মহবুবুর রহমান : গাজার এক পাশে ভূমধ্যসাগর, এক পাশে মিশর এবং দুই পাশে দখলদার ইসরায়েল। পরবর্তীতে ইঙ্গো-মার্কিনের সহায়তায় ইঙ্গো-মার্কিন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘে এই বিষয়টি উত্থাপিত হয়। এতে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনকে দুখণ্ড ঘোষণা করার দাবি রাখে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, নেদারল্যান্ডস, পেরু প্রভৃতি রাষ্ট্র। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতা করে ভারত, পাকিস্তান, ইরান। তবুও স্বাধীন ফিলিস্তিনকে ভেঙে ৫৭ শতাংশ ভূমি নিয়ে ইসরাইল আর ৪৩ শতাংশ ভূমি দেয় ফিলিস্তিনকে। অথচ ইহুদি জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র এক-চতুর্থাংশ। জাতিসংঘ সেদিন একপাক্ষিক ও একচোখা সিদ্ধান্ত নেয়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সুপার পাওয়ার তথা পরাশক্তি হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে দুটি রাষ্ট্রের। একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যটি রাশিয়া। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে বলা হয় ‘স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠাণ্ডা যুদ্ধ’। ফলে গোটা পৃথিবীটা দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যায়। এজন্য আমরা দেখতে পাই, রাশিয়া ফিলিস্তিনকে সমর্থন দেয়, অন্যদিকে আমেরিকা ইসরাইলকে সমর্থন দেয়। একটা কথা খুব জোরেসোরে মনে রাখা দরকার, রাশিয়া-আমেরিকা কোনো স্বার্থ বা লাভ ছাড়া কোনো দেশ বা যুদ্ধকে সমর্থন করে না এবং তাদের সমর্থনই সমস্যার ক্ষত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করতে থাকে। তাদের সমর্থন অনেকটা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো। যে রাশিয়া ইসরাইলের পক্ষে দ্বিজাতিতত্ত্বের সমর্থন করেছিল সে রাশিয়া পরবর্তী সময় মজলুম ফিলিস্তিনকে সমর্থন করার পেছনে স্বার্থ ও রহস্য থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মূল কারণ হলো আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ফিলিস্তিন-ইসরাইলের দিকে তাক করা। (বলা বাহুল্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় ইউক্রেন বর্তমান রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল।১৯৯১ সালে ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইউক্রেন হলো পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্র।আমেরিকা-ব্রিটেন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ন্যাটো জোট চায় পূর্ব ইউরোপে তাদের আধিপত্য ও শক্তির বলয় বিস্তার করতে। তাই ২০০৮ সাল থেকেই ইউক্রেনকে ন্যাটোর জোটে যোগ করার আশ্বাস দিয়ে আসছে। ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনেস্কি ন্যাটোতে যোগ দিতে তোড়জোড় চালাচ্ছেন। যদি ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেয় তাহলে রাশিয়ার শক্তি অনেকটা কমে আসবে। এজন্যই মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।এদিকে আবার চীন ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখলেও ভারত আবার ইসরাইলের দিকে ইতিবাচক। অথচ চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের ১০ লাখ উইঘুর নারী-পুরুষকে ‘চরিত্রশোধনাগার’ নাম দিয়ে নির্মমভাবে দিনের পর দিন অত্যাচার করছে। আসলে রাজনৈতিক, ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ ছাড়া কেউ কাউকে সমর্থন দেয় না। এভাবে যদি পরাশক্তিগুলো দুইটি শিবিরে ভাগ হয়ে একটা সমস্যাকে দুইটি ভাগে ভাগ করে ফেলে তাহলে সে সমস্যা আজীবনেও সমাধান হবে না। সমস্যা লেগেই থাকবে। আর গাজায় কাজের সংকট, খাদ্য সংকট নিত্যদিনের। কিন্তু মাদকের সংকট নেই। ইসরায়েল গাজায় হরেক রকমের মাদক প্রবেশের সুযোগ তৈরি করে দেয়। উদ্দেশ্য ফিলিস্তিনিদের মাদকাসক্ত করে গড়ে তোলা।
মিশরের সঙ্গে দক্ষিণ গাজার সীমান্ত রাফাহ এখন বন্ধ। এই সীমান্ত খোলার আলোচনা চলছে। হাজারো ফিলিস্তিনি রাফাহ সীমান্তে জড়ো হয়েছে। এ কথা সত্য যে হামাস ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে নির্মমতা চালিয়েছে। প্রশ্ন এসেছে—হামাস কেন ইসরায়েলে আক্রমণ করল? কারণ হতে পারে দুটি। প্রথমত, যেসব দেশের অবস্থান ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ও ইসরায়েলের বিপক্ষে ছিল, তারাও ক্রমান্বয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে। বিশেষ করে আরব বিশ্ব, সৌদি আরব যার নেতৃত্বে। ফিলিস্তিনিরা বা হামাস মনে করছে, তাদের স্বার্থ এখন আর কেউ দেখছে না। হামাস ইসরায়েলে হামলা করে বুঝিয়ে দিলো যে, ফিলিস্তিনিদের বাদ দিয়ে কোনো শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া সম্ভব না।দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল প্রতিদিনই একটু একটু করে ফিলিস্তিনিদের জায়গা দখল করে ইহুদি বসতি স্থাপন করছে। ফিলিস্তিনিদের নিপীড়ন করছে, হত্যা করছে। ইসরায়েল সরকার তার নাগরিকদের নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, যা কিছুই ঘটুক না কেন, তারা নিরাপদ। হামাস আক্রমণ করে বোঝাতে চাইল ইসরায়েলি জনগণও নিরাপদ নয়।হামাসের আক্রমণ নিয়ে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ চলছে। সেই ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণের প্রায় সবই পক্ষপাতদুষ্ট বলেই বিশ্লেষকদের অভিমত।পৃথিবীর সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে, একই রকম আচরণ করছে তাদের গণমাধ্যমও। ইসরায়েলি বর্বরতাকে জাস্টিফাই করে, তারা শুধু সামনে আনছে হামাসের নির্মমতা। ইসরায়েলের সর্বাত্মক অবরোধে গাজায় জল নেই, জ্বালানি নেই, ওষুধ নেই। কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ টি বৃহৎ পরিসরের হাসপাতাল বোমা ফেলে ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েল। শিশুখাদ্য তো বটেই, সামগ্রিকভাবেই খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে গাজায়। বোমাবর্ষণ চলছে। নৌ ও স্থল আক্রমণ আরও তীব্র করার ঘোষণা দিয়ে উত্তরাঞ্চলের গাজাবাসীকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ জারি করেছে ইসরায়েল। সবাই জানে গাজার উত্তরের ফিলিস্তিনিদের দক্ষিণে চলে যাওয়ার বিষয়টি অবাস্তব, অকল্পনীয় , অসম্ভব। এমনিতেই গাজা ঘনবসতিপূর্ণ। উত্তরের ১০-১২ লাখ গাজাবাসীর ঠাঁই হবে না দক্ষিণে। ইসরায়েল মূলত দুটি কারণে উত্তর গাজার ফিলিস্তিনিদের সরে যেতে বলেছে। এর মাধ্যমে বেসামরিক ফিলিস্তিনি হত্যার বিষয়টি তারা জায়েজ করতে চায়। বলবে, আগেই তো সরে যেতে বলেছিলাম। সরে না যাওয়ায় তারা মারা গেছে। আর দ্বিতীয় বা প্রধান কারণ, গাজার উত্তর অংশে ইসরায়েল দখল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। গাজার উত্তর অংশে ফিলিস্তিনিদের আর কখনো আসতে দেবে না ইসরায়েল। আসলে এ ফিলিস্তিনি অপারেশনটি হঠাৎ ও অপ্রত্যাশিতভাবে শুরু হয়ে গিয়েছিল; এমনকি হিব্রু সংবাদপত্র হারেৎজ স্বীকার করে যে, “গাজা থেকে আক্রমণটি ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দাদের জন্যে একটি বড় বিস্ময়কর ও অপ্রত্যাশিত বিষয় ছিল। অপারেশনটি পূর্বে সংঘটিত অক্টোবর যুদ্ধের ৫০তম বার্ষিকীর একদিন পর হয়। দেইফ ভিডিও ক্লিপে নিশ্চিত করেছেন–যেটিতে তিনি অভিযানের প্রকৃত সূচনা ঘোষণা করেছেন–যে, অপারেশনটি “আল–আকসা মসজিদের ইসরায়েলি অপবিত্রকরণ ও অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ইস্রাইলীদের ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার” প্রতিক্রিয়া হিসাবে শুরু হয়েছে।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct