কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিত গান ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ একটি হিন্দি সিনেমায় ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছিল কবির পরিবারই। তবে এআর রহমানের সংগীত পরিচালনায় যেভাবে গানটি এখন উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে আপত্তি রয়েছে নজরুল পরিবারের। বরং বিতর্ক তৈরি হওয়ার পরে কবি পরিবারের মধ্যে থেকে দাবি উঠেছে, যে চুক্তি অনুযায়ী গানটি সিনেমায় ব্যবহার করা হয়েছে, তা প্রকাশ করা হোক। লিখেছেন অমিতাভ ভট্টশালী।
আবার বাংলাদেশ থেকে তানিয়া নূর তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “একটা গান বাজে করে কেউ গাইলেই আমাদের গেলো গেলো মাতম ওঠে কারণ আমরা নিজেদের সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান!! নজরুলের গান একজন ভিনদেশী ভিনভাষী কম্পোজার নতুন সুরে বাঁধলে নজরুলকে অপমান করা হবে বলে যারা মনে করছেন ... আমার মনে হয় না আপনারা নজরুলের ব্যাপকতা বুঝতেও পেরেছেন। নজরুলের প্রতিটা কাজ যদি যথাযথ সংরক্ষণ করে বিশ্ব দরবারে পৌঁছিয়ে দেয়া যেতো তাহলেই তাঁকে যথার্থ সম্মান জানানো হত।“এই বিশ্লেষণ দেওয়ার পরে তানিয়া নূর অবশ্য এটাও লিখেছেন যে এআর রহমানের সুর দেওয়া গানটা তার “একদম ভালো লাগে নি।“বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক ব্রাত্য রাইসু বলছেন, গানটির “১০২ বছর হইছে বয়স। কাজেই এখন এই গান যে কোনো সুরে যে কেউ গাইতে পারে। এমনকি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরেও। সেইটা বন্ধ করার দাবি খারাপ দাবি।“তা আপনারা এআর রহমানের নাকি সুরের লৌহ-কপাট শুইনা বইসা আছেন কেন? ‘নজরুলের সুরের’ গানটা শেয়ার করলেই পারেন,” ফেসবুকে লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু। এটাও উল্লেখ করেছেন তিনি যে এআর রহমানের গান তার কখনই ভাল লাগে না।বাংলাদেশের নাট্য ব্যক্তিত্ব রৌনক হাসানের প্রথমবার গানটা শুনে ভালো না লাগলেও কয়েকবার শোনার পরে অতটাও খারাপ মনে হয় নি।তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, “দ্রোহটা একটু কমেছে এইযা! সিনেমাতে কোন প্রেক্ষিতে গানটা ব্যবহার হয়েছে সেটাও বিবেচ্য।“মি. হাসান আরও লিখেছেন, “এটা নিয়ে এতোটা বিক্ষুব্ধ না হয়ে আমরা এটাকে অগ্রাহ্য করতে পারি। কিন্তু এতোটা বিক্ষুব্ধ হলে ভবিষ্যতে নানা বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেইতো কেউ সাহস পাবে না।“ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের গানকাজী নজরুলের জীবন নিয়ে, বিশেষ করে ১৯২০ থেকে ১৯৩০ – এই এক দশক নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে গবেষণা করেছেন অর্ক দেব।ওই সময়েরই রচনা ‘কারার ওই লৌহ কপাট’।মি. দেব বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “সেনাবাহিনী থেকে ফিরে এসে কবি তখন কলকাতার কলেজ স্ট্রীট অঞ্চলে থাকতেন। তার সঙ্গে বাস করতেন কমিউনিস্ট নেতা মুজফ্ফর আহমেদ। সেই সময়ের ইতিহাস থেকে আমি যা পেয়েছি, তা হল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর অনুরোধে কারা ওই লৌহ কপাট গানটি একটা কবিতা হিসাবে রচনা করেছিলেন কাজী নজরুল।“
“প্রেক্ষিতটা এরকম ছিল : ১৯২১ সালের ১০ই ডিসেম্বর দেশবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ। তিনি ‘বাঙ্গালার কথা’ নামে যে পত্রিকা চালাতেন, সেটার দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী বাসন্তী দেবী। কবি নজরুল চিত্তরঞ্জন দাসের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পত্রিকার দায়িত্ব নিয়ে বাসন্তী দেবী ঠিক করেন যে পরের সংখ্যায় দেশবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের রচনা ছাপাবেন। সেই সূত্রেই কাজী নজরুলকে একটা লেখা দিতে বলেন বাসন্তী দেবী। তিনি একটা চিরকূটে এই কবিতাটি লিখে সুকুমার রঞ্জন দাস নামে এক ব্যক্তির হাত দিয়ে বাসন্তী দেবীর কাছে পাঠান,” জানাচ্ছিলেন নজরুল গবেষক অর্ক দেব।‘বাঙ্গালার কথা’ পত্রিকার নামটা এইভাবেই ছাপা হত।“বাঙ্গালার কথা পত্রিকার ১৯২২ সালের ২০শে জানুয়ারি সংখ্যায় এটা ছাপা হয়েছিল। তার মানে ১৯২১ এর ডিসেম্বরের শেষ থেকে পরের বছরের জানুয়ারির প্রথম দু সপ্তাহের মধ্যে কোনও একটা সময়ে এটা রচিত হয়। সেই সময়ে কবির বয়স ২২ বছর ছয় মাস। ‘ভাঙার গান’ বইতে ১৯২৪ সালে এটি সংকলিত হয়েছিল। এটার সুর যদি খেয়াল করে দেখেন, এর মধ্যে একটা ‘ট’ এর অনুপ্রাস ব্যবহার করেছিলেন তিনি, যেটা সাধারণত আমরা র্যাপ সঙ্গীতে দেখে থাকি,” বিশ্লেষণ অর্ক দেবের।‘ভাঙার গান’এ প্রথম সংকলিততিনি বলছিলেন, “র্যাপ তো সবসময়েই প্রতিবাদের সুর, নজরুলও তো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সেই প্রতিবাদী ছন্দ, মানুষের মনকে আন্দোলিত করার ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন। আবার তিনি সদ্য সেনাবাহিনী থেকে ফিরেছেন, তাই এই গানের সুরে আমরা একটা মার্চিং সং-য়ের তালও পাই। দ্রুতলয়ের দাদরা ব্যবহার করা হয়েছিল গানটির সুরে।“যে বইতে গানটি প্রথম সংকলিত হয়েছিল, সেই ‘ভাঙার গান’ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।তাই ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত কোনও লিখিত সংকলনে গানটি ছিল না।অর্ক দেব বলছিলেন, “প্রায় ২৫ বছর কিন্তু গানটার সুর মানুষের মনেই গেঁথে গিয়েছিল। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু থেকে শুরু করে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী জেল বন্দী অবস্থায় নিয়মিত এই গানটা গাইতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৪৯ সালে গানটা প্রথম রেকর্ড হল। গিরীন চক্রবর্তীর গলায় সেই রেকর্ড বেরল ১৯৪৯ সালের জুন মাসে কলাম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি থেকে আর সেবছরই ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ ছায়াছবিতে প্রথমবার ব্যবহৃত হয় গানটি। সেটাও গিরীন চক্রবর্তীর গলাতেই।““এই গানটার সঙ্গে জড়িত গোটা ইতিহাসটাই বিকৃত করে দেওয়া হল। এআর রহমানের গানের যে প্রচার, সেটা তো সারা বিশ্বে এখন ছড়িয়ে পড়বে। অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্ম বিকৃত সুরে কাজী নজরুলের এই কালজয়ী গানটি শুনবে, তারা হয়তো এটাকেই নজরুলের দেওয়া আসল সুর বলে মনে করতে থাকবে,” বলছিলেন অর্ক দেব।প্রযোজকদের বক্তব্য নেই এখনওকাজী নজরুলের গানের সুর বিকৃতি নিয়ে বেশিরভাগ মানুষ এআর রহমানকে দুষছেন। তবে কবি-পৌত্র কাজী অনির্বাণ থেকে শুরু করে নজরুল গবেষক অর্ক দেবের মতো অনেকেই বলছেন যে মি. রহমান তো বাংলা জানেন না, তিনি গানটির সঠিক ভাবটা ধরতে ব্যর্থ হতেই পারেন।
“কিন্তু গানটা যারা গেয়েছেন, তারা তো বাঙালী, তারা তো বলতে পারতেন যে গানটার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কী, আসল সুর কোনটা। সেটা বলার তাদের সাহস হল না?” প্রশ্ন কাজী অনির্বাণের।সিনেমাটির প্রযোজক সংস্থা বা এআর রহমানের কাছ থেকে কাজী নজরুলের সুর-বিকৃতি নিয়ে কোনও বক্তব্য এখনও আসে নি।ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার বলরাম সিং মেহেতার লেখা তার স্মৃতিকথা ‘দ্য বার্ণিং চ্যাফিস’ -অবলম্বনে সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছে।যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত এম২৪ চ্যাফিস ট্যাঙ্ক সেই সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যবহার করত।‘গরীবপুরের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত ভারত আর পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি ট্যাঙ্ক স্কোয়াড্রনের ভয়াবহ সেই যুদ্ধের কথা ব্রিগেডিয়ার মেহেতা তার বইতে যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনই তা গ্রন্থিত হয়েছে অধ্যাপক মুনতাসির মামুন সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধ কোষ’ এর ষষ্ঠ খণ্ডে।‘মুক্তিযুদ্ধ কোষ’-এ লেখা হয়েছে, “যশোর সেনানিবাস থেকে ১১ কিলোমিটার এবং ভারত সীমান্ত থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত অখ্যাত গ্রাম গরীবপুর।“গরীবপুরে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর পাকবাহিনী মিত্রবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়,” লেখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কোষে।ওই যুদ্ধে রাশিয়ায় তৈরি পিটি-৭৬ ট্যাঙ্ক স্কোয়াড্রনের প্রধান মেজর দলজিৎ সিং নারাং যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হওয়ার পরেই বাহিনীর দায়িত্ব বর্তায় ক্যাপ্টেন বলরাম সিং মেহেতার ওপরে।সম্মুখ সমরে পাকিস্তানী স্কোয়াড্রনের ১৪টি ট্যাঙ্কের সবগুলি ধ্বংস করে ভারতীয় বাহিনী। পাকিস্তানী বাহিনীর বহু সৈন্যও নিহত ও আহত হন, আর ভারতীয় বাহিনীর ১৯ জন নিহত, ৪৪ জন আহত হন ও দুটি ট্যাঙ্ক সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়, লেখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কোষে।ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাতকারে ‘গরীবপুরের যুদ্ধ’-এ ভারতীয় বাহিনীর প্রধান, পরে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হওয়া বলরাম সিং মেহেতা মন্তব্য করেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়েই তিনি সহযোদ্ধাদের কথা দিয়েছিলেন যে তাদের অসম সাহসী এই যুদ্ধের বর্ণনা তিনি লিপিবদ্ধ করবেন।যুদ্ধজয়ের বহু বছর পরে, ২০১৫ সালে যখন তার ইউনিটের ৫০ বছর পার হল, তখনই তিনি গরীবপুরের যুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিকথা ‘দ্য বার্ণিং চ্যাফিস’ লেখেন।তার ওপরে ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে ‘পিপ্পা’ সিনেমাটি।
সৌজন্যে: বিবিসি(বাংলা)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct