ইসরায়েলিরা যখন এই ধাক্কা সামলে উঠতে পারছে না, তখন আরও ৭ অক্টোবর ঘটানোর অঙ্গীকার করেছে হামাস। ঘোষণা দিয়েছে, তারা থামবে না। ফিলিস্তিনিরা নিজস্ব ভূমি ও হামাসমুক্ত ভবিষ্যতের দাবিদার। গাজায় শিশুসহ কয়েক হাজার বেসামরিক নাগরিকের লাশের ছবি দেখে আমার বুক ভেঙে যায়। ফিলিস্তিনি শিশুরা তাদের মৃত মা–বাবার জন্য কাঁদছে। বাবা-মায়েরাও তাঁদের সন্তানদের হাত-পায়ে নাম লিখে রাখছেন যেন ভয়ংকর কিছু ঘটে গেলে তাদের শনাক্ত করা যায়। লিখেছেন জো বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
এ সময় আমরা যে বিকল্প বেছে নেব, তার ওপরই নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ। এই যুদ্ধবিগ্রহের উল্টো দিকের বিশ্ব আসলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আমরা কি হামাসের নির্ভেজাল শয়তানি দেখতে থাকব? ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন—এই দুই জাতি কি একদিন পাশাপাশি দুটি দেশে শান্তিতে বাস করবে না? আমরা কি ভ্লাদিমির পুতিনকে তাঁর আগ্রাসী ভূমিকার জন্য জবাবদিহি করব না? আমরা কি চাইব না যে ইউক্রেনের মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচুক? আর ইউরোপ নোঙর হয়েই থাকুক বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার?আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, আমরা কি একটা ইতিবাচক ভবিষ্যতের জন্য অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাব না? নাকি যারা আমাদের মূল্যবোধে বিশ্বাসী নয়, তাদের হাতেই আমাদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেব? আমরা কি চাইব যে তারা টেনেহিঁচড়ে পৃথিবীকে আরও বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাক? আরও বিভক্তি তৈরি করুক?পুতিন ও হামাস প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে যুদ্ধে জড়িয়েছে। পুতিন ও হামাসের আশা বৃহত্তর আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও একত্রকরণের চেষ্টাকে ধসিয়ে দেওয়া। তারা অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিতে চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তো তা করতে দেবে না, দিতে পারে না। আমাদের নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এবং গোটা দুনিয়ার ভালোর জন্যই এই অবস্থান।এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র একটি অপরিহার্য দেশ। আমরা মৈত্রী ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক করি তাদের সঙ্গে, যারা দখলদারদের বিরুদ্ধে এক জোট হয়। আমাদের উদ্দেশ্য একটি উজ্জ্বলতর, শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা। পৃথিবী সমসাময়িক এসব সমস্যা সমাধানে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নেতৃত্বের দায় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দিচ্ছে। কারণ, আমরা যদি আজ এই চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, তাহলে দ্বন্দ্ব–সংঘাত আরও বাড়বে। আর পাল্লা দিয়ে বাড়বে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ব্যয়। আমরা তা হতে দিতে পারি না।ইউক্রেনের মানুষের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করার মূলে কাজ করেছে এই বোধ। আমরা চেয়েছি, ইউক্রেন যেন পুতিনের বর্বর যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে যেতে পারেন। গত শতাব্দীর দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ থেকে আমরা জেনেছি, ইউরোপে দখলদারির বিরুদ্ধে সবাই যদি চুপ থাকে, তাহলে সংকট বাড়ে। এই সংকট শুধু ইউরোপে আর সীমাবদ্ধ থাকে না। যুক্তরাষ্ট্রকেও সক্রিয় হতে হয়। সে কারণে ইউক্রেনকে আমরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তা আমাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিনিয়োগ। ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিরোধ মেটাতে ইউক্রেনে আমাদের এই যুক্ততা প্রয়োজন।আমরা মার্কিন সেনাবাহিনীকে এই যুদ্ধ থেকে দূরে রেখেছি। আমরা ইউক্রেনের সাহসী জনগোষ্ঠীকে অস্ত্র ও আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছি যেন তারা তাদের দেশের মাটিকে মুক্ত রাখতে পারে। আমরা চাই, এই বিরোধ যেন আর না ছড়ায়। পুতিনের এই জয়কে আমরা তাই প্রতিরোধ করতে চাই।
যুক্তরাষ্ট্র একা এসব কাজ করছে না। ৫০টির বেশি দেশ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করছি যেন ইউক্রেন নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। আমাদের অংশীদারেরা এই যুদ্ধের অর্থনৈতিক দায়ের বড় অংশ বহন করছে। আমরা আরও শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ ন্যাটো গঠন করেছি। আমাদের মিত্রদের শক্তিসামর্থ্য বাড়লে আদতে আমাদেরই নিরাপত্তা জোরদার হবে। একই সঙ্গে এ কথাও জোরালোভাবে বলতে চাই যে রাশিয়ার আগ্রাসন রুখতে আমরা ন্যাটোর প্রতিটি ইঞ্চির সুরক্ষা দেব। এই যুদ্ধে এশিয়ায় আমাদের মিত্ররাও আমাদের সঙ্গে রয়েছে। তারাও ইউক্রেনকে সমর্থন দিচ্ছে এবং পুতিনের কাছ থেকে জবাবদিহি চাইছে। কারণ, তারা জানে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও ইউরোপের স্থিতিশীলতা একই সূত্রে গাঁথা।হাসামের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ভয়াবহ যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। বিমান ও স্থল অভিযান চালিয়ে গাজার একাংশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছ। হাসামের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ভয়াবহ যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। বিমান ও স্থল অভিযান চালিয়ে গাজার একাংশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছ।আমরা আরও দেখেছি কীভাবে মধ্যপ্রাচ্যের বিরোধ পুরো বিশ্বে অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয়। আমরা হামাসের খুনে ধ্বংসবাদী আচরণ থেকে ইসরায়েলিদের সুরক্ষার অধিকারের প্রতি জোরালো সমর্থন জানাই। ৭ অক্টোবর হামাস ৩৫ জন মার্কিন নাগরিকসহ ১ হাজার ২০০ মানুষকে খুন করে। হলোকাস্টের পর এক দিনে ইহুদিদের এত মৃত্যুর ঘটনা আর ঘটেনি। নবজাতক, দু-আড়াই বছরের শিশু, মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, শারীরিক প্রতিবন্ধী, হলোকাস্ট থেকে বেঁচে ফেরা মানুষের অঙ্গহানি ও হত্যা করেছে ওরা। পরিবারের সব সদস্য খুন হয়েছেন, এমন নজিরও আছে। কনসার্টে অংশগ্রহণকারী অল্প বয়সী তরুণ-তরুণীরা খুন হয়েছেন। বুলেটবিদ্ধ ও অগ্নিদগ্ধ কিছু লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। আর এক মাসের বেশি সময় ধরে দুই শতাধিক মানুষ জিম্মি হয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে শিশু ও মার্কিন নাগরিক রয়েছেন। তাঁদের পরিবারগুলো নরকযন্ত্রণা ভোগ করছে। স্বজনেরা বেঁচে আছেন না মারা গেছেন, জানতে উদ্বেগের সঙ্গে অপেক্ষা করছে তারা। আমি যখন এই লেখা লিখছি, তখনো জিম্মি মুক্তির জন্য আমার সহকর্মীরা নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ইসরায়েলিরা যখন এই ধাক্কা সামলে উঠতে পারছে না, তখন আরও ৭ অক্টোবর ঘটানোর অঙ্গীকার করেছে হামাস। ঘোষণা দিয়েছে, তারা থামবে না। ফিলিস্তিনিরা নিজস্ব ভূমি ও হামাসমুক্ত ভবিষ্যতের দাবিদার। গাজায় শিশুসহ কয়েক হাজার বেসামরিক নাগরিকের লাশের ছবি দেখে আমার বুক ভেঙে যায়। ফিলিস্তিনি শিশুরা তাদের মৃত মা–বাবার জন্য কাঁদছে। বাবা-মায়েরাও তাঁদের সন্তানদের হাত-পায়ে নাম লিখে রাখছেন যেন ভয়ংকর কিছু ঘটে গেলে তাদের শনাক্ত করা যায়। প্রতিটি প্রাণই অমূল্য। ফিলিস্তিনি নার্স ও চিকিৎসকেরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন প্রত্যেকের জীবনকে রক্ষা করতে। তাঁদের হাতে সামান্য সরঞ্জাম আছে, কিংবা কিছুই নেই। প্রত্যেক ফিলিস্তিনির প্রাণহানি একটি গোটা পরিবার বা সমাজকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। যুদ্ধে সাময়িক বিরতিই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া অনুচিত। যুদ্ধ বন্ধ হওয়া উচিত সারা জীবনের জন্য। উচিত চলমান সহিংসতার চক্র ভেঙে গাজা ও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কিছু গড়ার উদ্যোগ নেওয়া, যেন একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না হয়। ৭ অক্টোবরের কয়েক সপ্তাহ আগে আমি নিউইয়র্কে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। ওই আলোচনায় কিছু বাস্তবসম্মত প্রতিশ্রুতি নিয়ে কথা হয়। বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের অন্তর্ভুক্তিতে সাহায্য করতে পারে, এমন সব বিষয়ই ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, জর্ডান ও ইসরায়েলকে মাঝখানে রেখে ভারত ও ইউরোপের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক করিডর স্থাপনের অভিনব প্রস্তাবও সে কারণেই উঠেছিল। গত সেপ্টেম্বরে ভারতে জি-২০ বৈঠকে এর ঘোষণাও দেওয়া হয়েছিল। দেশে দেশে যোগাযোগ বাজারের সম্ভাবনা বাড়ায়, বিনিয়োগেরও সুযোগ সৃষ্টি করে। আঞ্চলিক যোগাযোগ–অর্থনৈতিক অবকাঠামো তরুণদের জন্য আরও বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে। আমরা মধ্যপ্রাচ্যে তা-ই চাই। আমি এমন এক ভবিষ্যৎ চাই, যেখানে হামাসের সহিংসতা ও ঘৃণার কোনো জায়গা নেই। আমি মনে করি, এমন একটা ভবিষ্যৎ নস্যাৎ করতেই হামাস এই সংকট তৈরি করেছে। গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের বড় একটি অংশ শিশু। এক শিশুর মৃতদেহ জড়িয়ে কাঁদছেন স্বজন।এটা পরিষ্কার যে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দুটি পৃথক দেশের দিকে যেতে হবেই। যদিও এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই চাওয়া সুদূর পরাহত, তবু এটা হতেই হবে।দুই দেশভিত্তিক সমাধান—দুটি জাতি পাশাপাশি বসবাস করবে, সমান স্বাধীনতা, সুযোগ ও মর্যাদা ভোগ করবে, যেখানে শান্তিই থাকবে সর্বাগ্রে। এর জন্য ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি—দুই পক্ষের কাছ থেকেই প্রতিশ্রুতি চাই। সেই সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্র, তাদের মিত্র ও অংশীদারদের। এই কাজ এখনই শুরু করতে হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct