দেশ-বিভাগ পরবর্তী পশ্চিমবাংলার একটি শক্তিধর পরিবার থেকে উত্থিত খাজিম আহমেদ প্রায় ছয় দশক ধরে নিরলস বৌদ্ধিক চর্চা আর সাহিত্য নির্মাণে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছেন। তাঁর ‘চেকার্ড’, আর ‘মাভেরিক’ জীবনের বর্ণময় পরিচয় বর্তমান আলোচনাটির মারফত উত্থাপন করা হচ্ছে। অনেকেই তাঁকে এই বঙ্গের বাঙালি মুসলমানদের মর্যাদার অন্বেষক হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। তাঁর অগণন রচনার অনিঃশেষ গ্রহণযোগ্যতা উভয়বঙ্গে তাঁকে বিশিষ্ট করে তুলেছে।
১৯৯০-এর দিকে কারা যেন কোনো একটি বিষয়ে আলোচনার জন্য মহাশ্বেতা দেবীকে কান্দি নিয়ে যেতে চান। সঙ্গে থাকবেন প্রাণরঞ্জন চৌধুরী, অপূর্ব ভট্টাচার্য এবং খাজিম আহমেদ। কী আশ্চর্য গাড়ির কথাই তুললেন না। সোজা বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ায় জন্য আমাকে বললেন রিক্সায় ওঠো। কান্দির হ্যালিফক্স হলে পৌঁছে দেখি প্রিন্স অতীশ সিংহ মহাশয় দিদিকে ‘রিসিভ’ করার জন্য সাদা মুচমুচে (crisp) ধুতি-পাঞ্জাবি আর কোলাপুরী চপ্পল পরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সঙ্গে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন। অপূর্ব ভট্টাচার্য অপূর্ব ছবি তুলেছিল আধ ডজন। মওজুদ রয়েছে আমার কাছে। একবার অধ্যাপক দীপংকর চক্রবর্তী গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে সেমিনার করেছিলেন কলেজিয়েট স্কুলে। দীপংকরদার সঙ্গে দিদির সম্পর্ক ছিল ভীষণ আন্তরিক। কলকাতার বাসস্থানে (বালিগঞ্জ স্টেশন রোড) গিয়েই আমন্ত্রণ জানান। দীপংকরদাকে দিদি বলেন, ‘তুমি তো কলেজ নিযে ব্যস্ত থাকো, তাই খাজিমকে পাঠিয়ে দেবে, ও এসে আমাকে নিয়ে যাবে।’ কথা রেখেছিলেন। শহর বহরমপুরের তাঁর অনুরাগীরা হল ভর্তি করে দিয়েছিলেন। একবার খোদ লন্ডন থেকে হেনরি নামে একজন তরুণ গবেষক দিদির সঙ্গে কলকাতা থেকে বহরমপুর এলেন। আমার ডাক পড়ল। পৌঁছোতে বললেন, কালকে কি স্কুল যাচ্ছ? বললাম, আপনি এখানে, আমি ওখানে কী করে হয়। বললেন, হেনরি সীমান্তবর্তী চর এলাকার জনজীবন নিয়ে গবেষণা করছে। তোমার জন্যই ওকে ধরে এনেছি। কাতলামারি, সাগরপাড়া, জলঙ্গির দিকটা ওকে সার্ভে করতে সাহায্য করো । লোকেদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দাও, তুমি দোভাষীর দায়িত্বটা নেবে। তিন দিনের মাথায় হেনরি পরিষ্কার উচ্চারণ করল খাজিমদা। দিদি খুশ। আমি খুশি। হেনরি কৃতজ্ঞচিত্তে তাকিয়ে রয়েছে। শহর বহরমপুরের মাত্র দুজন বিদূষী এবং মহীয়সী মহিলা আমাকে হুকুম এবং আদেশ করার অধিকারী ছিলেন, ঈপ্সিতা গুপ্ত এবং মহাশ্বেতা দেবী। তারা আজ নেই। বেদনায় আচ্ছন্ন, বিষণ্ণ বেলায় মনে পড়ে । কষ্ট হয়। আবার মনে করে সন্তোষ বোধ করি। অধ্যাপক রেজাউল করীমের জীবনের শেষ দু-দশক হররোজ প্রত্যক্ষ করেছি! কত কথা, কত স্মৃতি যে রয়েছে তার অন্ত নেই। সে বাবদে একটি পূর্ণ লেখা ভিন্ন সময়ে পেশ করা যাবে। হরিজনের সঙ্গে বসে চা পান, ডেভিস রোডের (আবদুস সামাদ রোড) ‘নন-প্রিভিলেজড’ শ্রেণির বাচ্চাদের মধ্যে তাঁর প্রত্যহ বিস্কুট বিতরণ, হাজারো মানবীয় কাজকম্ম। সুচতুর সংসারে এক দরবেশের নির্লিপ্ত জীবন। শুধুমাত্র একটি দিনের কথা বলি। ১৯৮৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করবে এমন বিশ্বস্ত খবর দিলেন ড. জহর সেন। অধ্যাপক সেন অধ্যাপক করীমের প্রতিবেশী ছিলেন। ড. সেন চলে যেতেই বললেন, ‘বাবা খাজিম, সেদিন তুমি আমার সঙ্গে থাকবে, লাঠিটা ধরবে, ডায়াসে তুমি থাকবে’— তিনি বুঝছেন না যে তাঁর জন্য বহরমপুর গার্লস কলেজের শিক্ষিকারা প্রস্তুত হয়ে আছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে লোক প্রস্তুত রয়েছে। বস্তুত তাঁরা অধ্যাপক করীমকে সামলানোর দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দিলেন। ‘জলসিঁড়ি’ পত্রিকার সম্পাদক অপূর্ব, সব ছবি তুললেন তাঁর মূল্যবান ক্যামেরা দিয়ে। আজও তা যত্ন সহকারে আমার কাছে রক্ষিত রয়েছে। ‘শহর কলকাতা’ থেকে দূরে এসে বহরমপুর গার্লস কলেজের প্রাঙ্গণে বিশেষভাবে আয়োজিত সমাবর্তন উৎসবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সম্তোষকুমার ভট্টাচার্য শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন এইভাবে ‘মুক্ত জ্ঞান ও মুক্ত মন সৃষ্টি করাই বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার বিশ্বজনীন উদ্দেশ্য। সৌভ্রাতৃত্বের সেই মহতী আদর্শের দিকে লক্ষ রেখে এবং চিরকালীন সামাজিক অবদানের কথা বিবেচনা করে অশীতিপর বৃদ্ধ জ্ঞানতাপস রেজাউল করীম়কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে বিশেষ সাম্মানিক ডি.লিট. (Doctor of Literature Honoris Causa) উপাধিতে ভূষিত করা হল। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার সংগ্রামে অগ্রচারী সৈনিক ও সংস্কৃতি সমন্বয়ের নিরলস ব্রতচারী করীম সাহেবকে এই বিশেষ সম্মানে ভূষিত করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনাবিল গর্ববোধ করছে।’
(সূত্র: বাঙালি মুসলমান: আপন ভুবনের সন্ধানে, উদার আকাশ প্রকাশন)।
গত শতকের আটের দশকের মাঝের দিকে শহর বহরমপুরের অভিজাত ব্যক্তিত্ব, তুখোড় আইনজীবী, একদা পার্লামেন্টের সমস্য মাননীয় শশাংকশেখর সান্যাল আমার ৪৮/৬ কে.পি চট্টরাজ রোডের বাড়ির সামনে এসে হাজির। তাঁকে আমি চিনি। তিনি আমাকে চেনেন না। জানেন মাত্র। নীচ থেকে হালকা জোরে বলছেন, ‘খাদেম একটি টাকা নিয়ে নামো তো বাপু।’ তড়িঘড়ি হুকুম তামিল করলাম। তিনি টাকাটা নিলেন। রিক্সাচালককে দিলেন। পরনে লুঙ্গি, ‘বাটা’র হাওয়াই চটি। আদুল গা। শুধু একটি গামছা ঘাড়ের ওপর রাখা। বললেন, না বলে মেহমান হয়ে গেলাম। অতি যত্নে আমার স্ত্রী প্রতিমা এবং আমি ওপরে তুললাম। অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষ হাঁপিয়ে গেলেন। সোফায় শুইয়ে দিলাম, পর্যাপ্ত হাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। থিতু হওয়ার পর উঠে বসলেন। আমরা আতিথেয়তার হালকা দায়িত্ব পালন করলাম। বললেন, তোমার লেখা ‘গোষ্ঠ’র (রাধারঞ্জন গুপ্ত) ‘জনমত’-এ প্রতি হপ্তায় পড়ছি। ‘প্রাণে’র (প্রাণরঞ্জন চৌধুরী) ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় নানা লেখা পড়ছি। আমার মনে হয় তুমিই আমার বিশেষ একটি অভিজ্ঞতা মন দিতে শুনবে। সেই কারণে স্বাধীনকে (পুত্র, আইনজীবী স্বাধীন সান্যাল) না বলে গোপনে এসেছি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সাবেক বাংলার ‘প্রিমিয়র’ এ. কে. ফজলুল হক বহরমপুর সার্কিট হাউসের অতিথি হয়েছিলেন বেশ কিছুদিনের জন্য। সেই সময় শশাংকশেখর সান্যাল ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে প্রায় প্রতিদিন সঙ্গ দিতে সেখানে যেতেন। সেই অভিজ্ঞতা শোনার জন্য আমাকে তাঁর লালদিঘির বাড়িতে যেতে হবে। সানন্দে রাজি হলাম। নির্দিষ্ট দিনে ‘সুভাষশ্রী’ বাড়িতে হাজির হলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ভীষণ খুশি। বসার জায়গায় নিয়ে গেলেন। ‘রুহ-আফজা’-র সরবত পান করতে দিলেন। অতঃপর এ. কে. ফজলুল হকের উদার অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ, জনকল্যাণে কোনো রকম ধর্মীয় বাছ-বিচার না করে উপকার করার কথা বারে বারে উচ্চারণ করলেন। ঋণ সালিশী বোর্ড, কৃষকদের খাজনা মকুব, বিধবাদের অধিকার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আমাকে কত তথ্য যে দিলেন। আমার নানা লেখায় সে সব তথ্য ব্যবহার করেছি। এবার কৌতূহলোদ্দীপক কথাটি বলি : কয়েকদিন বাদে পোস্টম্যান নীচ থেকে চিৎকার করছেন, ‘Money Order, Money Order’। নীচে নেমে সই করে দেখি পোস্টম্যান আমাকে এক টাকা দিচ্ছেন। নিলাম। ছোট্ট টিঠি। লিখছেন— ‘খাদেম, কর্জ বা ঋণ রাখতে নেই। শোধ করতে হয়। তোমার এবং বউমার কল্যাণ কামনা করি।’ নীচে সই, শুধুমাত্র শশাংক লেখা। কী Humility! চোখে পানি এসে গেল। দুঃখ থেকে গেল তিনি আমাকে ‘খাজিম’ নামে চিনলেন না। আমি তাঁর কাছে ‘খাদেম’ (আল্লার সেবক) রয়ে গেলাম। সেই ঐতিহাসিক বাড়িটি কারা যেন মাটিতে গুড়িয়ে দিল, গাছ-গাছালি উপড়ে ফেলল অতি সম্প্রতি। আকাশছোঁয়া ইমারত হবে। আধুনিক সভ্যতার খেসারত আর কী! ড.নলিনাক্ষ সান্যাল আর শশাংকশেখর সান্যালের স্মৃতি সম্পৃক্ত ‘বাংলো’-টি শহর বহরমপুরের মর্যাদার একটি কেন্দ্র ছিল, সেটি হারিয়ে গেল। এটি শহরের বেদনা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct