জাইদুল হক: পশ্চিমবঙ্গ কিংবা ভারত অথবা বিশ্ব যেখানেই বিশেষত সংখ্যালঘু মুসলিমরা অত্যাচারিত কিংবা বৈষম্যের শিকার তখনই কলকাতায় মুসলিম বিদ্বজ্জনদের প্রতিবাদে শামিল হতে দেখা যায়। এছাড়া, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে কোনও ধরনের বিবাদ নিরসনে তারা বার্তা প্রেরণ করেন। এই সকল মুসলিম বিদ্বজ্জনদের মধ্যে সমাজকর্মী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে বেশ কিছু আলেমকেও দেখা যায়। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, রাজ্যে যখনই কোন সাম্প্রদায়িক অশান্তির পরিবেশ তৈরির চক্রান্ত শুরু হয়, তখন তারা দ্বিধাহীনভাবে শান্তি রক্ষার আহ্বান জানান। এমনকি অন্য রাজ্যে যখন সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন কিংবা বৈষম্যের ঘটনা ঘটে, তখন তাদের বিবেক গর্জে ওঠে। মজলুম মুসলিমদের পাশে দাঁড়িয়ে তারা সহমর্মিতাও দেখান। আর যারা নিপীড়কের ভূমিকা নিয়ে থাকে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হন। তা সে কর্নাটকে হিজাব নিষিদ্ধ, কিংবা গুজরাত দাঙ্গা, দিল্লিতে বুলডোজার চালানো হোক— সব ক্ষেত্রেই প্রতিবাদ একটা হাতিয়ার হয়ে ওঠে বিদ্বজ্জনদের। এমনকী এ রাজ্যে যখন বিজেপি কিংবার তার দোসর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বজরঙ্গ দল অথবা আরএসএস যখন রামনবমীর নামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা বাধায় তখন রাজ্যে শান্তি বিরাজের জন্য মুসলিম বিদ্বজ্জনদের আহ্বান করতে দেখা যায়। এমনকি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে আর্জি জানানো হয়। উদ্দেশ্যে একটাই, রক্তপাত বন্ধ করা।
বলতে দ্বিধা নেই, বাম আমল থেকে শুরু করে হাল আমলের তৃণমূল সরকারের আমলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বহু প্রাণ গিয়েছে এমন নজির নেই। এর মূলে কিন্তু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের সম্প্রীতি রক্ষার মানসিকতা। তার ফলে, কোনও দাঙ্গার উপক্রম হলেও রাজ্য সরকার কড়া হাতে তা দমনে লেগে পড়ে। এটা নিঃসন্দেহে বর্তমান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের এক বড় কৃতিত্ব। কিন্তু তবু এ রাজ্যের মুসলিমদের বহু প্রাণ অকালের ঝরে যাচ্ছে। আর তা ঘটছে রাজনৈতিক সংঘর্ষের কারণে। সেই রাজনৈতিক সংঘর্ষের শিকার হওয়া মুসলিমদের সংখ্যাটা কম নয়। এই রাজনৈতিক সংঘর্ষের মধ্যে তেমন কোনও সাম্প্রদায়িক মনোভাব দেখা না গেলেও নিহতদের প্রায় সিংহভাগই কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের। গত কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক সংঘর্ষগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক সংঘর্ষে যে সব মুসলিমদের মৃত্যু হচ্ছে তাদের ঘাতক কিন্তু মুসলিমরাই। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংঘর্ষের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, যারা রাজনীতির বলি হয়েছেন তাদের প্রায় সবাই হয় মুসলিম কিংবা তফশিলি জাতি বা তফশিলি উপজাতি সম্প্রদায়ের।সমাজের উপরতলার মানুষদের কিন্তু এই ধরনের রাজনৈতিক হিংসার বলি হতে দেখা যায় না। এর পিছনে সবচেয়ে প্রধান কারণ হল অসচেতনতা।
এমনিতেই মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষার হার কম। সচেতনতাও তাদের মধ্যে কম। তারা কোনও সাম্প্রদায়িক অশান্তির বিরুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকলেও রাজনৈতিক সংঘর্ষের ক্ষেত্রে নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে লড়তে দ্বিধাবোধ করেন না। তাই তাদের প্রাণ সহজেই ঝরে যায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কিংবা সংঘর্ষের কারণে। এর উদাহরণ আমরা সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে দেখেছি। যে প্রায় ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে তাদের সিংহভাগই কিন্তু মুসলিম। আর তাদের মৃত্যু হয়েছে মুসলিমদেরই হাতে। রাজনীতি করতে গিয়ে নির্মমতার নিদর্শন হয়ে উঠছে গ্রামবাংলার মুসলিমরা। বগটুই কাণ্ড দেখলেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সেই ট্র্যাডিশন কিন্তু সমানে চলছে। সর্বশেষ উদাহরণ, দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরের দলুয়াখাকি। দলুয়াখাকিতে শাসক দলের এক মুসলিম নেতা ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। আরা যারা মেরেছে তারা কিন্তু সবাই মুসলমান। এমনকী এই খুনের প্রতিক্রিয়ায় বগটুইয়ের মতো যে ২০-২৫টি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে তাদেরও সবাই কিন্তু মুসলমান। এক্ষেত্রেও কিন্তু রাজ্যের মুসলিম বিদ্বজ্জনদের মন কেঁদে ওঠে না। যারা কথায় কথায় নানা ঘটনার বিবৃতি দিয়ে থাকেন তাদের মুখে এই ধরনের হত্যার নিন্দা করতে দেখা যায় না। এমনকী মুসলিমদের প্রতি কোনও বার্তা দেওয়া হয় না— তারা যেন এধরনের আত্মঘাতী হিংসার পথে না এগোন। অথচ, আমরা একটু বিশ্লেষণ করে দেখলে বুঝতে পারা যাবে কিভাবে রাজনীতির নামে মুসলিমদের অবাধে প্রাণ যাচ্ছে।, তা সে নির্বাচনের সময় হোক কিংবা নির্বাচন পরবর্তীতে হোক কিংবা অন্য সময়ে হোক।
বাম আমল কিংবা তৃণমূল শাসন সব সময়ই যে রাজনৈতিক হত্যার সিংহভাগ শিকার মুসলিমরা তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
গত দু দশকের দিকে তাকালে দেখা যাবে বাম আমলেও রাজনৈতিক হত্যায় মুসলিমদেরই আধিক্য ছিল, আজও আছে।
নথি বলছে, ২০০১ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের ছোট আঙারিয়ায় যে ১১জনকে রাজনৈতিক কারণে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটে তাদের সবাই মুসলিম। কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মৃত্যু ছাপিয়ে যায় ২০০৩ সালে। ২০০৩ সালে পঞ্চয়েত নির্বাচনে প্রাণ হারান ৭৬জন, ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রাণ হারান ৩৯জন, ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রাণ হারান ২৯ জন, আর ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রাণ হারান প্রায় ৫০জন। বলতে দ্বিধা নেই, সব ক্ষেত্রেই নিহতদের তালিকায় সবার শীর্ষে রয়েছে মুসলিমরাই। এই মুসলিমদের রাজনৈতিক সংঘর্ষ থেকে বিরত থাকার জন্য মুসলিম বিদ্বজ্জনদের সম্মিলিতভাবে আহ্বান জানাতে দেখা যায় না। অথচ আমরা দেখতে পাই এই সকল মুসলিম বিদ্বজ্জনদের মুসলিম সমাজে বিশেষ প্রভাব রয়েছে। দুঃখের বিষয় তাদের নজর শুধু প্রায় কলকাতা কেন্দ্রিক। কলকাতায় বসে গ্রামবাংলার দিকে নজর দেওয়ার দিকে অনাগ্রহই স্পষ্টমান। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক তাদের ভূমিকা নিয়ে। ছোট আঙারিয়া, বগটুই কিংবা জয়নগরের গ্রাম, কোথাও কিন্তু এই সকল বিদ্বজ্জনদের ছুটে যেতে দেখা যায় না রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে। দেখা যায় না সেখানে গিয়ে মুসলিমদের বোঝানো রাজনৈতিক সংঘর্ষ থেকে এড়িয়ে চলার জন্য। সচেতন অন্য সম্প্রদায়ের দেখে তাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত, সাবধান হওয় উচিত। সেই ভাবনা এই সব গ্রাম বাংলার নিতান্ত অবোধ মুসলিমদের ভাবাবে কে?
যেসব মুসলিম বিদ্বজ্জনদের বিভিন্ন সময় কলকাতার রাজপথে সরব হতে দেখা যায় তাদের নজর শহর কলকাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাদের সঙ্গে গ্রাম বাংলার শিকড়ের সম্পর্ক নেই বললে চলে। কদাচ, একটি দুটি ক্ষেত্রে গ্রাম্য এলাকায় সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রে আর্জি জানিয়ে থাকেন। কিন্তু রাজনৈতিক হিংসায় লিপ্ত হয়ে পড়া মুসলিমদের হেদায়েতের বার্তা দিতে তাদের দেখা যায় না। অথচ, মুসলিম বিদ্বজ্জনদের মধ্যে যেমন বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, আলেম আছেন, তেমনি সমাজকর্মীও আছেন। তাদের বার্তা মুসলিম সমাজ খুবই গুরুত্ব সহকারে নিয়ে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক হিংসায় মুসলিমদের হাতে মুসলিমদের গণহারে প্রাণ যাওয়ার পরও তাদের মন কেঁদে ওঠে না, তারা কোনো প্রতিবাদে সরব হন না। তাই প্রশ্ন, কবে মুসলিম বিদ্বজ্জনদের বিবেক জাগ্রত হয়ে উঠবে? কবে তারা পিছিয়ে পড়া ও শিক্ষার আলোয় না থাকা মুসলিমদের প্রতি বার্তা দেবেন, ইসলাম হিংসাকে পছন্দ করে না, তোমরাও সেই পথ অনুসরণ করো, রক্তপাত বন্ধ করো। আর সেই বার্তা গ্রাম বাংলার মুসলিমদের কাছে ছড়িয়ে দিতে না পারলে এভাবে রাজনৈতিক হিংসায় মুসলিমদের প্রাণ যেতেই থাকবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct