কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ একটি হিন্দি সিনেমায় বিকৃত সুরে গাওয়া হয়েছে এই অভিযোগে চারিদিকে প্রতিবাদ সংঘটিত হচ্ছে। সুর বিকৃতির প্রতিবাদ করেও কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্থাপন করলেন নজরুল নাটকের গবেষক, অধ্যক্ষ শেখ কামাল উদ্দিন
‘ছু ন্দরী বধ’ কাব্যের নাম শুনেছেন? শোনেন নি! না, তা’হলে আপনি বাংলা সাহিত্যের রসজ্ঞ পাঠকই নন! ‘দ্রোণগুরু’ কবিতা পড়েছেন? তাও পড়েন নি! কি বললেন? ‘দ্রোণাচার্য’-কে নিয়ে লেখা কবিতা? আরে মশাই না। আপনি দেখছি বাংলা কাব্যের কোনো খবরই রাখেন না! কিন্তু আপনাকে তো শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ কাঁধে, রঙিন ডিজাইনের পাঞ্জাবিতে রবীন্দ্রসদন চত্বরে দেখেছি। কখনো কখনো কলকাতার বিভিন্ন হলে কবিতা পড়তেও শুনেছি। উত্তরীয় গলায় পরছেন বা কোনো স্মারক নেওয়ার ছবিও ফেসবুকে মাঝে মাঝেই দেখি। বিখ্যাত কবিদের সঙ্গে ছবি দেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটমান বিষয়ের প্রতিবাদে মিছিলে হাঁটেন। কাগজে যাতে আপনার মুখ দেখা যায় তার জন্য বিখ্যাত ব্যক্তিদের গা ঘেঁষাঘেঁষি দাঁড়ানোর নিরন্তর কসরত করতেও তো দেখেছি। তারপর দিন কোনো কাগজে সেই ছবি ছাপলে ফেসবুকে দিয়ে লিখতে দেখেছি গতকাল কার কার সঙ্গে কোথায় কোথায় ছিলেন। একটা গর্বিত, হাসি হাসি মুখের ছবিও সঙ্গে দেন। সেই আপনি বলছেন, ‘ছুছুন্দরী বধ’ পড়েন নি, এমনকি নামও শোনেন নি!এদিকে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ নিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন! আচ্ছা কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে এইরকম ঘটনা এই কী প্রথম হ’লো! কবি যখন বেঁচেছিলেন, তখন কতবার শুধু তাঁকে বাসা পাল্টাতে হয়েছিল, জানেন! কি বললেন, ‘কাজীদা’র মতো কবিকে বাসা পাল্টাতে হবে কেন? কেউ তো কবিকে থাকার জায়গা দিতে পারলেই ধন্য হয়ে যাবেন, এইটাই তো জানেন, তাই না! রাগ হচ্ছে আমার উপর! এইসব কথা বলছি বলে! প্লিজ, রাগ করবেন না। এই অধম একটু-আধটু পড়েছে বলেই জানতে ইচ্ছে করছে। যদি পুরোটা জানতে পারতাম বা আপনি জানাতেন তাহলে খুব ভালো লাগতো। তাই আপনাকে এত কথা জিজ্ঞাসা করা।শ্যামাপুজো সদ্য শেষ হলো। মন্ডপে মন্ডপে বেজে উঠেছে– ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’, ‘বল রে জবা বল, কোন্ সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণ তল’। কালীপুজোতে এই গানগুলো তো এতদিন শুনে এসেছি। কালীপুজো হলে এইগুলো বাজবে, এ তো স্বাভাবিক। এর সঙ্গে নজরুলের কি সম্পর্ক! নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’-এর কি সম্পর্ক! সিনেমার গানের কি সম্পর্ক! এই সব মনে মনে ভাবছেন তো কবি মশাই! সত্যিই তো, আমারই তো ভুল। এসব জানতে চাওয়ার কি দরকার! কোথায় ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ নিয়ে গরমাগরম বিতর্ক, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, তীক্ষ্ণ বাণ- নিক্ষেপ। সেসব নিয়ে কথা না বলে শ্যামাসংগীত নিয়ে আহাম্মক, নির্বোধ ছাড়া কেউ এই প্রশ্ন করে! না, জানতে চায়! আমি আবার ভুল করে ফেললাম। আমি ভেবেছিলাম বোধহয় এগুলো কোনো কালীপ্রেমী তন্ত্রসাধকের লেখা। পরে জানলাম একজন মুসলমান কবি কাজী নজরুল ইসলাম এগুলো লিখেছেন! আমি তো জানতাম তিনি ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ লিখেছেন। এতক্ষণে বুঝলাম কেন তাঁকে ‘কাফের’ আখ্যা দিয়েছিলেন মুসলমানরা! কই তখন তো তাঁকে হেনস্তা করার জন্য পথে নামেননি! তিনিই বরঞ্চ জবাব দিয়েছিলেন ‘মৌ-লোভী’ যত মৌলবীদের বিরুদ্ধে! ‘শনিবারের চিঠি তাঁকে কত রকমভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল। তখন কোথায় ছিলেন কবি? আবার হিন্দু মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন বলে দু’হম্প্রদায়ের মানুষের দ্বারাই তিনি অপদস্ত হয়েছিলেন। তাঁর হয়ে তো পথে নামেন নি! ভয় পেয়েছিলেন। পাছে আপনাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ আখ্যা দেওয়া হয়!
আর একটি কথা। এই গানটি যে প্রযোজকরা তাঁদের সিনেমায় ব্যবহার করতে পারলেন, তার অনুমতি কে দিলেন? কেন দিলেন? কিসের জন্য দিলেন? কত টাকার বিনিময়ে দিলেন? পরিবারের একপক্ষ বলছেন, তাঁরা অনুমতি দিয়েছিলেন। তবে সুর পরিবর্তনের অনুমতি দেন নি! তবে কিজন্য অনুমতি দিয়েছিলেন? চুক্তিপত্র সামনে আনা হোক। সবাই দেখুন, কারা অন্যায় করেছেন, ভুল করেছেন? আর এক পক্ষ বলছেন, তাঁরা কিছুই জানেন না। আচ্ছা কাজী নজরুল ইসলাম কি এখন একটি পরিবারের সম্পত্তি? যে কোন অনুষ্ঠান হলে প্রায় সবাই চান সেই পরিবার থেকে কেউ না কেউ উপস্থিত থাকুন। কেন বলুন তো! পরিবারের সদস্যদের সান্নিধ্য লাভ করলে আপনার জৌলুস বাড়বে বলে? কাজী নজরুল ইসলামের গান, কবিতা, নাটক নিয়ে পরিবারের কতজন গবেষণা করেছেন, কেউ বলতে পারবেন? তবে অনুষ্ঠানে তাঁদের ডেকে আনা কেন? অথচ বহু তরুণ- তরুণী নিজস্ব চেষ্টায় দিনের পর দিন কবির লেখা বিভিন্ন লাইব্রেরীতে গিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করে গবেষণা করেছেন, করছেন। তাঁদের মূল্য নেই? তাঁদের কেন ডাকা হবে না? তাঁদের কেন ডাকা হয় না? হে কবি, হে মহান প্রতিবাদী কবি, এ ব্যাপারে কিছু বলবেন না! তাঁদের কোনো অনুষ্ঠান নিয়ে যেতে হলে আপনাকে গ্যাটের টাকা খরচ করে নিয়ে যেতে হয়। অথচ অনেকেই আছেন শুধু কবির বংশধর বলে সরকারের কাছ থেকে নানাবিধ সুযোগ পেয়ে থাকেন। বিনিময়ে, পরিবর্তে সাধারণ মানুষের জন্য তাঁরা কি ফেরত দেন? একবার ভাববেন না!এই সময় কেউ কেউ বলছেন গানটি যে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেটা ভুলে যাবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো মনে করবে এই গানটি বিখ্যাত গীতিকার-সুরকার, অস্কার-জয়ী শিল্পী এ. আর. রহমানের। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে ভুলে না যায় যে গানটি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা তার জন্য হে কবি, হে গায়ক, হে প্রতিবাদী আপনি কি করেছেন? আপনি তো টাকা নিয়ে গান শেখান। আবৃত্তি শেখান। কখনো কি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানোর চেষ্টা করেছেন বিনা পয়সায়, নিজের পয়সা খরচ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে তাদের জানাতে মে, শুধু এই গান নয়, আরও অনেক গান, আরও অনেক সৃষ্টি যেগুলো আমরা জানি না অথচ সেগুলি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টি! লজ্জা পাচ্ছেন! ক্ষুব্ধ হচ্ছেন এই কথাগুলো পড়তে পড়তে। খ্রীস্টান মিশনারীরা যখন এদেশে এসে স্কুল, কলেজে প্রতিষ্ঠা করলেন, ইংরাজী শিক্ষা দিলেন, বাইবেলের বাংলা অনুবাদ করে বিনামূল্যে বিতরণ করে যীশুর মাহাত্ম্য প্রচার করলেন, তাঁদের আলাদা উদ্দেশ্য যাই থাক সেগুলো তো করলেন! আপনি, আমি নজরুল ইসলাম চর্চা করতে বিনা পারিশ্রমিকে কি করলাম! নিজের পয়সায় বই ছাপিয়ে প্রচার করলেন! নিচু ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দিলেন! প্রচারও করলেন না, পৌঁছেও দিলেন না! আমরা একটি কলেজের সঙ্গে চুক্তি করে ত্রিশ ঘণ্টার জন্য নজরুল চর্চার ব্যবস্থা করেছিলাম। সেখানে একজন নজরুল সংগীতের ইংরেজি অনুবাদককে অনুরোধ করেছিলাম তাঁর ইংরেজি গান তাঁর কোনো পরিচিত শিল্পীকে দিয়ে গাওয়াতে। তাহলে ওই কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা জানতে পারতেন নজরুলের গানের ইংরেজি অনুবাদ সম্পর্কে। কিন্তু তিনি অর্থ চেয়ে বসলেন। ফলে আমাদের পক্ষে সম্ভব হলো না ওই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে নজরুলের গানের ইংরেজি অনুবাদ পৌঁছে দেওয়ার। মুখ লুকোবেন না, কবি-গায়ক-শিল্পী। সিনেমার প্রযোজক সংস্থা, সুরকার-শিল্পীরা ব্যবসার স্বার্থে, অর্থের বিনিময়ে নজরুল ইসলামকে পৌঁছে দিয়েছেন কোটি কোটি অবাঙালি দর্শক-শ্রোতার কণ্ঠে। হ্যাঁ, সুরের বিকৃতি ঘটিয়েছেন। পছন্দ হলে আপনি শুনবেন, না হলে শুনবেন না! যেমন করে ‘ছুছুন্দরী বধ’-এর কথা কেউ মনে রাখেনি, যেমন করে হাজারও কালিমা লিপ্ত করার চেষ্টা করেও সমালোচকেরা ব্যর্থ হয়েছেন কবিকে হেয় প্রতিপন্ন করতে। এই অপচ্ছন্দের গানও একদিন হারিয়ে যাবে। নজরুলের সুর, গিরীন চক্রবর্তীর কণ্ঠ, এই গানকে নিয়ে কোটি কোটি বাঙালির আবেগ বেঁচে থাকবে। জয়তু নজরুল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct