সনাতন পাল: পশ্চিমবাংলায় যত প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে প্রায় তার ৮০ শতাংশের উপরে স্কুলে প্রধান শিক্ষক নেই। দীর্ঘ দিন ধরে প্রধান শিক্ষক বিহীন এমনি ভাবেই স্কুল গুলি চলছে। এ রাজ্যে ২০১৩ সালের পরে কার্যত প্রাথমিকে কোনো প্রধান শিক্ষক নিয়োগ করাই হয়নি। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবৎ কেন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে না, সে বিষয়ে রাজ্য শিক্ষা দপ্তরের পরিষ্কার কোনো বক্তব্য রাজ্যের শিক্ষক/শিক্ষিকা এবং সাধারণ মানুষ জানেন না। এ দিকে রাজ্যে বেশ কিছু স্কুল ছাত্রাভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। ঐ স্কুল গুলির শিক্ষক/শিক্ষিকাদের অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে ঐ স্কুল গুলিতে ছাত্র নেই। কিন্তু এটা বলা হচ্ছে না যে এই স্কুল গুলিতে কেন ছাত্র নেই। ছাত্র না থাকার কারণ অনুসন্ধান করে যদি সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও বেশ কিছু সরকারি প্রাথমিক স্কুল ছাত্র / ছাত্রী শূন্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যেই জানা গেছে যে রাজ্যের বহু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৫ জন পড়ুয়া নেই। এখন প্রশ্ন হলো যেখানে রাজ্যে প্রাথমিক বিভাগের জন্য নতুন নতুন বেসরকারি স্কুল খুলছে সেখানে সরকারি স্কুল বন্ধ হচ্ছে কেন? কোথায় ঘাটতি? কোথায় খামতি? সরকারি স্কুল গুলিতে কি পরিকাঠামো নেই? না স্কুলে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই ? নাকি শিক্ষক থেকেও তাঁরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না? না পাঠ্যসূচি এবং পাঠ্যক্রম বিজ্ঞান সম্মত নয় ? সমস্যার মূল কারণ যেটাই হোক, সেগুলিকে নির্ণয় করা সম্ভব না হলে সেই সমস্যার সমাধান করাও সম্ভব নয়। এই নির্ণয়ের কাজ সরকারকেই করে, হয় উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে না হয় সরকারকে ঘোষণা করতে হবে যে, সরকার স্বয়ং সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে তুলে দিতে চায়। তার পরে মানুষ বিচার করবেন যে, এই বেনিয় সরকারকে তারা ক্ষমতায় ভবিষ্যতের জন্য রাখবেন কি না।
এ বিষয়ে শিক্ষিত অভিভাবক গণের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে উঠে আসছে, বেসরকারি স্কুলে পড়লে নাকি তাঁদের শিশুরা বেশি স্মার্ট হচ্ছে। পাশাপাশি এটাও বলছেন যে বেসরকারি স্কুলের শ্রেণী কক্ষ , পায়খানা, বাথরুম নাকি বেশ ঝকঝকে তকতকে এবং পাঠ্যক্রমও নাকি বিজ্ঞান সম্মত ও পাঠ্যসূচি মনোগ্রাহী এবং শিশুর মানসিক বিকাশের পক্ষে নাকি বেশ উপযোগী। এখন প্রশ্ন হলো সরকার চাইলে কি সত্যিই বেসরকারি স্কুল গুলির মত পরিকাঠামো তৈরি করতে পারে না? নাকি পাঠ্যক্রম এবং পাঠ্যসূচি সেই রূপ তৈরী করা করা সম্ভব নয় ? নাকি সরকারের সদিচ্ছার অভাব? সরকারের যদি সদিচ্ছার অভাব না থাকে তাহলে কেন দ্রুত প্রধান শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে না? কেন এখনও রাজ্যে হাজার হাজার স্কুলে শ্রেণী ভিত্তিক শিক্ষক নেই?
কেন আজও রাজ্যে ছাদ বিহীন স্কুল ? তাহলে কি ডি.পি.ইপি, এস.এস.এম- একশো শতাংশ সাফল্যে পৌঁছাতে পারেনি ? কোথায় ত্রুটি ? অনেকেই একথা বলেন যে কোনো কোনো স্কুল দলীয় নেতাদের সুপারিশ একাধিক বার টাকা পেলেও প্রয়োজনীয় অনেক স্কুলই নাকি সেই টাকা পান নি। তাহলে এ প্রশ্ন কেন আসবে না য, ডিপিও সাহেবরা কি নিরপেক্ষ ভাবে কাজ না করতে পেরে প্রয়োজনীয় নিরপেক্ষতা দলীয় রাজনীতির কাছে বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছেন? জেলায় জেলায় ডি.এম সাহেবরা তো এস এস এমের মাথার উপরে চেয়রম্যান হয়ে বসে রয়েছেন, তাহলে কি তারাও রাজনীতির কাছে গৃহপালিত ?
প্রাথমিকে যে স্কুল গুলিতে পঞ্চম শ্রেণী আছে সেই স্কুলে মোট শ্রেণী সংখ্যা ৬ আর যেখানে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত রয়েছে সেখানে ৫ টা করে শ্রেণী রয়েছে। রাজ্যে এমন স্কুল বহু রয়েছে যেখানে শুধুমাত্র দুজন সহকারী শিক্ষক/ শিক্ষিকা রয়েছেন এবং সেখানে তার মধ্যে একজনকে টি আই সির দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো টি আই সিকে বেশির ভাগ সময়ই অফিসিয়াল কাজ করতে হয়। একজন শিক্ষকের পক্ষে ৫ টা শ্রেণী সামলানো কখনই সম্ভব নয়। তাহলে কারো বাচ্চাকে ঐ রকম একটা সরকারি স্কুলে ভর্তি করাবেন কেন? যেখানে একজন শিক্ষক এক সঙ্গে ৫ টা শ্রেণীর পঠনপাঠন দেখছেন। এই সমস্যা মেটাতেই দরকার শ্রেণী ভিত্তিক শিক্ষক।
প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তক সিলেবাসের অসারতার দিকটা কোনো অভিভাবকের বুঝতে খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে এমনিতেই বহু স্কুলে শ্রেণী ভিত্তিক শিক্ষক নেই। তারপরে আবার স্কুল থেকে শিক্ষক তুলে এনে অফিসে কাজে লাগানো হচ্ছে। কিন্তু এ ধরণের কাজ কখনই কাম্য নয়। অবর বিদ্যালয়ের অফিসে এবং ডি পি এস সি তে যদি প্রয়োজনীয় স্টাফ না থাকে তাহলে সেই স্টাফ নিয়োগ করা হচ্ছে না কেন? কেউ যদি মনে করেন যে স্টাফ নিয়োগ করার মত সরকারের আর্থিক সংগতি নেই। তাহলে সে ক্ষেত্রে এ প্রশ্নটাও আসবে যে সরকারের আর্থিক সংগতি-না থাকে, তাহলে সরকার লক্ষ্মীর ভান্ডারে ১০০০ টাকা করে দিয়ে ভোট ব্যাংক বাড়াচ্ছে কি করে? আর পুজো কমিটি গুলিকে এবং ইমামদের কেই বা কোটি কোটি টাকা বিলোচ্ছে কি করে ? ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনো ধর্মীয় উৎসবে বা ধর্মীয় কোনো পরিচিতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় অনুদান শুধু বেআইনই নয়- ধর্মনিরপেক্ষতারও পরিপন্থি।
মানব সম্পদ বিকাশের মূল ভিত্তিই হলো শিক্ষা। সেই কারণে অনুদানের রাজনীতির চেয়ে শিক্ষাকেই সরকারের অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে নাগরিকগণের আগ্রহও সে দিকেই বেশি থাকা দরকার। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সমস্ত ব্যবস্থাপনাই যদি সে দিকে না গিয়ে উল্টো পথে হাঁটেন, তাহলে নাগরিকগণ কেই এটা বোঝানোর দায়িত্ব নিতে হবে যে, কর্তার ইচ্ছাই কর্ম- আমরা সরকারকে নির্বাচিত করেছি জনগণের স্বার্থে কাজ করার জন্য- দলীয় স্বার্থে কাজ করে স্বজন পোষণের ভিত পাকাপোক্ত করতে নয়। আর এটা করতে হলে নাগরিকগণদের শিক্ষিত এবং সচেতন হতে হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct