ফিলিস্তিনিদের প্রতি পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গদের অবজ্ঞার সংস্কৃতি চলে আসছে উনিশ শতক থেকে। সে সময় ফিলিস্তিনিরা শ্বেতাঙ্গ মার্কিন, ব্রিটিশ ও জার্মান ইভানজেলিক্যাল প্রোটেস্ট্যান্টদের ফিলিস্তিনে উপনিবেশ তৈরির চেষ্টায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ব্রিটিশরা চেয়েছিল ইউরোপীয় ইহুদিদের ধর্মান্তরিত করে ফিলিস্তিনে পাঠাবে উপনিবেশ গড়তে। এ প্রকল্প সফলতার মুখ দেখেনি। তবে তা ইহুদি জায়নবাদের উত্থান ঘটায়। উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে এখন পর্যন্ত ইহুদি জায়নবাদীরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি একই মনোভাব পোষণ করে। তারা ফিলিস্তিনিদের পরাজয়, মৃত্যু, বাস্তুচ্যুতি চায়। লিখেছেন জোসেফ মাসাদ।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গদের অবজ্ঞার সংস্কৃতি চলে আসছে উনিশ শতক থেকে। সে সময় ফিলিস্তিনিরা শ্বেতাঙ্গ মার্কিন, ব্রিটিশ ও জার্মান ইভানজেলিক্যাল প্রোটেস্ট্যান্টদের ফিলিস্তিনে উপনিবেশ তৈরির চেষ্টায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ব্রিটিশরা চেয়েছিল ইউরোপীয় ইহুদিদের ধর্মান্তরিত করে ফিলিস্তিনে পাঠাবে উপনিবেশ গড়তে। এ প্রকল্প সফলতার মুখ দেখেনি। তবে তা ইহুদি জায়নবাদের উত্থান ঘটায়।উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে এখন পর্যন্ত ইহুদি জায়নবাদীরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি একই মনোভাব পোষণ করে। তারা ফিলিস্তিনিদের পরাজয়, মৃত্যু, বাস্তুচ্যুতি চায়। উদ্দেশ্য একটাই, দেশটিতে যেন বসতি স্থাপনকারীরা উপনিবেশ তৈরির কাজটা শেষ করতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশবাদীরা অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতেন ও বৈরী মনোভাব পোষণ করতেন। ইউরোপীয় ও মার্কিনরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি যে অবজ্ঞাসূচক মনোভাব পোষণ করে, তার ধরনও একই রকম।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দ্য ব্রিটিশ বেলফোর ঘোষণা ও লিগ অব নেশনসের প্রতিশ্রুতিতে ফিলিস্তিনিদের বড়জোর বিরক্তি উদ্রেককারী গোষ্ঠী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত ছিল, ইউরোপ থেকে যে ইহুদিরা আসবে, তাদের ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে ফিলিস্তিনিদের ওপর বসিয়ে দেওয়া হবে। কারণ, ফিলিস্তিনিরা ছিল তাদের কাছে বর্জনযোগ্য একটি জাতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবং ইউরোপে গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় খ্রিষ্টান ও তাদের জায়নবাদী ইহুদি মিত্ররা ফিলিস্তিনকে নিশানা করল। আর খ্রিষ্টান–অধ্যুষিত ইউরোপে ইহুদিদের ওপর যে বর্বর নির্যাতন হয়, সে জন্য মূল্য দিতে হলো ফিলিস্তিনিদের।জায়নবাদীরা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের বড় অংশকে বাস্তুচ্যুত করার পর ফিলিস্তিন ইস্যুকে আরব শরণার্থী ইস্যু বলে গণ্য করা হলো। জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রস্তাবেও এভাবেই চিত্রায়ণ করা হয় তাদের। এরপর সবাই তাদের ভুলে গেল এবং ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে দিল। পরের দশকগুলোয় ফিলিস্তিনিদের প্রতি পশ্চিমাদের মনোভাব বদলে যেতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ যে চোখে ফিলিস্তিনিদের দেখত, তার পরিবর্তনও হয়।
ইসরায়েলি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিদের গেরিলা আন্দোলন, ১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরায়েলের দখলদারি এবং গণখুন, ১৯৮৭-৯৩ মেয়াদে ফিলিস্তিনিদের আন্দোলন গড়ে তোলা, ইন্তিফাদা ইত্যাদি ফিলিস্তিনিদের প্রতি পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল আনে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনি গেরিলাদের উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে যারা পশ্চিমাদের নৈতিকতার মানদণ্ড পেরোতে পারেনি, তাদেরই তারা জঙ্গি, সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিয়েছে। এমনকি ‘শান্তিপ্রিয়’ ইসরায়েলে হামলার জন্য ফিলিস্তিনিদের ‘পশু’ বলতেও দ্বিধা করেনি। বলা বাহুল্য, যারা এই মনোভাব পোষণ করে, তারা পশ্চিমা উপনিবেশবাদের ধারক ও বাহক—তাদেরই বর্ধিতাংশ।কিন্তু ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে সাবরা ও শাতিলায় গণখুন ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয় অনেকটাই। শিরশ্ছেদ করা ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ছবি মূলধারার ম্যাগাজিনগুলোয় ছাপা হয় সে সময়। ওই সময় পশ্চিমা রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। আগে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমালোচনামূলক ও শত্রুভাবাপন্ন। সেখান থেকে তঁাদের দৃষ্টিভঙ্গি সমালোচনামূলক ও বন্ধুত্বপূর্ণ।শত্রুতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন মাত্রা অবশ্য সব সময়ই ছিল। কিন্তু তঁাদের চিন্তাভাবনার যে ভিত্তি, তা ছিল অভিন্ন। যেমন জর্জ উইল। তিনি শত্রুভাবাপন্ন রক্ষণশীল মার্কিন রাজনৈতিক ভাষ্যকার। তিনি ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র ও স্বাধিকারের দাবির সঙ্গে একমত নন এবং ইসরায়েলে স্বার্থসংশ্লিষ্ট যেকোনো কিছুতেই জোরালো সমর্থন দিয়ে থাকেন। এরপরও গণখুনের পর উইল ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন, বৈরুতে গণখুনের পর মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক নৈতিক পাঠ বদলে গেছে। সাধারণ মানুষ আরেক দফা নির্যাতনের মুখে পড়েছেন। ফিলিস্তিনিদের প্রথম আন্দোলন ছিল প্রধানত নিরস্ত্র। এই আন্দোলনে পশ্চিমারা কোন পক্ষ নেবে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল। উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে খালি হাতে যুদ্ধরত ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের অনেকেই সহানুভূতি দেখিয়েছিল। কিন্তু যখনই তা ইসরায়েলি উপনিবেশবাদী সৈন্যদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, তখনই তারা নিন্দা জানাতে পিছপা হয়নি।অনেক ফিলিস্তিনি ও আরবদের কাছে পশ্চিমাদের এই সহানুভূতিশীল মনোভাব প্রেরণাদায়ী। উদার ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী ও অভিজাত রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন, তাদের এই মনোভাব ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। কিন্তু তাঁরা পশ্চিমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। পশ্চিমাদের নৈতিকতার উৎস ফিলিস্তিনিরা নয়, বরং ইউরোপীয় ইহুদিরা।তাদের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় তারা সহানুভূতি পাবে, নাকি নিন্দা। পশ্চিমে ইউরোপীয় ইহুদিরা আসলে ফিলিস্তিনিদের প্রতি পশ্চিমাদের মনোভাব কী হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করে। আর ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের মনোভাব নির্ভর করে আরব বিশ্ব, বিশেষ করে ফিলিস্তিনিরা তাদের কী চোখে দেখছে, তার ওপর।পশ্চিমে ইউরোপীয় ইহুদি বলতে বোঝানো হয় নাৎসিদের নির্যাতন থেকে বেঁচে ফেরা শরণার্থী, হলোকাস্টের শিকার, ইউরোপে হলোকস্ট–পরবর্তী নির্যাতনের শিকার, নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার যুদ্ধফেরত, কিংবা আরবের প্রতি ব্রিটিশদের প্রতিশ্রুতির শিকার হিসেবে। আর ফিলিস্তিনিরা ইউরোপীয় ইহুদিদের বিচার করে থাকে তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে। ফিলিস্তিনিদের কাছে ইউরোপীয়রা শরণার্থী নয়। বরং তারা দখলদার, যাদের একমাত্র কাজ ছিল জায়নবাদীদের ঔপনিবেশিকতার আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া। আর এই আকাঙ্ক্ষার জন্ম হিটলার ক্ষমতায় আসার পর। ইসরায়েলের প্রতি পশ্চিমা সমর্থনের কারণ শুধু বেসামরিক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু নয়, বরং ইহুদি বেসামরিক জনগণের মৃত্যু। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বা আরব, যাদের ইচ্ছে করে ইসরায়েলিরা হত্যা করছে, তাদের জন্য পশ্চিমাদের অনুভূতি কখনো এক হয় না।
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে অনুবাদ
জোসেফ মাসাদ যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরব রাজনীতি ও ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct