এম ওয়াহেদুর রহমান : উচুঁ-নীচুর ভেদাভেদ নির্মলকরণ ও সকলের প্রতি সমানাধিকারের স্বপ্নিল সওদাগর হয়ে ধরার বুকে আগমন করেছিল সাম্যবাদ। কিন্তু তার গালভরা বুলি যে আঁতুড়ঘরেই বিনষ্ট হয়েছে,তা নয় সাম্যবাদের প্রেতাত্মা - ‘উদারনীতি ‘, ‘ মুক্ত বাণিজ্য ‘ ‘ শিল্পায়নের নামে পুঁজিপতিদের পদলেহনে’র ছদ্মবেশে কায়েমী স্বার্থবাদের প্রতিনিধিত্ব করতে তৎপর হয়েছে। স্বৈরতন্ত্র আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আধুনিক সভ্যতা তথা প্রগতিবাদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্র বাস্তবায়িত হয়ে থাকে রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলো আশাহত জনগণের আশা পূরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। স্থান বা নিদর্শনের নাম পরিবর্তন হলো রাজনৈতিক বৈতরণী পার হওয়ার একটি অন্যতম কৌশল। ভারত হলো বিশ্বের একটি অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ। এই ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন কাল থেকেই নাম পরিবর্তনের সংস্কৃতি চলে আসছে। ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন অজুহাতে বিভিন্ন সময় স্থান ও নিদর্শনের নাম পরিবর্তন হয়ে আসছে। তবে বিশেষ করে ধর্মীয় কিংবা সাম্প্রদায়িক কারণে নাম পরিবর্তন বেশি হয়েছে। ভারতীয় রাজনীতির অলিন্দে নাম পরিবর্তনের কৌশল খুবই চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
আজকের দিনে ভারতে নাম পরিবর্তনের হিড়িক ব্যাপকতা লাভ করেছে। একের পর এক বিখ্যাত রাস্তা বা শহর গুলোর নাম পাল্টে দেওয়া হচ্ছে। আর এই নাম পরিবর্তন নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা। সন্দেহ নেই যে নাম পরিবর্তনের এসব আয়োজন পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। ভারতের বিভিন্ন নির্বাচনে এই সব নাম পরিবর্তনের গভীর যোগ রয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের দিক থেকে এটি ভয়ঙ্কর ও বিধ্বংসী প্রবনতা। কেননা প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বা এলাকার আদি নামকরণের পেছনে আছে দীর্ঘ ইতিহাস ; আছে অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্নিক বা সামাজিক কারণ। আসলে নাম পরিবর্তনের সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী শাসকের ক্ষমতা প্রদর্শনের নীরব অভিলাষ যুক্ত থাকে। নাম পরিবর্তনে অতি সংকীর্ণ ধর্মীয় বিবেচনা এখন বিশেষ ভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। সুপরিকল্পিত ভাবে ভারতের সুলতানি ও মুঘল আমলে নির্মিত বারোশো বছরের প্রাচীন মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নাম নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা ক্রমশ অব্যাহত রয়েছে।প্রায় কিছু কিছু রাজনৈতিক দলগুলো শাসনভার গ্রহণ করার পর নাম পরিবর্তনে উদ্যোগী হয়ে উঠছে। শাসকদল ভোটারদের তোয়াজ করতেই এমন কাজ করছে। ভারতের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতির সভ্যতা, ইতিহাস, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তারা যে কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো এবং আরো যে সব অমূল্য ত্যাগ ও কুরবানী দিয়েছে, এই সব বিষয়কে ইদানিং উপেক্ষা করার কিংবা অস্বীকার করার মানসিকতা জন্ম নিচ্ছে। ভারতের ইতিহাস কে পরিকল্পিত ভাবে এমন করে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা চলছে, যেন মুঘলদের বিশেষতঃ মুসলিমদের যুগটা নিকৃষ্ট এক প্রবাসী জাতির সাম্রাজ্যবাদী যুগ বৈ কিছুই নয়,যার মধ্যে ভাবলেও কল্যাণ বলতে কিছুই ছিল না। এ সময়ের মধ্যে মনে হচ্ছে যেন তারা কোনো জ্ঞান বিজ্ঞান ও সভ্যতার উন্নয়নে কৃতিত্ব প্রর্দশন করে নি। তাছাড়া দেশ গড়ার ও জাতীয় উন্নয়নে এমন কোনো অনাবিল তথা নির্দোষ কাজ হয়তো করেনি, যা নিয়ে ভারত গর্ভ করতে পারে। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের ভূমিকা ছিলো নীরব দর্শকের অথবা নির্লিপ্ত কোনো জাতির। ঘটনাক্রমে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিলে ও তা প্রায় অনুল্লেখ্য রয়েছে। ভারতে পরিবর্তিত স্থান কিংবা নিদর্শন গুলো কিছু উপস্থাপন করা হলো - এলাহাবাদ পাল্টে হয়েছে প্রয়াগরাজ, আহমেদাবাদ নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেওয়া হয়েছে কর্ণাবতী, মোগলসরাই রেল স্টেশনের নাম পরিবর্তিত হয়ে নতুন নাম হয়েছে দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশন, হিমাচলের সিমলা হয়েছে শায়মালা, মুঘল গার্ডেন হয়েছে অমৃত উদ্যান, ফৈয়াজবাদ হয়েছে অযোধ্যা, মধ্যপ্রদেশের আজমগড় হয়েছে আরইয়াগড়, বেগম হযরত পার্ক হয়েছে ঊর্মিলা বাটিকা,হুমাইন সাগর হয়েছে বিনায়ক সাগর, মুজফফর নগর হয়েছে লক্ষী নগর, নবী মুম্বাই এয়ারপোর্ট হয়েছে বি বি পাতিল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, উত্তর প্রদেশের ফিরোজাবাদ হয়েছে চন্দ্রনগর, গুজরাটের আহমেদ নগর হয়েছে আনন্দ নগর, হরিয়ানার মুস্তাফাবাদ হয়েছে স্বরস্বতী নগর, খিজিরবাদ হয়েছে প্রতাপনগর, তামিলনাড়ুর আলিয়াবাদ হয়েছে কালাম্বুর, কলকাতা বন্দর হয়েছে শ্যাম্যাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দর,ন্যাশনাল লাইব্রেরি ভাষা ভবনের নতুন নাম হয়েছে শ্যাম্যাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ভবন, ন্যাশন্যাল গার্ল চাইল্ড হয়েছে বেটি বাঁচা, বেটি পড়া ও যোজনা, ন্যাশন্যাল ম্যানুফাকচারিং পলিসি হয়েছে মেক ইন ইন্ডিয়া, আলিগড় হতে চলেছে হড়িগড় প্রভৃতি। দেশের ইতিহাস বিজড়িত জনপদের নাম কিংবা নিদর্শনের নাম অথবা ইতিহাস ঐতিহ্যের পরিবর্তন সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কখনোই কাম্য নয়। নাম পরিবর্তনের নানান অজুহাতে কোনো জাতির ইতিহাস ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার যে চেষ্টা আজ ও হয়তো অব্যাহত রয়েছে তা জাতির আত্মহননের অপচেষ্টা। দিন বদলের কিংবা প্রগতির জিগির তুলে যারা নাম পরিবর্তন করে চলেছেন তাঁরা কি কখনো ভেবে দেখেছেন, তাঁদের ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর কি হবে ? কিংবা যারা পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন হবে তখন কি হবে? ক্ষমতা কখনো এক হাতে থাকে না। ধর্মান্ধতার আশ্রয় নিয়ে ঐতিহাসিক শহর,নগর,জনপদ,রাস্তার নাম বা কোনো পার্কের নাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক বৈতরণী পার হওয়ার প্রচেষ্টা গণতান্ত্রিক নীতি সম্মত নয় ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct