেছেন, আগে বিদেশি কবিদের ভালো ভালো কবিতা অনুসরণ করা হত। এখন তারও পাঠক কমে এসেছে। বাংলা ভাষা চর্চায় কবিতার আসঙ্কি কমে যাওয়ায় বিদেশি কবিদের কবিতাও যে ব্রাত্য হয়ে উঠছে সেটাই বলতে চেয়েছেন। অথচ, বাংলার কবির মন মানসিকতা, কবিতা মানবিক জীবনবোধের উপর দাঁড়িয়ে। আগে প্রতিটি কবিতার চরণে চরণে ছিল শিকড় ছেঁড়া শব্দের কান্না। এখন যেসন কবিতা িনস্তরঙ্গ। কবিতা লেখার অনুপ্রেরণাকে উসকে দিয়েছে তৈমুর খানের এই প্রবন্ধটি।রমজান আলি সনেট কবি মধুসূদন দত্তের মুসলমান বিষয়ক নাটকের কথা তুলে ধরেছেন। বাঙালিয়ানার সত্তা বজায় রেখে অমিত্রাক্ষর ছন্দে মধূসূদন দত্ত যে ‘রাজিয়া’ নাটক লিখেছিলেন, তার মধ্যে ফুটে উঠেছে মুসলিম বীরত্বের কাহিনী। বাঙালিরা কখনো যে ধর্মীয় সংকীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ রাখেনি, তা ‘রাজিয়া’ নাটকে সুলতানা রাজিয়ার প্রশাসকের ভূমিকায় প্রস্ফূটিত হয়ে ওঠে। সেটাই বর্ণিত হয়েছে রমজান আলির নিবন্ধে।তবে ‘উজ্জীবন’-এর জুন জুলাই সংখ্যা বলিষ্ঠভাবে সম্পাদনা করেছেন অধ্যাপক সাইফুল্লা তাতে সন্দেহ নেই। বাঙালি মুসলমান সমাজের সাহিত্য অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করতে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সংগ্রহশালা ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে সমাজ চিন্তকদের খোরাক জুগিয়েছেন।
অঙ্গসজ্জা সুন্দর হলেও সূচিপত্রে ‘দৃষ্টিপাত’ এর পরিবর্তে ‘দষ্টিপাত’ লঘু প্রমাদ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
মাসিক উজ্জীবন (জুন-জুলাই ২০২৩)
সম্পাদক: সাইফুল্লা
বিনিময়: ৫০ টাকা
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct