মহবুবুর রহমান : হামাস নেতা সালেহ আল-আরৌরি বলেন, এ অভিযান ছিল “দখলদারী অপরাধের” সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়া। তিনি আরো যোগ করেন যে, যোদ্ধারা আকসা মসজিদ এবং দখলদার ইস্রায়েলের হাতে বন্দী হওয়া হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীকে রক্ষা করছে। এনজিও আডমির অনুমান করেছে যে, প্রায় ৫,২০০ জন ফিলিস্তিনি বন্দী রয়েছেন; যাদর মধ্যে ৩৩ জন মহিলা এবং ১৭০ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক।তথ্যমতে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামাস হামলা চালালে এক হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন। হামাসের হাতে জিম্মি হন প্রায় ২০০ ইসরায়েলি ও বিদেশী নাগরিক। প্রথমে এক হাজার ৪০০ নিহত ও ২৪০ জিম্মির কথা বললেও পরে সংখ্যাটি সংশোধন করে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।এর পর থেকে প্রায় ৪০ দিন ধরে গাজা ভূখণ্ডে নির্বিচার ও প্রতিশোধমূলক বিমান ও স্থল হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এই হামলার সর্বশেষ লক্ষ্যবস্তু হল গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফা।বেশ কয়েকদিন ধরেই আল-শিফা হাসপাতালের আশেপাশের এলাকাগুলোতে চলছে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে স্থল যুদ্ধ। এর মাঝে থেমে নেই ইসরায়েলের নির্বিচার বোমাবর্ষণও।হাসপাতাল থেকে কেউ বেরও হতে পারছেন না, সেখানে কেউ ঢুকতেও পারছেন না। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও চিকিৎসাসামগ্রীর অভাবে হাসপাতালের রোগী, চিকিৎসক ও সেখানে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত মানুষ চরম দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।প্রত্যক্ষদর্শীরা হাসপাতালের ভেতরের পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ বলে বর্ণনা করেছেন। তারা জানান, চেতনানাশক ছাড়াই এরকম অস্থায়ী অপারেশ থিয়েটারে রোগীদের সার্জারি করছেন চিকিৎসকরা। তাদের কাছে সামান্য খাবার-জল রয়েছে, যা খুব শিগগির ফুরিয়ে যাবে।এ তথ্য জানিয়েছে রয়টার্স, বিবিসি, সিএনএন,আল জাজিরা।নিহতদের লাশ দাফন করারও জায়গা নেই—পচা লাশের গন্ধে ভরে গেছে পুরো হাসপাতাল। হাসপাতালটির পরিচালক মোহাম্মাদ আবু সালমিয়া জানান, কমপ্লেক্সের ভেতর গণকবরে খুঁড়ে শ শ মরদেহ কবর দেওয়া হয়েছে।এদিকে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানায়, ‘(হাসপাতালের) একটি সুনির্দিষ্ট জায়গায়, পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে হামাসের বিরুদ্ধে এই নিখুঁত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।’সেনাবাহিনী অপর এক বিবৃতিতে দাবি করে, অভিযানের সময় তারা হাসপাতালে ইনকিউবেটর, শিশুদের জন্য খাবার ও চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে।ফিলিস্তিনে নির্বিচারে গণহত্যা নিয়ে পশ্চিমাদের নৈতিক অবস্থান খুবই অমানবিক ও উদ্বেগের! ইসরাইল দাবি করে,‘আমাদের মেডিকেল টিম ও আরবি ভাষায় কথা বলতে পারেন এমন সেনারা এই অভিযানে আছেন। তাদের দায়িত্ব এসব উপকরণ সঠিক মানুষের হাতে তুলে দেওয়া’।ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল পিটার লার্নার সিএনএনকে জানান, ‘(আল-শিফা) হাসপাতাল ও কমপাউন্ড হামাসের সব কার্যক্রমের কেন্দ্র। এমন কী, একে আমরা (হামাসের) হৃদযন্ত্র বা মধ্যাকর্ষণকেন্দ্র হিসেবেও বিবেচনা করতে পারি।’ বিশ্লেষকদের অভিমত, এ দাবি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও আক্রোশমূলক।যা আসলেই ভিত্তিহীন।
এদিকে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাই আল-কাইলা এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি বাহিনীর এই অভিযানকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে নতুন অপরাধ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।ফিলিস্তিনের ওয়াফা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে অসহায় রোগীরা আছেন। একইসঙ্গে আছেন চিকিৎসাকর্মীরাও। হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে ইসরায়েল মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ করেছে।’ গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল-কুদরা আল জাজিরাকে বলেন, ‘ইসরায়েলি বাহিনী এখন হাসপাতালের বেসমেন্টে আছে। সেখানে তারা তল্লাশি চালাচ্ছে। কমপ্লেক্সের ভেতরেও আছে সেনারা। সেখানে নির্বিচার গুলি ও বোমাবর্ষণ চালাচ্ছে।’ গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ড. মুনির আল-বুর্শও আল জাজিরা টিভিতে দেওয়া বক্তব্যে বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী হাসপাতাল কমপ্লেক্সের পশ্চিম অংশে হামলা চালিয়েছে। এদিকে হোয়াইট হাউস পক্ষপাতদুষ্টতা করে জানিয়েছে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে যে তথ্য আছে, তা ইসরায়েলের দাবির সঙ্গে মিলে যায়।ইসরায়েলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে হোয়াইট হাউজ জানায়, হামাস ও অপর এক সশস্ত্র সংগঠন, ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ তাদের ‘নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র’ আল-শিফার অভ্যন্তরে লুকিয়ে রেখেছে। হামাস এসব দাবি অস্বীকার করেছে। বিবিসির বিশ্লেষণও একই কথা বলছে, প্রতিষ্টিত করেছে।জাতিসংঘের দেওয়া তথ্যের সারকথা হচ্ছে আল-শিফা হাসপাতালে অন্তত তিন হাজারের মত রোগী, চিকিৎসক ও বাস্তুচ্যুত মানুষ আছেন। নিরবচ্ছিন্ন ড্রোন ও স্নাইপার হামলার কারণে তারা বের হতে পারছেন না।এ ছাড়া, জাতিসংঘ গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানায়, আল-শিফায় ভেন্টিলেটর সহ সার্বিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে এখন অবধি বহু সংখ্যক রোগী মারা গেছেন।এদিকে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছে। ফিলিস্তিনের হাসপাতাল,স্কুল, শরনার্থীশিবির আদিতে ইসরাইল কর্তৃক সৃষ্ট কৃত্রিম সংকটময় পরিস্থিতির কবলে পড়ে মৃতের সংখ্যা উদ্বেগজনক ভাবে হু হু করে বাড়ছে! তথ্যমতে প্রায় ১৫০০ মানুষ শুধু শিফা হাসপাতালে আবদ্ধ হয়ে আছেন।যে কোনো সময় ৬০০-৭০০ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।তাই হু (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন) অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। ইতিমধ্যে এ যুদ্ধ ত্রাস নিয়ে বিশ্ব নেতারা সবাই ঝেড়ে না কাঁশলেও ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিন (গাঁজা) ভূখণ্ডে অতর্কিত হামলা ও বোমাবর্ষণের বিপক্ষে রাষ্ট্র সংঘ কর্তৃক আনীত নিন্দা প্রস্তাবে ১৪৫ টি দেশ স্বপক্ষে (ইসরাইলের বিপক্ষে) ভোট দিয়েছে।এর মধ্যে ভারত অন্যতম। উপরন্তু,ভারত সহ কয়েকটি দেশ স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষেও মত দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক অতি সম্প্রতি রাজধানী লন্ডনের লর্ড মেয়র’স ব্যাঙ্কোয়েট হলে দেওয়া এক বক্তব্যে হামাস-ইসরায়েলের সাম্প্রতিক যুদ্ধ নিয়ে দ্বিরাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের কথাই স্পষ্ট হয়েছে। তিনি আরোও বলেন, ‘অনেকেই ভাবতে পারেন যে ইসরায়েলি বা ইহুদিদের প্রতি ঘৃণাবশত হামাস গত ৭ অক্টোবর হামলা চালিয়েছে; কিন্তু আমার মনে হয় এই ধারণা পুরোপুরি ঠিক নয়। কেবলমাত্র ঘৃণার বশবর্তী হয়ে হামাস এই হামলা করেনি।’
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct