কেন্দ্রের মসনদে দ্বিতীয়বারের মতো ‘সম্রাটের’ ভূমিকায় নরেন্দ্র মোদি। তার শাসনামলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি তলানিতে, বৃদ্ধি পেয়েছে বিদ্বেষের মাত্রা। যদিও নির্বাচনে ডাক দিয়েছিলেন ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। বাস্তবে তার যথার্থ প্রতিফলন না ঘটলেও প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে নিজের ইমেজ তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। তা নিয়ে আলোকপাত করেছেন ড. দিলীপ মজুমদার।
গদি মিডিয়া। আপনারা ইদানীং শুনছেন এই গদি মিডিয়ার কথা। হিন্দিতে ‘গদি’ শব্দের মানে কোলের কুকুর বা lapdog . যে সব মিডিয়া সরকারের তাঁবেদারি করে তাদেরই গদি মিডিয়া বলা হচ্ছে। মিডিয়া গণতন্ত্রের একটা স্তম্ভ। সরকারকে প্রশ্ন করে মিডিয়া, সেটাই তার সঠিক কাজ। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির আমলে, হয়তো বা তাঁরই চাপে, বেশ কিছু নিউজ চ্যানেল সরকারের দালালি করে চলেছে। হিন্দুত্বের প্রচার, বিরোধী তথা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিষোদগার, মিথ্যা সংবাদ প্রচার এই হল এদের কাজ। ‘গদি মিডিয়া’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন সাংবাদিক রাভিশকুমার। দিল্লির দেশবন্ধু কলেজের স্নাতক রাভিশকুমার ইণ্ডিয়ান ইন্সটিটিউট থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতকত্তোর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত তিনি যুক্ত ছিলেন এনডিটিভিতে। চ্যানেলের ফ্ল্যাগশিপ সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান যেমন ‘প্রাইম টাইম’, ‘হাম লোগ’, ‘দেশ কি বাত’, ‘’রাভিশ কি রিপোর্ট’ পরিচালনা করতেন তিনি। রাভিশ তাঁর যোগ্যতার নানা পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন : রামনাথ গোয়েঙ্কা এক্সিলেন্স ইন জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড, গৌরী লঙ্কেশ পুরস্কার, কুলদীপ নায়ার পুরস্কার, গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী পুরস্কার, ম্যাগসেসে পুরস্কার। সেই রাভিশকুমার কেন এনডিটিভি থেকে পদত্যাগ করলেন ? কারণ, এই টিভির ২৯% শেয়ার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বন্ধু গৌতম আদানির কাছে হস্তান্তরিত করা হয়। পরবর্তীকালে আরও ২৬% শেয়ার কিনে নিতে প্রস্তুত আদানিরা, তার জন্য তারা ৪৯৫ কোটি টাকা দিতে প্রস্তুত। আদানির মালিকানায় স্বাধীন সাংবাদিকতা সম্ভব হবে না। তাই রাভিশকুমারের পদত্যাগ। রাভিশকুমার বলেছেন, “ বর্তমানে সাংবাদিকতার ভস্মযুগ শুরু হয়েছে। সাংবাদিকতায় যা ভালো রয়েছে, তা ভস্ম করে দেওয়া হচ্ছে।“যাদের গদি মিডিয়া বলে আখ্যা দিয়েছেন রাভিশকুমার তাদের মূল কাজ হল মোদি সরকারের ডঙ্কা বাজানো। সরকারকে প্রশ্ন করার বদলে তারা সর্বদা তার গুণগান করে, সরকারের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখে। মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে। বিষোদগার করে বিরোধীদের, সংখ্যালঘুদের। একটা ‘ইসলামোফোবিয়ায়’ ভোগে তারা। আর এস এস বা ভারতীব জনতা দলের হিন্দুত্ব প্রচারে সাহায্য করে।কেন তারা সরকারের দালালি করে, তার কয়েকটি কারণ ব্যাখ্যা করেছেন এস কে হাসান তাঁর ‘ হোয়াই ইন্ডিয়াজ গদি মিডিয়া স্প্রেডস হ্যাট্রেড অ্যান্ড ফেক নিউজ’নিবন্ধে।
১] লোকসভায় বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির ক্ষমতালাভ –” Absolute majority of the BJP-led NDA in parliament and its government at the centre and in many states, and growing irrelevance and inconsequentiality of a large obliterated opposition .”
২] বিজেপির ১০০ মিলিয়ন হিন্দু দর্শক দেখবে এই সব টিভি ----” Hindu viewership by the BJP’s 100-million plus primary members and their massive support for the party and government, and the cult-like following of a monolithic Modi .”
৩] পাওয়া যাবে প্রচুর টিআর[পি …..” A high TRP achieved because of the majority Hindu viewership . “
৪] বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান পাওয়ার সম্ভাবনা …..” Funding by big business houses, which might be chummy with a particular party which supports their growth and in return they support that party . “
৫] কোন কোন চ্যানেলে বিজেপি নেতা বা আর এস এসের নেতার মালিকানা আছে…”Ownership or stakes of certain BJP and RSS leaders, MP’s and supporters in some of these TV channels . “
৬] সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার সুবিধে থাকে ….” A huge revenue earned from government advertisement which these channels receive in return for their pro-BJP/ RSS / government policies . “
৭] সমাজসেবার চেয়ে বাণিজ্যিক স্বার্থকে বড় করে দেখে ….” Commercial interests of these channels as business entities rather than as social service non-governmental organisations . “
৮] সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করলে নানা ধরনের শা্স্তির সম্ভাবনা …” For being targeted by the government for failure to toe the line .”গদি মিডিয়ার কথা বলতে হলে প্রথমেই বলতে হয় ‘রিপাবলিক টিভি’র কথা। যার কর্ণধার প্রাতঃস্মরণীয় অর্ণব গোস্বামী। তিনি এই চ্যানেলের সম্পাদক ও খবরের সঞ্চালক। কোন রাখ-ঢাক না করেএই চ্যানেল থেকে বিজেপি ও আর এস এসের প্রচার চালানো হয়। ছড়ানো হয় ভুয়া খবর ও সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণা। বিজেপি সাংসদ রাজীব চন্দ্রশেখরের অর্থ সাহায্যে রিপাবলিক টিভির যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ সালে। উত্তর কোরিয়ার সংবাদ মাধ্যম এবং আমেরিকার ফক্স নিউজের সঙ্গেই এর তুলনা চলে।‘দ্য টাইমস গ্রুপে’র চ্যানেল ‘ টাইমস নাও’। সভাপতি হলেন ইন্দু জৈন। সরকারের প্রতি অগাধ ভক্তির পুরস্কারস্বরূপ ইনি ‘পদ্মভূষণ’ লাভ করেছেন। ঘোর জাতীয়তাবাদী ও ঘোর বিজেপি সমর্থক চ্যানেল।হিন্দি নিউজ চ্যানেল ‘আজ তকে’র ভগ্নীপ্রতিম চ্যানেলরূপে ‘ইন্ডিয়া টুডে’ চ্যানেলের আত্মপ্রকাশ ২০০৩ সালে। অরুণ পুরী চ্যানেলের চেয়ারম্যান। এই চ্যানেলে বিজেপি ও অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের প্রচার চালানো হয়।সি এন এন নিউজ১৮ শিল্পপতি মুকেশ আম্বানির মালিকানাধীন। আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ড্রাস্ট্রিজের অধীনে চলে ৬৫ টি চ্যানেল। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আম্বানির ঘনিষ্ঠতা সর্বজনবিদিত।জি নিউজের মালিক সুভাষ চন্দ্র বিজেপির সমর্থনে রাজ্যসভার সদস্য হয়েছিলেন। তাই এই চ্যানেলে হিন্দুত্বের পক্ষে ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হয়। প্রাতঃস্মরণীয় সুধীর চৌধুরী এই চ্যানেলের প্রধান সম্পাদক ও প্রাইম টাইমের সঞ্চালক। সুধীর যেন রিপাবলিক টিভির অর্ণব গোস্বামীর প্রতিরূপ। প্রকাশ্যে তিনি বিজেপি, আর এস এস ও সর্বোপরি নরেন্দ্র মোদির প্রচার চালান। ফেক বা মিথ্যে সংবাদ পরিবেশনে এই চ্যানেলের জুড়ি মেলা ভার।২০০৪ সালে রজত শর্মা ও তাঁর স্ত্রী রিতু ধাওয়ান চালু করেন ‘ইণ্ডিয়া টিভি’ চ্যানেল। ছাত্রাবস্থায় শর্মা ছিলেন এবিভিপি-র সদস্য। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির ঘনিষ্ঠ বন্ধু রজত শর্মা। মিথ্যে খবর না পরিবেশন করলেও সত্যকে গোপন করা হয় সুকৌশলে। ফিল্ম সিটি অফিস থেকে বিতাড়িত হলে তাঁকে বিজেপি নতুন অফিস নির্মাণ করে দেয়। বিজেপি সরকার শর্মাকে ২০১৫ সালে পদ্মভূষণ দিয়েছিল।
অরুণ পুরীর ‘ইণ্ডিয়া টুডে গ্রুপে’র চ্যানেল ;আজ তক’। এই চ্যানেলের সঞ্চালক অঞ্জনা ওম কাশ্যপ, রোহিত সারদানা, স্বেতা সিং মুসলমান বিরোধী সংবাদ প্রচারের জন্য বিখ্যাত। এবিপি নিউজের মালিক অভীক সরকার। প্রথম দিকে নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করলেও সাংবাদিক পুণ্যপ্রসূন বাজপেয়ি ও অভিসার শর্মার প্রতি বিজেপি নেতৃত্ব ক্রুদ্ধ হতে এই চ্যানেল ভোল বদলাতে শুরু করে।‘সুদর্শন নিউজে’র চেয়ারম্যান সুরেশ চ্যবন দীর্ঘদিন আর এস এসের স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন তাঁর সাংবাদিকতার ভিত্তিতে আছে হিন্দুত্বের আদর্শ। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার হতে হয়, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন।‘নিউজ নেশনে’র সম্পদক দীপক চৌরাশিয়াকে মোদির হাতের পুতুল বলা হয়।‘ইণ্ডিয়া ২৪’ এর পেছনে আছেন বিজেপি মন্ত্রী রবি শঙ্কর প্রসাদের বোন অনুরাধা প্রসাদ। এই চ্যানেলের সঞ্চালক আমিশ দেবগণ অর্ণব গোস্বামীকে গড ফাদার মনে করেন।ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডিজাইনফোল্যাব নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাঁদের একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, বেলজিয়াম, জেনেভাসহ বিশ্বের ৬৫ টি দেশ থেকে ২৬০টিরও বেশি ওয়েবসাইটের সন্ধান পাওয়া গেছে যাদের কাজ হল ভারতকে সুবিধা দেবার জন্য পাকিস্তানের ক্রমাগত সমালোচনার মাধ্যমে ইইউ এবং জাতিসংঘকে প্রভাবিত করা। বেশির ভাগ ভুয়া ওয়েবসাইটের নাম রাখা হয়েছে বন্ধ হয়ে যাওয়া সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমের ভুয়া সাইটের নামে। ফেক নিউজ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার বিরাট ভূমিকা। ‘স্ট্যাটিস্টা’র দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে ভারতে ২০১৫ সালে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতেন ১৪ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ ; কিন্তু ২০২০ সালে সংখ্যাটি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ কোটি ৫০ লক্ষ ৪৭ হাজারে। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ম্যাসেঞ্জার এই সোশ্যাল মিডিয়ার উপাদান।পরিতোষ পাল ‘সোশ্যাল মিডিয়া ও ফেক নিউজ’ নিবন্ধে লিখেছেন, “অপরিহার্য এই গণমাধ্যমটি বর্তমানে আর নির্ভরযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ভুল খবর, বানানো খবর, উদ্দেশ্য প্রণোদিত খবর, গুজব ও হিংসাত্মক নানা ধরনের ভিডিয়ো সমাজ মাধ্যমে প্রাধান্য বিস্তার করার ফলে ফেক নিউজের দৌরাত্ম্য বেড়ে চলেছে।“ প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়াতে এমন সব খবর, ভিডিয়ো আমরা দেখি যেগুলো সত্য হতে পারে আবার না ও হতে পারে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতার বশবর্তী হয়ে, কোনরকম যাচাই-বাছাই না করেই তা ছড়িয়ে দেবার কাজ করেন। এমন কি নানা ধরনের গুজবও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের মাধ্যমে পল্লবিত হয়ে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে নানা প্রান্তে। গত কয়েক বছরে ভারতে সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের মাধ্যমে ফেক নিউজ স্টোরির সংখ্যা অসম্ভব বৃদ্ধি পেয়েছে।“ ফেক নিউজ নানা ধরনের হতে পারে। মিস ইনফরমেশন, ম্যাল ইনফরমেশন ও ডিস ইনফরমেশন। মিস ইনফরমেশন হল এমন সব ভুল খবর যেগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে ব্যবহারকারী প্রচার করে দেন। আবার ডিস ইনফরমেশনের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি খবরটি সত্যি জেনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তা ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেন। আর ম্যাল ইনফরমেশনের অর্থ যেসব খবর সত্যি হওয়া সত্বেও সেগুলো কোন ব্যক্তি বা সম্প্রদায় বা সংগঠনের ওপর আঘাত হানতে পারে বা রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে পারে তা জেনেও প্রচার করা। “‘ইন্ডিয়া’ নামে যে বিজেপি বিরোধী জোট গঠিত হয়েছে, সেই জোট গদি মিডিয়ার কয়েকজন সঞ্চালককে বয়কট করেছেন। এঁরা হলেন রিপাবলিক টিভির অর্ণব গোস্বামী, টাইমস নাও নবভারতের নাভিকা কুমার ও সুশান্ত সিনহা, আজ তকের সুধীর চৌধুরী ও চিত্রা ত্রিপাঠি, নিউজ ১৮ নেটওয়ার্কের আমন চোপড়া—আমিশ দেবগণ -আনন্দ নরসিংহ, ভারত ২৪এর রুবিকা লিয়াকত, ইণ্ডিয়া টু ডের গৌরব সাওয়ান্ত ও শিব আরুর, ইণ্ডিয়া টিভির প্রাচি পরাশর , ভারত এক্সপ্রেসের অদিতি ত্যাগী , ডিডি নিউজের অশোক শ্রীবাস্তব ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct